প্রাচীন: লাসায় ঐতিহ্যবাহী পোতালা প্রাসাদ।
তিব্বতের পটভূমিতে এই উপন্যাসে চারটি খুন, দুই গুম্ফার ক্ষমতার লড়াই, সেখানে রাজপ্রাসাদের ইন্ধন, রাজকন্যার দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছোটানো এবং চিনা সেনাপতিদের সঙ্গে শরীরী খেলা, অলঙ্কারে লুকোনো গুপ্ত অস্ত্রের কথা আছে। আছে দুর্জ্ঞেয় নারী-মনস্তত্ত্ব। রাজার তিন নম্বর স্ত্রী বা ছোট রানিকে রাজকন্যা সহ্য করতে পারে না, শেষে তার উপলব্ধি অন্য। সে বোঝে, সমবয়সি ছোট রানি তাকে যত যত্নআত্তি করত, সে ততই হিংস্র হয়ে উঠত। পাশাপাশি গোপন বিপ্লবীরা ভাবে, রাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, বিদেশি শক্তির আঁতাঁতকে পরাস্ত করে তারা গড়ে তুলবে স্বাধীন গণতন্ত্র।
খুনের বর্ণনাগুলি চমকপ্রদ। প্রথমে জানা গেল, ছদ্মবেশী রাজকন্যার গোপন ছুরিতে আহত হয়েছেন লামা লোবসাং। কয়েক পৃষ্ঠা পর ছোট রানি এসে লামাকে জানালেন, আসলে রাজকন্যা তাঁকে খুন করতে চেয়েছিলেন, ভুলক্রমে লামার গায়ে লেগেছে। ক্লাইম্যাক্সে পর পর দু’টি খুন। কামার রাজকুমারীর শিশুসন্তানকে নিয়ে পালাতে চায়, ছোট রানি কুকরি হাতে পথ আটকান, ধস্তাধস্তিতে তাঁর বুকে ইস্পাতের ফলা বিঁধে যায়। তার পরই পিছন থেকে রাজকুমারীর ছুরি, কামারের মৃত্যু। ওই শিশু তো কামার আর রাজকন্যার অবৈধ প্রেমের ফসল!
চমৎকার থ্রিলার! এখানে নায়ক-নায়িকারা পাতায় পাতায় মহাযান বুদ্ধের শরণ নেয়। কত দিন পর যে বাংলা ভাষায় মহাযান শব্দটা পড়া গেল! চিনা সামন্তভদ্র থেকে জাপানি জ়েন, কোরিয়ার সিয়েন, তিব্বতের লামাতন্ত্র, সবাই এই ‘মহাযান’ শব্দে উপস্থিত। রকমফের আছে। তিব্বতে এই মহাযানের সঙ্গে তন্ত্র মিশে বজ্রযান। বাঙালি শরৎচন্দ্র দাশ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সকলে এই শব্দটাই ব্যবহার করতেন।
বৌদ্ধ ধর্মে প্রথম দিকে অনেক ভাগ ছিল। আমাদের পরিচিত, বিক্রমশীলা মহাবিহারের অধ্যক্ষ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ যেমন মহাসঙ্ঘিকা সম্প্রদায়ে ছিলেন। তার আগে হর্ষবর্ধনের আমলে চিন থেকে হিউয়েন সাং নামে যে পর্যটক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন, তিনিও মহাযান বৌদ্ধ। কিন্তু যোগাচার সম্প্রদায়। মহাযান সেই বৌদ্ধ, যিনি নির্বাণ পেয়েও নেন না। উল্টে দুনিয়ার সকলের মুক্তির জন্য বারংবার ফিরে আসতে চান। এই কারণেই অন্য বৌদ্ধ সম্প্রদায় মহাযান দর্শনকে ঠাট্টা করে বলত শশশৃঙ্গ বা খরগোশের শিং। বলত, আকাশে যেমন ফুল ফোটে না, ওদের মতটাও সে রকম। বাংলা আকাশকুসুম শব্দের উৎপত্তি সেখান থেকেই। সেই বাংলা উপন্যাসে ফের এল মহাযান!
উধোতকাণি চিত্তাণি
সুতপা বসু
৫৫০.০০
আনন্দ
সে যাক! পশ্চিম তিব্বতের ‘গু জে’ রাজ্যের রাজা ইয়েশে ওডের আমন্ত্রণে আটান্ন বছর বয়সে অতীশ সেখানে যান। ইয়েশে ওড তত দিনে শত্রু দেশের কারাগারে মারা গিয়েছেন, তাঁর পুত্র বায়াং চুব ওড রাজা। সেখানেই থোলিং মহাবিহারে অতীশ লিখেছিলেন বিখ্যাত বোধিপথপ্রদীপ গ্রন্থ। পরে চর্যাপদের মতো কিছু গান বা চর্যাও লেখেন। সেগুলি তিব্বতিতে আজও সংরক্ষিত। হাল আমলে সিয়াটল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড শেরবার্ন অতীশের সমগ্র লেখালিখি তিব্বতি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। রোনাল্ড ডেভিডসন তাঁর ইন্ডিয়ান এসোটেরিক বুদ্ধিজ়ম ও টিবেটান রেনেসাঁস নামের দুই বইয়ে বাঙালি অতীশকে নিয়ে বহু পৃষ্ঠা খরচ করেছেন। তাঁর মতে, তিব্বতে অতীশের আগমন সেখানে ধর্মীয় নবজাগরণের অন্যতম জলবিভাজিকা।
অতীশ নিয়ে এত কথা বললাম, কারণ এখানে নায়িকা মাঝে মাঝেই হে মহাযান বুদ্ধ, হে অতীশ বলে প্রণাম করেছে। ‘মহাযান বুদ্ধ’ শব্দে অবাক লাগল। মহাযান একটি মত মাত্র। কেউ শৈব শিব, বৈষ্ণব বিষ্ণু এ সব বলে পুজো করে না! আর হে অতীশ! অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতি নবজাগরণের স্রষ্টা ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কোনও ধর্ম চালু করেননি। তাঁর তিব্বতি শিষ্য ডোম তান পরে কদম্পা নামে এক ধর্মমত চালু করেন। সেই কদম্পা থেকে শাক্যপা, কর্মপা, আরও অনেক সম্প্রদায়। তারও তিনশো বছর পরে চোংখপা নামে ধর্মতত্ত্ববিদের উত্থান। তাঁর মত থেকেই দলাই লামা, পাঞ্চেন লামাদের গেলুগপা শিবির। ফলে জনজীবনে ‘হে অতীশ’ কেউ বলে না। কয়েক বছর আগে সন্মাত্রানন্দের উপন্যাস নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা-য় অতীশ এসেছিলেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামের অতীশ। আর এই উপন্যাসে পূজ্য দেবতা হিসাবেই অতীশের আগমন।
উপন্যাসে তারা নামের এক ছোট্ট মেয়ে আছে। বস্তুত, মহাযান আর তন্ত্রের সমন্বয়ে বজ্রযান বলেই তিব্বতে সবাই তারার আরাধনা করে। বাস্তবের লাসায় আজও আছে জোখাং মন্দির, সেখানে তিব্বতের প্রধান দেবতা অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। সঙ্গে দুই তারা। এক জন সাদা, এক জন নীল তারা। শরৎচন্দ্র দাশ লিখে গিয়েছেন, সপ্তম শতাব্দীর তিব্বতি রাজা স্রোং সান গাম্পোর নেপালি স্ত্রী ভ্রুকুটি নীল তারা আর চিনা স্ত্রী ওয়েনচাং সাদা তারার প্রতীক। চিনারা অবশ্য অন্য রকম ভাবে। তাদের ধারণা, তারা-টারা নয়। চিনা রাজকন্যা বর্বর তিব্বতিদের সভ্য করতে গিয়েছিলেন।
সপ্তম শতাব্দী থাকুক! শুরুতেই লেখিকা জানিয়েছেন, “গল্পের সময়কাল, কল্পনায় ধরে নেওয়া যাক, ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ সালের তিব্বত।” এই সময়টা অবশ্য চমৎকার নথিভুক্ত। বর্তমান চতুর্দশ দলাই লামার জন্ম ১৯৩৫ সালে, তাঁর দু’টি স্মৃতিকথা আছে। তিব্বতে থাকার সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন অস্ট্রিয়ার হাইনরিখ হারার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা তাঁকে দেহরাদূনের জেলে আটকে রেখেছিল, তিনি পালিয়ে তিব্বত চলে যান, পরে সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট নামে একটি বই লেখেন। এতগুলি নথি বলে, এই সময়ে তিব্বতে রাজতন্ত্র, রাজপ্রাসাদ কিছুই ছিল না। ১৯১৪ সালেই শিমলায় এসে ত্রয়োদশ দলাই লামার প্রতিনিধি ম্যাকমাহন লাইন চুক্তিতে সই করে গিয়েছেন। চিন সেখানে সই করেনি, আজও ম্যাকমাহন লাইনকে তারা মানে না। কিন্তু উত্তর-আধুনিক এই পৃথিবীতে উপন্যাসের সত্য আর ইতিহাসের সত্য যে আলাদা, কে না জানে!
উপন্যাসে লোবসাঙের ছেলেবেলা বেশ কষ্টে কেটেছে। মঠে তিব্বতি ধর্মশাস্ত্র শেখানো বারণ। তিব্বতে অবশ্য ধর্মশিক্ষায় আঘাত আসে ষাটের দশকে মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে। গল্পের শেষে ১৯৪৫ সালে নায়িকা ধর্মশালাতে পৌঁছল কী ভাবে? তারও পনেরো বছর পর ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে এসে দলাই লামা ও তাঁর সঙ্গীরা অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ে পালিয়ে আসেন। সেখান থেকে মুসৌরী। ভারত সরকার তাঁদের হিমাচলপ্রদেশের ধরমশালায় থাকার বন্দোবস্ত করে। সেটাই সেখানে প্রথম তিব্বতি বসতি। দলাই লামার আত্মজীবনী ফ্রিডম ইন এগজ়াইল-এ এই যাত্রার চমৎকার বর্ণনা আছে। মুসৌরী থেকে তাঁর সঙ্গী তখন তেনজিং নোরগের উপহার দেওয়া কুকুরছানা!
বইয়ের নাম উধোতকাণি চিত্তাণি, পালি ভাষার শব্দবন্ধ, অর্থ নির্মল হৃদয়গুলি। তিব্বত নিয়ে উপন্যাসের নাম পালি ভাষায়! তিব্বতি জামিয়াং নোরবু কয়েক বছর আগে ইংরেজিতে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে শার্লক হোমস তিব্বতে, তাঁর গাইড কিপলিং-এর উপন্যাস থেকে উঠে আসা বাঙালি চরিত্র— ‘বাবু হরিচন্দ্র মুখার্জি’! উপন্যাসের নামে তিব্বতি শব্দ রাখতে নোরবু বিন্দুমাত্র পিছপা হননি, মন্ডলা অব শার্লক হোমস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy