Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Book Review

নতুন দৃষ্টিকোণ, সমস্যা তথ্যে

লন্ডনে ফিরে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, সাহেবদের বর্ণনায় শুধু নবাবদের বিলাসের কথা— অসাধারণ স্থাপত্য সম্পর্কে ‘অপজাত শৈলী’ ছাড়া আর কোনও বিশেষণ তাঁরা পাননি।

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:০৩
Share: Save:

রোজ়ি লিউলিন-জোন্স ভারতে পা রাখেন ১৯৬০-এর দশকে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু নিয়ে পড়াশোনার সূত্রে ১৯৭২ সালে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য লখনউতে আসেন। তত দিনে তাঁর আব্দুল হালিম শরর-এর বিখ্যাত গুজ়স্তা লখনউ (১৯২৬) পড়া হয়ে গেছে, সেই রোম্যান্টিক নবাবি শহরের টানেই আসা। সে যাত্রা বড় হতাশ হয়েছিলেন রোজ়ি। কোনও ভাল গাইড-বই নেই, এত এত নবাবি স্থাপত্যের কথা শুনেছেন— কী ভাবে তা তৈরি হল, কী ভাবেই বা ধ্বংস হল, কোথাও তার কোনও হদিস নেই।

লন্ডনে ফিরে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, সাহেবদের বর্ণনায় শুধু নবাবদের বিলাসের কথা— অসাধারণ স্থাপত্য সম্পর্কে ‘অপজাত শৈলী’ ছাড়া আর কোনও বিশেষণ তাঁরা পাননি। এমনকি শরর-ও সেই পথের পথিক। শুধু পি সি মুখোপাধ্যায় সাহস করে তাঁর পিক্টোরিয়াল লখনউ (১৮৮৩) বইতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘কালচারাল ভ্যান্ডালিজ়ম’-এর অভিযোগ তুলেছিলেন; বলেছিলেন, পশ্চিমের মানদণ্ডে লখনউয়ের স্থাপত্যকে বিচার করা উচিত নয়। ক্ষুব্ধ রোজ়ি নিজেই মাঠে নামলেন। এক দশকের বেশি গবেষণার ফল প্রকাশ পেল ১৯৮৫ সালে, আ ফেটাল ফ্রেন্ডশিপ/ দ্য নবাবস, দ্য ব্রিটিশ অ্যান্ড দ্য সিটি অব লখনউ। নবাবি শহরের স্থাপত্য নিয়ে আধুনিক কালের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আলোচনা, যা রোজ়ির নিজের কথায়— রাগ আর দুঃখ থেকে লেখা।

এর পর লখনউ নিয়ে একের পর এক কাজ করেছেন রোজ়ি। ক্লদ মার্টিনকে নিয়ে, পুরনো লখনউয়ের কিসসা নিয়ে, প্রাক্‌-১৮৫৭ পর্বে লখনউয়ের দুর্লভ ছবি নিয়ে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর কাজ অনবদ্য। লখনউয়ের সঙ্গে কলকাতার যোগসূত্র রয়েছে, গদিচ্যুত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর জীবনের শেষ ত্রিশ বছর কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে কাটিয়েছেন, সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন আর এক লখনউ। দুই শহর মিলিয়ে রোজ়ি লিখেছেন নবাবের জীবনবৃত্তান্ত— দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া। বাংলার আর এক নবাবি শহর মুর্শিদাবাদ নিয়ে বই সম্পাদনা করেছেন। এ বার এম্পায়ার বিল্ডিং-এ তাঁর ক্ষেত্র ব্যাপকতর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ধরতে চেয়েছেন নতুন দৃষ্টিকোণে।

এম্পায়ার বিল্ডিং: দ্য কনস্ট্রাকশন অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ১৬৯০-১৮৬০

