Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

পিছন ফিরে তাকানো জরুরি

গ্রন্থের শেষ ভাগে মূল অধ্যায়গুলির পরে কন্যা অতসী বড়ুয়ার সঙ্গে পিতা অসিতকুমারের পত্রালাপের একটি অংশ সংযোজিত হয়েছে। এটি বইয়ের অত্যন্ত মূল্যবান অংশ— যেখানে উন্মোচিত হয়েছে অসিতকুমারের শিল্পীসত্তার নিভৃত অন্দরমহল।

ঐতিহাসিক: ইলাহাবাদ দুর্গ নির্মাণ দর্শনে সম্রাট আকবর। শিল্পী অসিতকুমার হালদার, ইলাহাবাদ সংগ্রহশালা। ছবি বই থেকে

ঐতিহাসিক: ইলাহাবাদ দুর্গ নির্মাণ দর্শনে সম্রাট আকবর। শিল্পী অসিতকুমার হালদার, ইলাহাবাদ সংগ্রহশালা। ছবি বই থেকে

সুশোভন অধিকারী
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রঙের কবি অসিতকুমার হালদার

লেখক: গৌতম হালদার

মূল্য: ৫০০.০০

প্রকাশক: সিগনেট প্রেস

গুরু অবনীন্দ্রনাথের কৃতী ছাত্রদের প্রসঙ্গ উঠলে নন্দলালের সঙ্গে সহজেই এসে পড়ে অসিতকুমার হালদারের নাম। অবন ঠাকুর প্রবর্তিত নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারায় এই শিল্পীদ্বয়ের ভূমিকা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। আধুনিক ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে আচার্য নন্দলালের আলোকবৃত্তের পাশাপাশি অসিতকুমারের অবদানের কথা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে নন্দলাল কলকাতা থেকে এসে কলাভবনে যোগ দিয়ে আমৃত্যু কবির আশ্রমেই রয়ে গিয়েছিলেন। অসিতের চিত্রীজীবনের অভিমুখ অনেকটা নন্দলালের বিপরীত পথে চালিত। প্রথম জীবনে অসিত ছিলেন শান্তিনিকেতনে, নন্দলাল কলাভবনে যোগদানের আগে তিনিই অলংকৃত করেছেন কবির শিল্পনিকেতনের অধ্যক্ষের পদ। অবশ্য অব্যবহিত পরে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। বিলেত থেকে ফিরে কাজের সূত্রে প্রথমে জয়পুর আর্ট কলেজ ও পরে থিতু হয়েছেন লখনউ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। খেয়াল করলে দেখি, বিশ শতকের বিশের দশকের গোড়া থেকে অসিতকুমারের জীবন কেটেছে প্রবাসী বাঙালির মতো। হয়তো সেই কারণে তাঁর শিল্পীজীবনের অনুপুঙ্খ ঘটনার সঙ্গে আমাদের তেমন সুস্পষ্ট পরিচয় ছিল না— অথচ যা ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের পক্ষে জরুরি অধ্যায়। শিল্পীর ভ্রাতুষ্পুত্র গৌতম হালদারের লেখা আলোচ্য বইটি সেই অভাব পূর্ণ করেছে। লেখক অত্যন্ত যত্নে, পরম মমতায়, পটভূমির বিস্তারে রচনা করেছেন শিল্পীর প্রামাণিক জীবনালেখ্য— যা কেবল শিল্পরসিক নয় সাধারণ পাঠকের কাছেও মূল্যবান। গ্রন্থকার শিল্পী-পরিবারের সদস্য হওয়ায় তা শিল্পীর জীবনের উপাদান অনুসন্ধানে নিশ্চয়ই সহায়ক হয়েছে। লেখক বইটিতে বেশ বিস্তারিত পরিসরে প্রায় পঁচিশটি পর্বে তাঁর সমগ্র পরিকল্পনার বিন্যাস ঘটিয়েছেন। শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, ভারতীয় চিত্রকলার প্রসারে জেমস কাজিন্সের ভূমিকা, শিল্পী নিকোলাস রোয়েরিখের প্রসঙ্গ, কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোর ডিজাইন সেন্টারে অসিতকুমারের অভিজ্ঞতার কথা ইত্যাদি। জন্মসূত্রে অসিতকুমার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুপ্রভাদেবীর পুত্র। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই তাঁর জন্ম, শৈশবকাল থেকে এখানকার শিল্পসংস্কৃতির প্রাণময় পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। পরবর্তী কালে শিল্পের পাঠগ্রহণ পর্বে হ্যাভেল, লেনার্ড জেনিংস ও সর্বোপরি অবনীন্দ্রনাথের কাছে শিল্প চর্চার অধ্যায়টি সুচিন্তিত রচনা। শুধু তাই নয়, নিবেদিতার প্রচেষ্টায় লেডি হেরিংহ্যামের নেতৃত্বে নন্দলাল ও অসিতের অজন্তা-চিত্রমালার অনুলিপি তৈরির পর্ব ও কুমারস্বামী-রদেনস্টাইন ইত্যাদি পর্ব ছাড়াও কলাভবন-শান্তিনিকেতনের অংশটি রসিক পাঠকের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। এ কথাও স্বীকার করতে হয় যে, অসিতকুমার নিজে একজন সুলেখক, শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর অজস্র লেখা, অসাধারণ স্মৃতিকথা ও নানান অভিজ্ঞতা তিনি রচনা করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কলমে একাধিক বার তাঁর লেখার সপ্রশংস উল্লেখ পাওয়া যায়, শিল্প-আলোচক জেমস কাজিন্স তাঁকে ‘রঙের কবি’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যা থেকে বইটির নামকরণ। হিসেব করলে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ত্রিশটির বেশি বই ও পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত পঞ্চাশটির অধিক রচনা ‘লিখিয়ে অসিতকুমারের’ উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিসেবে গণ্য হবে। সেগুলি নানা ভাবে বর্তমান বইটির নির্মাণে গ্রন্থকারকে প্রভূত সহায়তা করেছে। আর তিনিও অকৃপণ হাতে অসিতকুমারের লেখার উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বইটিকে স্বাদু করে তুলেছেন।

গ্রন্থের শেষ ভাগে মূল অধ্যায়গুলির পরে কন্যা অতসী বড়ুয়ার সঙ্গে পিতা অসিতকুমারের পত্রালাপের একটি অংশ সংযোজিত হয়েছে। এটি বইয়ের অত্যন্ত মূল্যবান অংশ— যেখানে উন্মোচিত হয়েছে অসিতকুমারের শিল্পীসত্তার নিভৃত অন্দরমহল। তাঁর ব্যক্তিজীবনের আনন্দ, বেদনা আর একাকীত্বের চাপা সুরে গাঁথা এই আলোছায়ার পর্বে পাঠক যেন শিল্পীকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। যদিও এগুলির কোনওটি সম্পূর্ণ চিঠি নয়— মুদ্রিত হয়েছে পত্রের প্রয়োজনীয় টুকরোমাত্র, লেখকের ভাষায় ‘আপাত অসংলগ্ন অংশবিশেষ’। তবে সময়ের ক্রম হিসেবে সজ্জিত হওয়ায় ১৯৪৭-১৯৬৪-র পরিসরে অসিতকুমারের মানসিক রেখাচিত্রটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয়, পত্রলেখক এবং প্রাপকের সম্পূর্ণ পত্রালাপটি মুদ্রিত হলে অনুসন্ধানী পাঠক হয়তো আরও উপকৃত হতেন। বইয়ের শেষ ভাগে বংশতালিকা সহ পাঁচটি পরিশিষ্ট সংযুক্ত, সেগুলিও চিঠি ও স্মৃতিলেখা। সেখানে আছে পিতা সুকুমার হালদারকে লেখা সি এফ অ্যানড্রুজের চিঠি, অসিতকুমারকে লিখিত রদেনস্টাইনের পত্র, আনা পাভলোভার চিঠি, শিষ্যকে লেখা গুরু অবনীন্দ্রনাথের চিঠি এবং কন্যা অতসী বড়ুয়া লিখিত পিতার স্মৃতিকথা। এ ছাড়াও রয়েছে শিল্পীর কালানুক্রমিক চিত্রপঞ্জি, রচিত গ্রন্থ ও অন্যান্য রচনার তালিকা। এগুলি বাদে নির্দেশিকা ও সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি তো আছেই। আর আছে নানান সময়পটে অসিতকুমারের অনেকগুলি ফোটোগ্রাফ ও শিল্পীর আঁকা কয়েকটি ছবির সুমুদ্রিত প্রতিলিপি। গ্রন্থে প্রকাশিত অসিতকুমারের মিনিয়েচারধর্মী চিত্রমালার স্পর্শ-অনুভূতিময় রেখাঙ্কন ও চিত্রীর কোমল কালার-প্যালেট যথাযথ ভাবে মুদ্রিত না হলে ছবিগুলির অমর্যাদা হত— যা এখানে বইটিকে বিশেষ মান্যতা দিয়েছে। শিল্পী অসিতকুমার বিষয়ে এটি একটি জরুরি ও সময়োপযোগী গ্রন্থ। পাশাপাশি সাম্প্রতিক শিল্পপ্রেক্ষাপটের দিকে চোখ মেলে মনে হয়, বোধহয় আমাদের আর এক বার একটু পিছন ফিরে তাকানোর সময় এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE