E-Paper

পরাধীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা

ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রবর্তন এবং শিক্ষিত ভারতীয়দের দ্বারা তা গ্রহণ ও অনুসরণ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

অচিন্ত্য কুমার দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২৭

বিজ্ঞানের আবার ইতিহাস কী? এ প্রশ্ন এক সময় কিছু সনাতনপন্থী ইতিহাসবিদের কাছ থেকে শোনা যেত। যে সব গবেষক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় নিমগ্ন থাকতেন, তাঁরা এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কিছুটা বিব্রত বোধ করতেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস-চর্চা এখন সমাদৃত।

ঔপনিবেশিক ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাস তুলে ধরা এবং ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এস এন সেন, সৎপাল সাঙ্গোয়ান, অরুণ কুমার বিশ্বাস, দীপক কুমার এবং আরও অনেকের প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা ও অবদান স্মরণীয়। বিগত তিন-চার দশকে এ বিষয়ে অনেক চিত্তাকর্ষক গবেষণালব্ধ পুস্তক ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সাহারা আহমেদ ও সুভোব্রত সরকার সম্পাদিত গ্রন্থটি ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাসে আর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রবর্তন এবং শিক্ষিত ভারতীয়দের দ্বারা তা গ্রহণ ও অনুসরণ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর ফলে প্রাক্‌-উপনিবেশিক সনাতনী বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাক্ষাৎ হয়। পরিণতিস্বরূপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের উদ্ভব হল। আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আধিপত্য ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হল এবং প্রাচ্যের তথাকথিত প্রাগাধুনিক বিজ্ঞান-চর্চার ধারা অকিঞ্চিৎকর বলে গণ্য হল। যা-ই হোক, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত ভারতীয়রা এই নতুন জ্ঞান শুধু গ্রহণ ও আত্মস্থই করেননি, এর সৃষ্টি এবং সঞ্চারেও তাঁরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞান-চর্চা ও গবেষণায় তাঁদের সৃজনশীল কর্মক্ষমতা প্রতিভাসিত হয়। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রতিভাশালী ব্যক্তির বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব তার উজ্জ্বল নিদর্শন। আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে পরাধীন দেশের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি এই বইটিতে পরিবেশিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে ‘ডিকলোনাইজ়েশন’-এর ব্যাখ্যা সহযোগে উপনিবেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের তাৎপর্যকে সম্পাদকদ্বয় ভূমিকায় সুন্দর ভাবে চিত্রিত করেছেন। বিজ্ঞান-চর্চায় ‘মডার্নিটি’কেন্দ্রিক বিতর্কের কয়েকটি দিকও আলোচিত হয়েছে।

এই গ্রন্থের লেখাগুলি দক্ষিণ এশিয়ার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছে, যেখানে ‘মডার্নিটি’ ও ‘ডিকলোনাইজ়েশন’-এর অনুসন্ধান প্রস্ফুটিত। আধুনিক ভারতের রূপায়ণে বিজ্ঞানের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত নানা তত্ত্বেরও মূল্যায়নের প্রচেষ্টা হয়েছে এই প্রবন্ধগুলিতে।

ডিকোলোনাইজ়িং সায়েন্স অ্যান্ড মডার্নিটি ইন সাউথ এশিয়া: কোয়েশ্চেনিং কনসেপ্টস, কনস্ট্রাক্টিং হিস্ট্রিজ়

সম্পা: সাহারা আহমেদ ও সুভোব্রত সরকার

১১৯.৯৯

ইউরো স্প্রিঙ্গার

এই গ্রন্থে ১৫টি আকর্ষণীয় প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং সেগুলিকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এখানে সব ক’টি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই, তবে পুরোটা মিলিয়ে পড়ে কিছু কথা বলা জরুরি। ভারতে সনাতনী গণিত-বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠশালায় শুভঙ্করী শিক্ষা-চর্চার একটা পারম্পর্য ছিল। মোগল ও ইংরেজ আমলে এটি বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের গণিত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন শান্তনু চক্রবর্তী। কমলেশ মোহন দেখিয়েছেন, কী ভাবে রুচিরাম সাহনী-সহ কয়েকজন প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী পঞ্জাবে বিজ্ঞান-চর্চার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং মানুষকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উত্তর ভারতে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে দেশীয় ভাষায়, মূলত হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে কোন পথে বিজ্ঞান চর্চার বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস হয়েছিল, তার উপর আলোকপাত করেছেন সন্দীপন বক্সী।

পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতের দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেকত্ব বা বহুত্ব লক্ষণীয়। আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও লোক-চিকিৎসা— এই তিনটি দেশীয় চিকিৎসাবিদ্যার মুখ্য বৈশিষ্ট্য, তাদের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা এবং পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির একচ্ছত্র আধিপত্যের সম্মুখে তাদের অস্তিত্ব ও বিকাশ বজায় রাখার ক্রিয়াকলাপের উপর আলোচনা করেছেন যথাক্রমে সৌরভ কুমার রাই, নিশত কায়সার এবং রূপকুমার বর্মণ। রূপকুমার কর্তৃক হিমালয় সন্নিহিত বাংলার কিছু স্থানে রাজবংশী জাতিভুক্ত মানুষের লোক-চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনুসন্ধানের আলোয় নিয়ে আসার প্রয়াস প্রশংসনীয়।

গ্রন্থের তৃতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সুভোব্রত সরকার, সাহারা আহমেদ ও দীনেশ শর্মার প্রবন্ধ। তাঁরা যথাক্রমে ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং, দাঁতের আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি এবং কলকাতায় আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের বিকাশ, এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো নতুন বিদ্যা-চর্চার ক্ষেত্রগুলি উনিশ ও বিশ শতকে কী ভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করল এবং এগুলি পেশার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে জেগে উঠল— তা নিয়ে চর্চা করেছেন।

চতুর্থ ভাগে ভি ভি কৃষ্ণা, অর্ণব রায় চৌধুরী এবং দীপান্বিতা দাশগুপ্তের প্রবন্ধত্রয় থেকে জানা যায়, কী ভাবে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ঔপনিবেশিক শাসনের নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েও বিজ্ঞান-চর্চায় তাঁদের প্রতিভা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের সম্প্রসারণে তথা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক দল ভারতীয় বিজ্ঞানীর উদ্ভব এবং বিকাশ কী ভাবে হল, সে আলোচনাও এই প্রবন্ধগুলিতে স্থান পেয়েছে। তাঁরা কী ভাবে বহিঃপ্রান্তের বিজ্ঞানী থেকে বিশ্বের বিজ্ঞান-চর্চার মূলধারায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন, সে কথাও এখানে ফুটে উঠেছে।

পঞ্চম তথা শেষ ভাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে স্কটিশ জীববিজ্ঞানী প্যাট্রিক গেডেস এবং ভারতীয় পদার্থ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সম্পর্কের কথা এবং পারস্পরিক প্রভাবের বিষয়টি পরীক্ষা করেছেন শিব বিশ্বনাথন। সেই সঙ্গে নানা বিষয়ে ঠাকুর-গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের কথাও তুলে ধরেছেন। বিশ শতকের শুরু থেকে আধুনিকতা ও বৃহৎ শিল্পপ্রধান সমাজব্যবস্থার সমালোচনার প্রসঙ্গে, পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন ধ্রুব রায়না। পশ্চিমের পুঁজিবাদ কেন্দ্রিক শোষণমূলক সভ্যতার প্রতি মনোভাব এবং সমসাময়িক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গান্ধীজির প্রাসঙ্গিকতার কথাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাঁর প্রবন্ধে। শেষ প্রবন্ধে নির্মাল্যনারায়ণ চক্রবর্তী ‘মডার্নিটি’, দর্শন এবং বিজ্ঞানের উপর আলোকপাতের মাধ্যমে দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন। দর্শনের আঙ্গিকে ‘মডার্নিটি’কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এবং দর্শনের আলোয় বিজ্ঞানকে অনুধাবন করার কথা
তুলে ধরেছেন।

সামগ্রিক ভাবে লেখাগুলি বিজ্ঞানের ইতিহাস-চর্চার অনেক নতুন দিক উন্মোচন করেছে। সম্পাদকরা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ, এমন একটি ভাবনার জন্য। তবে কী ভাবে এই গ্রন্থের ধারণা জেগে উঠল এবং কেন ও কী ভাবে এই বিষয়টি নির্বাচিত হয়েছিল, সে বিষয়ে দু’-চার কথা শুরুতে বললে ভাল লাগত। দু’-একটি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে, সেগুলিও সম্ভবত এড়ানো যেত। সর্বোপরি, একটি নির্ঘণ্টের অনুপস্থিতি ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। নির্ঘণ্ট পাঠকদের নানা ভাবে সাহায্য করে এবং এটি গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy