তাঁর জমকাল জীবনযাত্রা দেখে মনে করা হত ‘দুঃসময়’ কখনও তাঁকে ছোঁয় না। সেই জীবনযাত্রা হালে বদলেছে কি না জানা নেই। তবে একের পর এক ঋণদাতা ব্যাঙ্কের কঠোর পদক্ষেপ কিংফিশার-কর্ণধার বিজয় মাল্যের ব্যবসায় আদৌ ‘সুসময়’ আসার সম্ভাবনা নিয়েই এ বার প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (ইউবিআই) দু’দিন আগেই কিংফিশার ও বিজয় মাল্যকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ধার বাকি ফেলা গ্রাহক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ বার সেই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিল আইডিবিআই ব্যাঙ্কও। মাল্যের হাতে এখন সামনের শুক্রবার পর্যন্ত সময়। ওই দিন ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ শোধ না-করার কৈফিয়ত দিতে আইডিবিআই কমিটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাঁকে। ব্যাখ্যা করতে হবে, অত টাকা বাকি ফেলার পরেও কেন তাঁকে ইচ্ছে করে ঋণ শোধ না-করা গ্রাহকের তকমা দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন মাল্য।
আইডিবিআই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এম এস রাঘবন জানান, এত টাকা আদায় করতে না-পেরে এ বার তাঁরা কিংফিশার-কর্তার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ আনার কথা ভাবছেন। তাঁর দাবি, এটা হলে ভারতীয় আইন অনুযায়ী কোনও কর্পোরেট সংস্থাতেই ডিরেক্টর হিসেবে থাকতে পারবেন না মাল্য। এবং যে-ব্যবসাগুলির সঙ্গে তিনি এই মুহূর্তে যুক্ত আছেন, সেগুলি আগামী দিনে কোনও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাবে না। যে-কারণে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, কোনও সংস্থা যদি ব্যবসার জন্য টাকাই জোগাড় করতে না-পারে, তা হলে সেগুলির অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে কার্যত প্রশ্ন উঠে যাওয়া স্বাভাবিক।
মাল্যের ইউবি গোষ্ঠীর তরফে মুখপাত্র প্রকাশ মিরপুরীর অবশ্য দাবি, “যে-কাউকে মনে হলেই এত সহজে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণ শোধ করেনি বলে ঘোষণা করে দিতে পারে না কোনও ব্যাঙ্ক। এর জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।”
প্রসঙ্গত, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিধি অনুযায়ী, ব্যাঙ্কের কোনও ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত ভাবে টাকা শোধ করছেন-না এই ঘোষণার অর্থ, ওই গ্রাহকের ঋণ মেটানোর ক্ষমতা আছে। কিন্তু তিনি টাকা শোধ করতে ইচ্ছুক নন। কারণ সে ক্ষেত্রে হয় তিনি প্রাথমিক ভাবে যে-জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেই কাজে টাকাটা না-লাগিয়ে অন্য কোনও কাজে বা খাতে সরিয়েছেন বা ঋণ পাওয়ার জন্য নিজের মুনাফাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন। কিংফিশার ও বিজয় মাল্যকে ইচ্ছে করে ঋণ শোধ না-করার তকমা দিতে গিয়ে সম্প্রতি ইউবিআই-ও তাদের বিরুদ্ধে ঋণ হিসেবে নেওয়া টাকা একাধিক অ্যাকাউন্টে সরানোর অভিযোগ এনেছে।
রাঘবন জানান, তাঁরা এই ঘোষণা করলে মাল্যকে সমস্ত পর্ষদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে। ফলে এমনিতেই সমস্যায় জর্জরিত কিংফিশার-কর্তা আরও বেকায়দায় পড়বেন। এখন মাল্য কিংফিশার ও তাঁর ইউবি গোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার পাশাপাশি ইউনাইটেড ব্রুয়ারিজ ও ইউনাইটেড স্পিরিট্সেরও চেয়ারম্যান।
বস্তুত, ঘাড়ের উপর ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি (৬১০০ কোটি টাকারও বেশি) ঋণ নিয়ে ২০১২ সাল থেকে বন্ধ হয়ে রয়েছে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের উড়ান। ওই ঋণ দিয়েছিল বিভিন্ন ব্যাঙ্ক নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম (যার মধ্যে বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত)। কিন্তু চালু হওয়া থেকে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আট বছরে মুনাফার মুখ দেখতে ব্যর্থ হওয়া এবং সংস্থাকে চাঙ্গা করতে নতুন লগ্নিকারী খুঁজে না-পাওয়ার পরে, কিংফিশারের ভবিতব্য একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়।
এতে এ বার আর এক প্রস্ত আঘাত হানছে ঋণদাতাদের কড়া পদক্ষেপ। যার কারণ এই সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারকদের বার্তা। তাঁদের মতে, অনাদায়ী ঋণ দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পথে অন্যতম কাঁটা। তাই এমনিতেই অনুৎপাদক সম্পদের জেরে কাহিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে তাঁদের আর্জি, অবিলম্বে কিংফিশারের মতো ঋণ বাকি ফেলা সংস্থার কাছ থেকে টাকা আদায়ে কঠোর হোক তারা।
এ দিকে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো কিংফিশারের উপর এসে পড়েছে দিল্লি হাইকোর্টের একটি নির্দেশ। যেখানে বিমান সংস্থাটিকে বলা হয়েছে তাদের প্রাক্তন এক পাইলটকে বেতন হিসেবে ২৯ লক্ষ টাকার বেশি সুদ সমেত মিটিয়ে দিতে।
ওই পাইলট দীনেশ কান্ত শর্মার অভিযোগ, ২০১২-র মার্চ থেকে জুলাই, এই পাঁচ মাসের নোটিস দিয়ে চাকরি ছেড়েছিলেন তিনি। ওই সময়ের জন্য সংস্থার তাঁকে বেতন দেওয়ার কথা। কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। বকেয়া বেতনের টাকা মেটানোর দাবি নিয়েই দিল্লি হাইকোর্টে যান তিনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচারপতি মনমোহন সিংহের নির্দেশ, দীনেশকে ওই ৫ মাসের জন্য প্রায় ২৮,৯৫,০০০ টাকা বেতন মেটাতে হবে কিংফিশারকে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে সুদও। বাকি পড়া বেতনের উপর বছরে ১০% সুদ দিতে হবে, যতদিন না তা পুরোপুরি মেটানো হচ্ছে।