Advertisement
E-Paper

স্বদেশ চেতনায় নতুন আলোর সন্ধান

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত চিত্রনিভা চৌধুরী-র একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষতাঁর নাম ছিল নিভাননী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবি দেখে খুশি হয়ে নাম দেন চিত্রনিভা। চিত্রনিভা চৌধুরী (১৯১৩-১৯৯৯) বাংলা তথা ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত নাম। নব্য-ভারতীয় চিত্রধারায় যে সব মানবী-শিল্পীর বিকাশ ঘটেছিল, তারই প্রধান একজন ছিলেন তিনি।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: চিত্রনিভা চৌধুরী।

শিল্পী: চিত্রনিভা চৌধুরী।

তাঁর নাম ছিল নিভাননী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবি দেখে খুশি হয়ে নাম দেন চিত্রনিভা। চিত্রনিভা চৌধুরী (১৯১৩-১৯৯৯) বাংলা তথা ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত নাম। নব্য-ভারতীয় চিত্রধারায় যে সব মানবী-শিল্পীর বিকাশ ঘটেছিল, তারই প্রধান একজন ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের প্রধান এক সম্পদ — রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য পেয়েছেন, যা তাঁকে শুধু শিল্পে নয়, জীবন ও সমাজ-ভাবনায়ও উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর পিতা ডা. ভগবানচন্দ্র বসুর আদি নিবাস ছিল ত্রিপুরার চাঁদপুর জেলায়। তাঁর যখন ছ’-সাত বয়স পিতা প্রয়াত হন। মা শরৎকুমারী দেবীর স্নেহে ও যত্নে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। ১৯২৭ সালে তাঁর বিবাহ হয় নোয়াখালির নিরঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে। ছবি আঁকায় তাঁর আগ্রহ ও নৈপুণ্য ছিল শিশুকাল থেকেই। স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির অভিভাবকদের উৎসাহেই তাঁকে কলাভবনে ভর্তি করা হয় ১৯২৮ সালে।

আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা শিখেছেন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিখেছেন গান। ছাত্রী অবস্থায় বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সাহচর্যও পেয়েছেন। আর সবার উপরে রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ দৃষ্টি তো ছিলই। রবীন্দ্রনাথই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন নিকটবর্তী সাঁওতাল পল্লিতে গিয়ে মেয়েদের লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখাতে। শিক্ষা শেষে ১৯৩৩ সালে কলাভবনেই শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। তিনিই ছিলেন কলাভবনের প্রথম মহিলা অধ্যাপিকা। এতগুলি গৌরবের সমন্বয় তখনকার দিনে খুব কম মানবীর জীবনেই ঘটেছে।

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁর সারা জীবনের কাজের নির্বাচিত কিছু অংশ নিয়ে প্রদর্শনী। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁর সুযোগ্যা কন্যা প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরী। তাঁর সব ধরনের ছবিরই কিছু কিছু নমুনা এই প্রদর্শনীতে ছিল। নিসর্গ-রচনা, ফুলের ছবি, শান্তিনিকেতনের জীবন ও পরিবেশ আর ছিল অজস্র মুখাবয়ব রচনা।

রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য ও শান্তিনিকেতনের দিনগুলি নিয়ে চিত্রনিভা একটি স্মৃতিকথা লেখেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য চারুকলা পর্ষদ থেকে সেটি বই হয়ে বেরিয়েছে। এই বইতে তাঁকে উপহার দেওয়া রবীন্দ্রনাথের নিজের আঁকা একটি ছবি আমরা দেখতে পাই। ছবিটি ৭ পৌষ ১৩৩৬ সালে আঁকা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের ছবিগুলির অন্যতম। ছবিটির বিষয় ‘একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন’। এই ছবিটি আগে আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি।

সে আমলে শান্তিনিকেতনে চিত্রনিভার সমসাময়িক বা একটু পূর্ববর্তী মানবী-শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন প্রতিমা ঠাকুর, শান্তা দেবী, রাণী চন্দ, গৌরী ভঞ্জ প্রমুখ। শান্তিনিকেতন উদ্ভূত নব্য-ভারতীয় ঘরানার পরিমণ্ডলে হলেও প্রত্যেকেরই প্রকাশভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। চিত্রনিভার ছবির বৈশিষ্ট্য — তিনি পৌরাণিক বিষয় বা দেবদেবীর ছবি এঁকেছেন কম। ‘একলব্য’ শিরোনামে একটি ছবি অবশ্য দেখা গেছে, কিন্তু তাতেও জোর পড়েছে নিসর্গের উপরই। তাঁর ছিল নিসর্গ-মুগ্ধতা।

নিসর্গই তাঁর ছবিতে এসেছে বেশি। শান্তিনিকেতনের সেই সময়ের ভাবধারা যে তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, এ থেকে তা বোঝা যায়। তাঁর কোনও ছবিতে নন্দলালের প্রভাব আছে যেমন ‘বসন্ত উৎসব’-এর ছবিটি। কিন্তু একে অতিক্রম করে নিজস্ব ভাব ও শৈলীর প্রতিষ্ঠা তিনি করতে পেরেছিলেন। এর বিশেষ পরিচয় ধরা থাকে তাঁর ফুলের ছবিগুলিতে। চালতা ফুলের একটি ছবি আজও আমাদের মুগ্ধ করে। এ ছাড়া কদম, পলাশ, রাধাচূড়া, লাউ ইত্যাদি কত না ফুলের ছবি তিনি এঁকেছেন। বর্ণের কোমল, সংবৃত প্রয়োগে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে তাতে।তাঁর মুখাবয়ব-চিত্রের ভাণ্ডারটিও অসামান্য সমৃদ্ধ। স্বাভাবিকতাবাদী রীতিতে নব্য-ভারতীয় ঘরানার বিশেষ একটি ঝোঁক ছিল, যা পাশ্চাত্য স্বাভাবিকতাবাদ থেকে একেবারেই আলাদা।

এই ধারাটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন চিত্রনিভা। কত না বিখ্যাত মানুষের মুখাবয়ব তিনি এঁকেছেন! আর তাঁদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। স্বদেশচেতনার আঙ্গিকের মধ্যে নতুন আলোর সন্ধান করেছেন এই শিল্পী।

Chitranibha Chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy