Advertisement
E-Paper

অতীতের আলোয় উদ্ভাসিত যখন বর্তমান

মায়া আর্ট স্পেসে অনুষ্ঠিত ‘ডার্ক লাইনস’ প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।সনাতন দিন্দা তাঁর ড্রয়িং-এর মধ্য দিয়ে মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে নিহিত অন্ধকারকে বুঝতে চেয়েছেন। মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘ডার্ক লাইনস’। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০১

সনাতন দিন্দা তাঁর ড্রয়িং-এর মধ্য দিয়ে মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে নিহিত অন্ধকারকে বুঝতে চেয়েছেন। মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘ডার্ক লাইনস’। এ অন্ধকার চারকোল মাধ্যমের প্রকরণগত কালিমা শুধু নয়। তার চেয়ে অনেক করুণতর কিছু। এই রৈখিক প্রতিমাপুঞ্জের পাশে পাশে শিল্পী তাঁর ভাবনাকে অক্ষর ও শব্দেও সংবদ্ধ করেছেন। তাতে তাঁর চিন্তার দু-একটি স্ফুলিঙ্গও বিচ্ছুরিত হয়েছে। যেমন এক জায়গায় তিনি লিখছেন ‘আমরা দুইয়ে নিচ্ছি লোভ, লালসা, রির‌ংসা। এ পৃথিবী যন্ত্রমায়ায় আবদ্ধ। ... দুইয়ে নিচ্ছি সভ্যতার সম্ভাবনা।’ গহন এক অন্ধতা চারপাশে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। শিল্পী তাঁর দর্শককে মনে করিয়ে দেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবাদপ্রতিম এই লাইনটি : ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ তাঁর শব্দপ্রতিমার গঠনরীতিও লক্ষণীয়। প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির পাশে পাশে এবং স্মারকগ্রন্থের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে আছে তা। এই কাটা কাটা ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ চয়ন, ‘এই অন্তর্মুখীন অথচ খোলামেলা চারণ’ – একেই তিনি বলেছেন তাঁর ‘ডিসকোর্স’। তাঁর চিত্র-আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের কিছু ইঙ্গিত থাকে এই শব্দচয়নের মধ্যেও।

বাস্তবের বিপন্ন ক্লিষ্টতার পাশাপাশি সনাতন তাঁর সৃজনে পুরাণকল্পের কিছু অনুষঙ্গও আনেন। অতীতের আলোটুকুর পাশে সংস্থাপিত হয় সাম্প্রতিকের তমসা। এই ড্রয়িংগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরাণকল্প নেই। এগুলি অনেকটা তাঁর ব্যক্তিগত আত্মকথনের মতো, অনুশীলনমূলক ড্রয়িং সাধারণত যা হয়ে থাকে। এই আত্মকথনের মধ্য দিয়েই অনেক সময় ধরা পড়ে শিল্পীর মগ্নচেতনার নানা ছায়া-প্রচ্ছায়া। মানবীর আত্মগত যন্ত্রণার স্তব্ধ হাহাকার দৃশ্যরূপ পেয়েছে একের পর এক রচনায়, যা প্রকারান্তরে হয়ে উঠেছে এই সময়েরই অন্তর্লীন তমসার প্রতীক।

সনাতন ১৯৯০–এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। ১৯৯২–তে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে চিত্রকলায় স্নাতকশিক্ষা শেষ করেন। তারপর থেকে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। আলোচ্য প্রদর্শনীটি তাঁর নবম একক। তাঁর প্রথম একক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। চিত্র, ভাস্কর্য ও ইনস্টলেশন— ইত্যাদি নানা মাধ্যমে তিনি কাজ করেন। ইদানীং শারদোৎসবে তাঁর মণ্ডপ ও প্রতিমা ভিত্তিক ইনস্টলেশনগুলিও দৃশ্যকলার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। অনেক সময় তাঁর কাজে একটু অতিনাটকীয়তা এসে যায়। ‘মেলোড্রামা’ শিল্পের একটি বিশেষ রূপ হতে পারে যদি তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যায়। সনাতন অনেক সময় তা পারেন। এই ড্রয়িংগুলো সেই অতিকথন-প্রবণতা থেকে মুক্ত। ১৯৯০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের প্রকাশে দুটি প্রবণতা পাশাপাশি কাজ করে। পোস্ট-মডার্ন ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদী চেতনাকে ব্যক্ত করেন অনেক শিল্পী।

এর বাইরে কিছু শিল্পী আছেন যারা ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী প্রবহমান পরম্পরাতেই কাজ করে যাচ্ছেন। সনাতনের কাজে এই দুই ধারার এক ধরণের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। এর মধ্য দিয়েই তিনি নিজস্ব রূপরীতি তৈরি করেছেন। তাঁর এই ড্রয়িংগুলির মূল প্রবণতা অবশ্য প্রবহমান পরম্পরার দিকেই, যদিও এগুলি জারিত হয়েছে সাম্প্রতিকের সন্ত্রাসবিধ্বস্ত ভাঙা-বিশ্বের তমসাকে আত্মস্থ করেই।

একটি চারকোল-ড্রয়িং-এ তিনি রূপ দেন শায়িতা এক নারীকে। নিঃসাড়ে শুয়ে থাকে সে। মাথাটি এলিয়ে পড়েছে শয্যার উপর থেকে। বিস্রস্ত কেশরাশি শূন্যে ঝুলে আছে। তাঁর শরীরের উপর এবং চুলে ছড়িয়ে আছে কিছু ঝরা পাতা। আলো-ছায়ার দ্যোতনার মধ্য দিয়ে ঘুমন্ত মানবী-শরীর গড়ে ওঠে যেখানে, সেই নগ্নতায় শিল্পী সঞ্চারিত করেন অমোঘ এক প্রতিকারহীন শূন্যতা, যে শূন্যতা এই সময়েরই অনিবার্য পরিণতি।

পুরাণকল্পমূলক প্রতিমা ব্যবহৃত হয়েছে দুএকটি রচনায়। একটি রচনায় দেখা যাচ্ছে বহু সন্তান বিশিষ্ট এক মানবী গাভীর শরীর নিয়ে দণ্ডায়মান। বোতলে বোতলে দুগ্ধ নিষ্কাশিত হচ্ছে তার স্তন থেকে। কামধেনুর এই প্রতিমাকল্পকে ঘিরেই মৃত্যুর কালো ছায়া ছড়িয়ে আছে। এরকমই আলো-আঁধারের বিপন্ন জগৎকে পরতে পরতে উদ্ভাসিত করেছেন শিল্পী।

mrinal ghosh abp sculpture review abp painting review sonatan dinda charcole art
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy