ঝুঁকে পড়া বাজার আচমকাই প্রাণ ফিরে পায় গত শুক্রবার। সেনসেক্স বেড়ে যায় হাজার পয়েন্ট। আসলে ইজ়রায়েল-ইরানের সংঘর্ষে আমেরিকা এখন শামিল হচ্ছে না, এই খবরেই এমন লম্বা লাফ। তবে উত্থান ধরে রাখা শক্ত হবে। মুখে যাই বলুক, এরই মধ্যে আমেরিকা ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে বোমা বর্ষণ করেছে। ফলে লগ্নিকারীদের নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সঙ্কট বাড়ছে।
বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ, সীমান্তে সংঘর্ষ এখন আর কোনও সাময়িক এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সব সময়েই সংঘাতে আর উদ্বেগে উত্তপ্ত পৃথিবীর কোনও না কোনও অঞ্চল। আর সহযোগী কিংবা বিরোধী হিসেবে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে আরও অনেক দেশ জড়িয়ে পড়ছে এই সব ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটে। যার কম-বেশি প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে। এটাই হয়ে উঠছে নতুন স্বাভাবিক (নিউ নর্মাল) পরিস্থিতি।
ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে সংঘর্ষ বহু বছর ধরে চলেছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চলল যুদ্ধরত রাশিয়া-ইউক্রেন। ভারত-পাকিস্তানের মতো সংঘাত মাঝেমধ্যেই মাথা তুলছে বিশ্বের নানা অঞ্চলে। তাইওয়ানকে প্রতিনিয়ত চোখ রাঙাচ্ছে চিন। আমেরিকা সক্রিয় বিভিন্ন অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তারে। বিশ্বে কোথাও যুদ্ধ অথবা সংঘর্ষ চলছে না, এমন দিনের দেখা পাওয়া কঠিন। গোটা বিশ্বে শান্তিরক্ষা করা যাদের কর্তব্য, সেই রাষ্ট্রপুঞ্জ এখন কেমন যেন শক্তিহীন। পাশাপাশি শুরু হয়েছে শুল্ক যুদ্ধ। এ সবের বড়সড় প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিশ্বায়ন অনেকটা পিছু হটেছে। পৃথিবী যেন কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশই সামরিক শক্তি বাড়াতে তৎপর। লাফিয়ে বাড়ছে সামরিক বাজেট। বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ক্রমশ কমছে। ছিঁড়ে যাচ্ছে সরবরাহ শৃঙ্খল। ফলে বিপাকে পড়ছে বহু শিল্প। কাজ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
ভারতও এই সঙ্কটের বাইরে নয়। বিভিন্ন যুদ্ধের আঁচ ভারতীয় অর্থনীতিতে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যতটা, তার থেকেও বেশি প্রভাব পড়ছে ইজ়রায়েল-ইরান যুদ্ধের। বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের ব্যারেল ৬২ থেকে লাফিয়ে পৌঁছেছে ৭৬ ডলারে। ইরান এবং পাকিস্তান আকাশপথ বন্ধ করায় বিমান পরিবহণ শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে ঘুরপথে উড়ানের যাত্রা লম্বা হওয়ায়। ইরান হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করলে জাহাজে পণ্য আমদানি-রফতানির খরচও অনেক বাড়বে। চড়বে বিমার খরচ। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষের পরে ভারতকেও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াতে হচ্ছে। বড় রকম সুদ ছাঁটাইয়ের পরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি মজবুত থাকলেও, বহির্বিশ্বের পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে দেশকে।
অনিশ্চয়তা রাজত্ব করছে গোটা বিশ্বে। অস্থির শেয়ার সূচক। ধাক্কা খাচ্ছে বিভিন্ন শিল্প। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইজরায়েল, ইরানের মত দেশের সঙ্গে বাণিজ্য প্রায় স্তব্ধ। ব্যবসা কমছে তুরস্কের সঙ্গেও। আমেরিকার শুল্কনীতি শেষমেশ কী দাঁড়াবে, তা নিয়েও ধন্দে ব্যবসায়ীমহল। ধন্দ কাটতে আরও কিছু দিন বাকি। শেয়ার বাজার সর্বক্ষণ জল মাপছে। পরিস্থিতির উন্নতি-অবনতি অনুযায়ী ওঠানামা করছে। একটু লাভ হলেই লগ্নিকারী তা তুলে নিতে চাইছেন। অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ কমছে ফান্ডেও। সুরক্ষার খোঁজে বেড়েছে বরং সোনায় লগ্নির চাহিদা। যে কারণে তার দাম লাখ টাকা ছুঁয়েছে। লাখ পার করেছে রুপোও। একই কারণে শক্তি ফিরে পাচ্ছে ডলার।
যুদ্ধে ক্ষতির মুখে পড়েছে রফতানি প্রধান এবং আমদানি নির্ভর শিল্প, বিমান পরিবহণ, হোটেল-পর্যটন, বিদেশি যন্ত্রাংশ নির্ভর শিল্প ইত্যাদি। সম্ভাবনার মুখ দেখছে মূলত প্রতিরক্ষা এবং আমদানি পরিপূরক শিল্প। লগ্নিকারীদের নজর রাখতে হচ্ছে রোজকার ঘটনায়। বড় তহবিল কেউ একলপ্তে লগ্নি করতে চাইছেন না। চোখ রয়েছে ভারতীয় পণ্যে আমেরিকা কতটা শুল্ক বসায়, তার উপরেও।
(মতামত ব্যক্তিগত)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)