রোজ়ি লিউলিন-জোন্স

৭৯৯.০০

পেঙ্গুইন/ভাইকিং

জোব চার্নকের সুতানুটির ঘাটে পদার্পণ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিদায়ের পর, ১৮৬০-এ সীমারেখা টেনেছেন রোজ়ি। জোর দিয়েছেন ‘বিল্ডিং’ আর ‘কনস্ট্রাকশন’-এ, কোম্পানি কী গড়েছিল আর কী গড়তে চেয়েছিল, ব্রিটিশ ভারতের প্রত্যক্ষ চেহারাটা কেমন হয়ে উঠেছিল তাদের হাতে, ভারতীয়দের উপর এই নতুন ‘বিল্ট এনভায়রনমেন্ট’-এর প্রভাবই বা কেমন পড়েছিল— দেখাতে চেয়েছেন সেটাই। যাঁরা এই নির্মাণযজ্ঞের পিছনে ছিলেন, বিশেষ করে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা (আর্কিটেক্ট আর সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা আসেন অনেক পরে), তাঁদের কথা তেমন ভাবে কেউ আলোচনা করেননি।

রোজ়ি গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের কয়েক জনের কথা লিখেছেন। লিখেছেন রিউবেন বারো-র কথা— স্বশিক্ষিত এই গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ কলকাতায় একটি মানমন্দির তৈরি করতে চেয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে দরবার করেছিলেন, কোম্পানি অবশ্য রাজি হয়নি। বারো সংস্কৃত আর ফারসি শিখে ভারতীয় গণিতবিদ্যার ঐতিহ্য অনুসন্ধান করেছিলেন, ভারতীয় পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী তফাজ্জল হুসেন খানের সঙ্গে আরবি ভাষায় নিউটনের প্রিন্সিপিয়া অনুবাদের কথা ভেবেছিলেন। অথচ কোম্পানি আমলের ইতিহাসে বারো জায়গা পাননি।

কলকাতা তথা পরবর্তী কালের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এই বইতে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে, যে-হেতু কোম্পানির মূল কর্মকাণ্ডের সূচনা এখানেই। রোজ়ি জোর দিতে চেয়েছেন ‘পলিটিক্যাল আর্কিটেকচার’ শব্দবন্ধের উপর। তাঁর মতে, কোম্পানির তৈরি করা প্রতিটি স্থাপনার পিছনে ছিল ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’। ভারতে ‘পলিটিক্যাল আর্কিটেকচার’-এর সঙ্গে ধর্মীয় স্থাপত্য ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পৃক্ত, এ কথা বোঝাতে গিয়ে রোজ়ি উদাহরণ টেনেছেন দিল্লির কুতুব মিনার চত্বরের মসজিদ, গৌড়ের ফিরোজ় মিনার এবং সাম্প্রতিক কালের বাবরি মসজিদের। আশ্চর্যের কথা, কোম্পানি আমলে তৈরি সেন্ট জন’স চার্চে যে গৌড়ের স্থাপত্য ভেঙে আনা পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল তা তো নথিবদ্ধ তথ্য। তা হলে কোম্পানির ‘পলিটিক্যাল আর্কিটেকচার’-এর উদাহরণে এর উল্লেখ থাকবে না কেন?

রোজ়ি দেখিয়েছেন, রাস্তা তৈরির পিছনে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ, জঙ্গল কাটা ইত্যাদির জন্য বিপুল অর্থব্যয়ের প্রশ্ন থাকায় কোম্পানি সে কাজে ততটা এগোয়নি। দ্রুত খবর আদান-প্রদানের জন্য প্রথমে সিমাফোর ব্যবস্থা চালু হয়, কিন্তু টেলিগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়ে যাওয়ায় সিমাফোর পরিত্যক্ত হয়। টেলিগ্রাফ লাইন বসানো নিয়েও গড়িমসি ছিল। একই সমস্যা ছিল যাত্রী পরিবহণের জন্য রেললাইন সম্প্রসারণ নিয়েও। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই সব কিছুর মূল্য দিতে হয়েছিল কোম্পানিকে। তবে স্থায়ী সেনানিবাস হিসাবে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি (এখানেও দমদম ক্যান্টনমেন্টের কোনও উল্লেখ কেন নেই তা বোঝা মুশকিল), শৈলাবাস তৈরি ইত্যাদি দেশের ভূদৃশ্য পরিবর্তনে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে সমীক্ষা করে নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করা, এবং সারা দেশ জুড়ে ত্রিকোণমিতিক জরিপ (গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে)। সমীক্ষার ক্ষেত্রে কলিন ম্যাকেঞ্জি এবং পরে জেমস রেনেল-এর কথা লিখেছেন রোজ়ি, কিন্তু বাদ পড়েছে ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিল্টনের নাম। দক্ষিণ ভারত, নেপাল এবং বিশেষ করে বাংলার অনেকটা অংশে বুকাননের সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত আকরসূত্রের মর্যাদা পায়। মানচিত্র তৈরি নিয়েও রোজ়ির বক্তব্য মানা কঠিন। তাঁর মতে, ইউরোপীয়রা আসার আগে এ দেশে মানচিত্র ছিল না। রেনেল কিন্তু তাঁর মানচিত্র তৈরির সময়ে চারটি ভারতীয় মানচিত্র ব্যবহার করার কথা লিখেছেন। জয়পুরে আছে বেশ কিছু প্রাচীন মানচিত্র। উদয়পুরে সিটি প্যালেস মিউজ়িয়মে এখন যে মানচিত্রের প্রদর্শনী চলছে, সেখানেও প্রাক্‌-ইউরোপীয় মানচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। দীপ্তি খেরা এবং ডেবরা ডায়মন্ড লিখেছেন তা নিয়ে।

আসলে ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়াল ‘সবই ব্যাদে আছে’। রোজ়ি স্পষ্টই বলছেন, “ফর বেটার অর ওয়ার্স, মডার্ন ইন্ডিয়া হ্যাজ় বিন শেপড বাই ব্রিটেন।” তিনি ‘রেট্রো-লিবারালিজ়ম’-এর বিপদ সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করে দিয়েছেন— আজকের মানসিকতা দিয়ে অতীতের মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করতে যাওয়া অনুচিত। ডালরিম্পল বা শশী তারুরের নেতিবাচক মনোভাব রোজ়ির না-পসন্দ।

সে হতেই পারে। কিন্তু কোম্পানির ইতিবাচক দিক দেখাতে গিয়ে তিনি কোম্পানি-পূর্ব কলকাতার ইতিহাস প্রসঙ্গে কোনও সূত্র উল্লেখ না করে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বিতর্কিত প্রসঙ্গ টেনে আনলেন, ব্ল্যাক হোলের অতিরঞ্জিত গল্প তৈরির নাটের গুরু জন জেফানিয়া হলওয়েলকে সততার সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন, রাজস্থানি জগৎশেঠের সঙ্গে জুড়ে দিলেন সপ্তগ্রামী তন্তুবণিক মুকুন্দরাম শেঠকে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পিছনে কোম্পানির ভূমিকা নিয়ে একটা কথাও খরচ করলেন না (গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে ধ্বংস হলে দেশের ‘বিল্ট এনভায়রনমেন্ট’ বদলায় না বুঝি?)। সিপাহি বিদ্রোহের পর দিল্লি কি লখনউয়ে কোম্পানি যে ভাবে ‘বিল্ট এনভায়রনমেন্ট’ ধ্বংস করেছিল, তার কথা এ বইয়ে উঠে এল না কেন? তাঁর তথ্যসূত্রে কোনও প্রাথমিক সূত্রের উল্লেখ নেই, সবই সুপরিচিত পরোক্ষ সূত্র। নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন রোজ়ি লিউলিন-জোন্সের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।



(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

British India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE