Advertisement
E-Paper

‘ধন্যি মশাই আপনার চোখ’

তাঁর আগ্রহের জগৎ ছিল বহুমুখী, লেখার হাত ছিল চমৎকার। তথ্যের সাবেকি নথিখানার প্রতি যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনই প্রয়োজনে তথ্যের জন্য ঘুরতেন নানা অলিগলিতে।

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
মগজাস্ত্র: তথ্যে ফাঁক রাখতেন না সিদ্ধার্থ ঘোষ। ছবি বই থেকে

মগজাস্ত্র: তথ্যে ফাঁক রাখতেন না সিদ্ধার্থ ঘোষ। ছবি বই থেকে

তাঁর আগ্রহের জগৎ ছিল বহুমুখী, লেখার হাত ছিল চমৎকার। তথ্যের সাবেকি নথিখানার প্রতি যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনই প্রয়োজনে তথ্যের জন্য ঘুরতেন নানা অলিগলিতে। নথিখানার সীমা এই সব অচেনা অলিগলিতে পায়চারির ফলে বিস্তৃত হত। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূত, গোয়েন্দা, বিজ্ঞান, কারিগরির রসদদার সিদ্ধার্থ ঘোষ যেমন বড়দের জন্য কলম ধরতেন, তেমন ছোটদেরও মনোরঞ্জন করতেন। রায়বাড়ির প্রতি টানটি ছিল খাঁটি— উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিতে তিনি মজেছিলেন। সাহিত্য সংস্কৃতিকে পড়া ও শোনার বহরে আটকে রাখলেই যে কেবল হবে না, প্রয়োজনে ছেলে-মেয়েদের জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতি ছেনে নানা মজাদার ঘরোয়া খেলা বানিয়ে তোলা চাই এ কথায় বিশ্বাস করতেন। এমন রংদার খেলা বানিয়ে তুললে ছেলে-মেয়েরা যোগ দিতে পারবে। পড়া-শোনার সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিসরে হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে যোগ দেওয়ার অবকাশ থাকলে সাহিত্য-সংস্কৃতি সজীব হয়ে ওঠে। সিদ্ধার্থ ঘোষের ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র প্রবন্ধগুলি দুই মলাটের মধ্যে ধরে প্রবন্ধ সংগ্রহের যে সুসম্পাদিত প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে তার পাতা ওল্টালে প্রথমেই এই কথাগুলি মনে হয়।

সাতটি গুচ্ছে ভাগ করা এই বইয়ের প্রথম তিনটি গুচ্ছ রায়বাড়ির প্রতি নিবেদিত। সত্যজিৎ উপেন্দ্রকিশোরকে বিজ্ঞানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ ছবি ছাপার কলকৌশলের জগতে উপেন্দ্রকিশোরের মৌলিক অবদানের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন, তাঁর আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি কী ভাবে সত্যজিতের মনে ছাপ ফেলেছিল তা নিয়ে কথা সাজিয়েছেন, ইউ রায় এন্ড সন্স নামে যে ছাপাখানা তাঁর হাতে গড়ে উঠেছিল তার পরিণতি কী হল তা নিয়ে তথ্য বুনেছেন। জানিয়েছেন মুদ্রণশিল্পের প্রতি যে মনোযোগ উপেন্দ্রকিশোর প্রদর্শন করেছিলেন তা সুকুমার ও সত্যজিতের মধ্যে পরম্পরাবাহিত। মুদ্রণের বিজ্ঞান ও মুদ্রণের নান্দনিকতা দুয়ের প্রতিই তাঁদের অভিনিবেশ ছিল। প্রাবন্ধিক হিসেবে সিদ্ধার্থ তথ্যে ফাঁক রাখতেন না, তথ্যপঞ্জির উপর ভর করে বিশ্লেষণ নির্ভর সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। সুকুমার রায় শীর্ষক গুচ্ছের পাঁচটি লেখায় প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর এই বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। সদাহাস্যময় লালমোহনবাবু হয়তো বলে উঠতেন ‘ধন্যি মশাই আপনার চোখ।’ সত্যজিতের লেখায় আছে নানা পুরনো গাড়ির কথা, ছায়াছবিতে আছে ভিনটেজ গাড়ি। সেই সব প্রসঙ্গ ছুঁয়ে কলকাতার গাড়িওয়ালাদের জগতে ঢুকে পড়েন প্রাবন্ধিক। চারুলতার হাতে কেন অপেরা গ্লাস, সেই অপেরা গ্লাস মানানসই কি না এ জিজ্ঞাসার সঙ্গে পথ চলেন সিদ্ধার্থ।

প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ / সিদ্ধার্থ ঘোষ

সম্পাদক: কৌশিক মজুমদার দেবজ্যোতি গুহ সৌম্যেন পাল

মূল্য: ৩৫০.০০

প্রকাশক: বুকফার্ম

বইয়ের চতুর্থ গুচ্ছ ‘ভূত, গোয়েন্দা ইত্যাদি’ বিষয়ক। সেখানে বঙ্গভূতের পুরাণ লিখেছেন, ঘনাদার বিচিত্র বিশ্বপরিক্রমার কথা এনেছেন তেমনই কল্পনায় নির্মাণ করেছেন ফেলুদার নামে এক গ্যালারি। আহা সত্যি যদি এমন গ্যালারি থাকত! ফেলুদার যাবতীয় কাজের জিনিস, তাঁর গপ্পে আছে এমন নানা জিনিসপত্র নানা ক্যাবিনেটে প্রদর্শিত। দর্শক চোখ ফেরাতে পারছেন না।

শেষ তিনটি গুচ্ছের বিষয় যথাক্রমে ‘পত্রপত্রিকার কথা’, ‘বিজ্ঞান-কল্পবিজ্ঞান’, ‘খেলাধুলা’। পত্রপত্রিকা অংশে ‘রংমশাল’ লেখাটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধার্থের ‘কল্পবিজ্ঞানের রাগ-রাগিনী’ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল গল্পপত্রে। তবে ‘সায়েন্স ফিকশন’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ সিদ্ধার্থ ‘এক্ষণ’ পত্রিকার ১৩৯৫ শারদ সংখ্যায় লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধটি ধারে ও ভারে এই গ্রন্থে সংকলিত লেখার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘খেলাধুলা’ অংশে বাঙালির ঘরের খেলা নিয়ে যেমন তথ্যবহুল লেখা আছে, তেমনই রয়েছে সিদ্ধার্থ ঘোষ সন্দীপ রায় পরিকল্পিত হ য ব র ল লুডো, সিদ্ধার্থ ঘোষ, শঙ্কর ঘটক ও সত্যেন দত্ত পরিকল্পিত পিরিঅডিক গেম।

সিদ্ধার্থ ঘোষের এই প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে বোঝা যায় তিনি বাঙালিয়ানার মেধাবী সজীব একটি রূপের প্রতি আস্থাশীল ও সেই রূপটি যাতে পরম্পরায় বাহিত হতে পারে সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। এই প্রয়াসের সঙ্গে কেবল তাঁর মেধা নয়, আবেগও মিশে গিয়েছিল। প্রবন্ধ যে কেবল নির্বিচার তথ্যের সংকলন নয়, সৃজনশীল শিল্প তা সিদ্ধার্থের লেখা সব সময়েই প্রমাণ করত। এ বইয়ের গোড়াতে সিদ্ধার্থের বন্ধু প্রসাদরঞ্জন রায় যে ‘টুকরো কথা, ছেঁড়া স্মৃতি’ লিখেছেন তা পড়লে মন কেমন করে। প্রসাদরঞ্জন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্টে অমিতাভ ঘোষের বন্ধু ছিলেন, কালক্রমে সেই অমিতাভই লেখক সিদ্ধার্থ। যাদবপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নকশাল করা ছাত্র অমিতাভ বোহেমিয়ান আবার নিপুণ গবেষকও। প্রসাদরঞ্জন আর অমিতাভ শনিবার বিকেলে কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান এক সময় নিয়মিত তন্ন তন্ন করে খুঁজতেন হারিয়ে যাওয়া বাঙালির নানা সময়কে ধরে রাখার জন্য। অবশ্য সংগ্রাহক ও গবেষকের পাশাপাশি যে নিঃসঙ্গ মানুষটি ছিল সে-ই শেষ পর্যন্ত সমাজ সংসারের মায়া কাটিয়ে একা একা অকালে চলে যাওয়াই স্থির করে নিয়েছিল। অমিতাভ সিদ্ধার্থের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলি দুই মলাটে যত্ন করে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নবীন প্রকাশনা সংস্থা বুক ফার্ম বাঙালির কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন।

বিশ্বজিৎ রায়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy