Advertisement
E-Paper

জয় এল আঁতে ঘা দিয়েই

সাল ২০১৬। লাচিতের ‘স্বাভিমান’ ও আর এক অহমিয়া নায়ক সর্বানন্দ সোনোয়ালকে সামনে রেখে একদা মুঘল অধ্যুষিত হিন্দি বলয়ের শাহ-মোদী বাহিনী জয় করলেন অহম। যাকে তাঁরা নিজেরাই বলছেন ‘দ্য লাস্ট ব্যাটল অব সরাইঘাট’।

দেবব্রত ঠাকুর

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০২
রণকুশল: ডিব্রুগড়ে এক জনসভায় সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, অমিত শাহ ও সর্বানন্দ সোনোয়াল। নভেম্বর, ২০১৫

রণকুশল: ডিব্রুগড়ে এক জনসভায় সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, অমিত শাহ ও সর্বানন্দ সোনোয়াল। নভেম্বর, ২০১৫

সালটা ১৬৭১। দুয়ারে প্রায় অপ্রতিরোধ্য মুঘল বাহিনী। রাত পোহালেই যুদ্ধ শুরু। রাজপ্রাসাদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পদচারণায় রত উদ্বিগ্ন, চিন্তিত তাই-অহমরাজ চক্রধ্বজ সিংহ। সেনাবাহিনীর প্রথম সারির যোদ্ধাদের মুখ একের পর এক ভেসে আসছে তাঁর মনে। কাকে দেবেন এই যুদ্ধের ভার! কে পারবে তাই-অহমদের ‘স্বাধীনতা’ রক্ষা করতে! হঠাৎই টলে উঠলেন রাজা। কখন যে প্রাসাদ প্রান্তের সোপানের কিনারে পৌঁছে গিয়েছেন! কিন্তু তাঁর পতন রুখল দুই পেশিবহুল হাত। রাজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন সেই যোদ্ধাকে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে এই যোদ্ধাই হবেন তাঁর সেনাপতি। যোদ্ধার নাম লাচিত বড়ফুকন। নিজে শুধু যোদ্ধাই নন, ক্ষুরধার বুদ্ধি তাঁর। রণকুশলী। পরবর্তী ঘটনাবলি ইতিহাস। লাচিত বড়ফুকনের যুদ্ধকৌশলের কাছে ব্রহ্মপুত্রের বুকে, সরাইঘাটে পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হঠল মুঘল বাহিনী।

সরাইঘাট যুদ্ধের মহানায়ক লাচিত বড়ফুকন সেই থেকেই অহমিয়া স্বাভিমানের প্রতীক।

সাল ২০১৬। লাচিতের ‘স্বাভিমান’ ও আর এক অহমিয়া নায়ক সর্বানন্দ সোনোয়ালকে সামনে রেখে একদা মুঘল অধ্যুষিত হিন্দি বলয়ের শাহ-মোদী বাহিনী জয় করলেন অহম। যাকে তাঁরা নিজেরাই বলছেন ‘দ্য লাস্ট ব্যাটল অব সরাইঘাট’। এটাই শেষ যুদ্ধ কিনা তা বলার অধিকার যদিও ব্যক্তি বা দলবিশেষের নেই, বহমান কালই ভবিষ্যৎ ইতিহাসের রচনাকার। কিন্তু সেই বিতর্কে গিয়ে কোনও লাভ নেই। আপাতত আলোচনার উপজীব্য ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী ‘ব্যাকরুম বয়’ (এবং গার্ল) রজত শেঠি ও শুভ্রাস্থার লেখা বইটি।

দ্য লাস্ট ব্যাটল অব সরাইঘাট/ দ্য স্টোরি অব দ্য বিজেপি’স রাইজ় ইন দ্য নর্থ-ইস্ট রজত শেঠি ও শুভ্রাস্থা ৫৯৯.০০, পেঙ্গুইন বুকস

মুখবন্ধেই তাঁদের অসম বিজয়ের কাহিনির পিছনে দলের এবং সঙ্ঘের লক্ষ্য, রণকৌশল, এবং দীর্ঘ পরিকল্পনার ‘রুটম্যাপ’-এর খসড়া তৈরি করে দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রথম সারির নেতা, বর্তমানে বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। অসম নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন তিনিই। তাঁর কথায়, দিল্লি ও বিহারে উপর্যুপরি শোচনীয় পরাজয়ের পর বিজেপি এমনিতেই চাপের মুখে ছিল তখন। ২০১৬ সালে চার রাজ্যে বিধানসভা ভোট। অসম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও তামিলনাড়ু— কোনওটিতেই বিজেপির অস্তিত্ব তেমন ভাবে নেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অবশ্যই মোদীজির জনপ্রিয়তা আমাদের বড় অস্ত্র। কিন্তু সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক পরিস্থিতির কোনওটাই বিজেপির অনুকূলে ছিল না।’’ নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার কথা মুখে বললেও রাম মাধবের কথাতেই স্পষ্ট, তাঁর উপরেও তখন আস্থা রাখতে পারেনি বিজেপি।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিজেপির অসম বিজয়ের মূল কারণ হিসেবে রাম মাধব কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। এক) অসম গণ পরিষদ ও বড়ো পিপলস ফ্রন্টের সঙ্গে জোট। ২) নির্বাচনী প্রচারকে একেবারেই অসম-কেন্দ্রিক করে রাখা। জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় ইস্যুগুলিকে কোনও ভাবে প্রচারে না আনা, বা আসতে না দেওয়া। ৩) অসমের জনজাতীয় নেতা সর্বানন্দ সোনোয়ালকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনে লড়া। (কার্যত ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পর এই প্রথম বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর মুখকে সামনে রেখে লড়েনি।) ৪) জনপ্রিয় বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে দলে নেওয়া। রজতরা ভূমিকায় হিমন্তকে অসম তথা উত্তর-পূর্বের রাজনীতির ‘মাকিয়াভেলি’ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।

দীর্ঘ দিন ধরে সঙ্ঘের ড্রাফটিং কমিটির সদস্য হিসেবে রাম মাধব উত্তর-পূর্বের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একাধিক প্রস্তাব রচনা করেছেন আরএসএসের বিভিন্ন বৈঠকের জন্য। কাটাছেঁড়া করেছেন অসমের ইতিহাস। লাচিত বড়ফুকন থেকে অসম ছাত্র আন্দোলন, সবটাই তাঁর নখদর্পণে। অসম নির্বাচনের দায়িত্ব পেয়ে সে কারণেই প্রচারকে অসম-কেন্দ্রিক করার সিদ্ধান্ত।

সবে মাত্র ২০১১ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রাক্তন আসু তথা অগপ নেতা সর্বানন্দ সোনোয়ালকে, তাই-অহম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তথা দুঁদে রাজনীতিক তরুণ গগৈয়ের বিরুদ্ধে নির্বাচনের মুখ হিসেবে বেছে নেওয়ার পিছনেও কাজ করেছে এই হিসেব। ১৯৮৩ সালে শুধু অসমের জন্য সংসদে তৈরি হয় ইললিগ্যাল মাইগ্রান্টস (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইব্যুনাল) বা আইএমডিটি অ্যাক্ট। সেই আইনে কেউ বিদেশি কিনা তা প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায় অভিযোগকারী বা পুলিশের উপরেই। অথচ সারা দেশে বলবৎ ফরেনার্স অ্যাক্ট। সেখানে কেউ যে বিদেশি নয়, ভারতীয়, তা প্রমাণের দায় তারই। আসু নেতা সর্বানন্দ সোনোয়াল আইএমডিটি আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। শীর্ষ আদালত এই আইনকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়। অসমেও বলবৎ হয় ফরেনার্স অ্যাক্ট। তারই জেরে রাতারাতি অসমে ‘জাতীয় নায়ক’-এর মর্যাদা পান সর্বানন্দ। লাচিতের ‘অহমিয়া স্বাভিমান’-এর সেই ‘লিগ্যাসি’র উত্তরসূরি হয়ে দাঁড়ান তিনি। তাঁকে দলে নেওয়ার ৫ বছরের মাথায় তাঁকে সামনে রেখেই নির্বাচন লড়ার পিছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে দীর্ঘ পরিকল্পনা।

এর ইঙ্গিত মেলে ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জারি করে এক গেজেট নোটিফিকেশন। ‘পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) রুলস, ২০১৫’-তে বলা হয়, হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও পার্সি ধর্মাবলম্বী মানুষ যদি ধর্মীয় কারণে হেনস্থা বা হয়রান হয়ে ভারতে সে দেশের পাসপোর্ট-সহ কিংবা পাসপোর্ট ছাড়াই আসেন তবে তিনি ঢুকতে পারবেন। থাকতেও পারবেন। তাঁদের বিতাড়ন করা হবে না। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা এই ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে (বা না হয়েও) এ দেশে এসেছেন, তাঁরা সকলেই এই রক্ষাকবচের আওতায় পড়বেন। এই বিজ্ঞপ্তি জারির ছ’মাসের মধ্যে অসম নির্বাচন।

রাম মাধবের নেতৃত্বেই রজতরা নেতা নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রচারের রণকৌশল চূড়ান্ত করেছেন। ইতিহাস খুঁড়ে বের করেছেন নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবে, এমন সব তথ্য। স্বাভাবিক ভাবেই সব তথ্যই যে যথাযথ প্রেক্ষিতে, তা নয়। এব‌ং সেই সব তথ্য, ইতিহাসকে কাজে লাগিয়েই ঘুঁটি সাজিয়েছেন তাঁরা। তৈরি করেছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-সহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতা। বক্তব্যের মধ্যে মধ্যে সাজিয়ে দিয়েছেন কখনও লাচিত বড়ফুকন প্রসঙ্গ, কখনও আশির দশকের ছাত্র আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ।

তবে প্রচার, ভাষণ, ব্যানার, পোস্টারে ফিরে ফিরে এসেছে বিদেশি অনুপ্রবেশের কাহিনি। এর থেকে প্রাসঙ্গিক ও প্রধান ইস্যু তো অসমে আর কিছু নেই। বিজেপি ও সঙ্ঘের লক্ষ্যের সঙ্গে পেশাদার ম্যানেজারদের ‘স্কিল’ মিলেমিশে অনুপ্রবেশ সমস্যা অহমিয়া স্বাভিমানের আঁতে ঘা দিয়েছে। পাশাপাশি, হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের ‘শরণার্থীর’ মর্যাদা দিয়ে মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’দের আলাদা করে দেগে দেওয়া হয়েছে সঙ্ঘ ও বিজেপির নিজস্ব কর্মসূচি মেনেই। তবে সেটাও করা হয়েছে খুবই সূক্ষ্ম ভাবে, মুন্সিয়ানার সঙ্গে। এর পাশে তরুণ গগৈ উন্নয়নকে হাতিয়ার করে লড়াইয়ে এঁটেই উঠতে পারেননি। সেই সময় জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা বিজেপিকে জাতীয় ইস্যুতে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি কংগ্রেস।

আর বিজেপি তো এটাই চেয়েছিল। অনুপ্রবেশকে মূল হাতিয়ার করে অসমে ‘অনুপ্রবেশ’ করল বিজেপি। আর সেই কাজে ভগীরথের ভূমিকায় ছিলেন আসুর ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতা সর্বানন্দ সোনোয়াল ও হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী এনে সংসদে আনা বিলটি ‘হিন্দু শরণার্থী’ ও ‘মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’ এই রাজনীতিকে আরও দৃঢ় করেছে।

এই বই একটি প্রশ্ন রেখে যায়, বিজেপির ঘোষিত পরবর্তী লক্ষ্য কি এ বার ‘পলাশি’?

Book Book Review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy