E-Paper

বহুস্বর সন্ধানে এগিয়ে যাওয়া

সঙ্কলনটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহন করে সাহিত্য তো বটেই, তার সঙ্গে শিল্প, থিয়েটার, সিনেমা থেকে সমাজনীতি, রাজনীতি, দর্শন এবং ইতিহাসের নিরন্তর সংলাপের চিহ্ন।

অভীক মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ ০৭:৪১

কথাসাহিত্যিক ইতালো কালভিনো তাঁর শেষ প্রবন্ধগ্রন্থে জানিয়েছিলেন, অনমনীয় আর বদ্ধ দুনিয়ায় বহুস্বর সন্ধানই এখন সাহিত্যচর্চায়, মননচর্চায় কাম্য। কথাটা মনে পড়ল, অমিয় দেব লিখিত গ্রন্থটির সূত্রে। সঙ্কলনটি বৃহদায়তন। অমিয় দেবের ১০২টি প্রবন্ধসমেত ৯টি পর্বে বিন্যস্ত ৬৩২ পৃষ্ঠার এই বইয়ে ভাবনার অপরিসীম বৈচিত্র যেমন প্রকাশিত, তেমনই গভীর মননচর্চার অবাধ পরিসরও উন্মোচিত। অমিয় দেব দীর্ঘ দিন সারস্বত সাধনার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম মননচর্চার ক্ষেত্রে সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। বাংলা এবং ইংরেজিতে তিনি সাহিত্য, তুলনামূলক সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ, অনুবাদচর্চা প্রভৃতি বিষয়ে দীর্ঘ দিন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে চলেছেন, সম্পাদনা করেছেন নানা গ্রন্থও। রবীন্দ্রসৃষ্টির নানা অভিমুখ বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলন কী ফুল ঝরিল বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তবে, আলোচ্য গ্রন্থটিতে তাঁর নিবন্ধ রচনার বিবিধ চর্যার পাশে নজর এড়ায় না তাঁর নানা ভূমিকা। এর মধ্যে প্রধান হল অনুবাদকের ভূমিকা, একটু অপ্রধান হলেও স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক উদ্ঘাটন।

সঙ্কলনটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহন করে সাহিত্য তো বটেই, তার সঙ্গে শিল্প, থিয়েটার, সিনেমা থেকে সমাজনীতি, রাজনীতি, দর্শন এবং ইতিহাসের নিরন্তর সংলাপের চিহ্ন। বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রত্যক্ষ এই ছাত্রটি শঙ্খ ঘোষ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, নবনীতা দেব সেন, বিনয় মজুমদার, কবিরুল ইসলাম থেকে শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার কিংবা রিচার্ড শেখনার-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বহু মুহূর্ত কাটিয়েছেন। স্বদেশ এবং বিদেশে শিক্ষা এবং মেধাচর্চার অনুষঙ্গে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গন থেকে অলিন্দে তাঁর অনিরুদ্ধ যাতায়াত। এ সব চিহ্ন, এ সব মানুষ, এ সব মুহূর্ত আর এ সব বিশ্লেষণ এই গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছায়া ফেলে গেছে। অথচ ঋজু গদ্য, বিষয়ানুগ যুক্তিনির্মাণ, স্পষ্ট বিবেচনা এবং অনুভবী মন— সবই পরস্পরের সঙ্গে মিশে এক গভীর উপভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। মনন, পরিবেশনা আর অনুভবের এমন সাবলীল সমন্বয় সাম্প্রতিক বাংলা প্রবন্ধে বিরল।

ন’টি পর্বের কোনওটিতে তিনি কথা বলছেন ‘বইপড়া’ বিষয়ে, কোনওটিতে তাঁর সময়ের সৃষ্টিশীল মানুষদের নিয়ে আলোচনা। কখনও সেখানে বিনয় মজুমদার, সুভাষ-শক্তি-আলোক সরকার তাঁর আতশকাচের নীচে কবিতা-সহ হাজির, কোথাও প্রুস্ত, দান্তে, এলিয়ট, ওরহান পামুক কিংবা টমাস মান। কখনও কথা বলছেন, ‘মার্ক্সবাদ ও উদারনীতি’ অথবা ‘স্লোগান কিংবা অশোক সেনের রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে, কখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। সযত্নে দেখছেন গান্ধীর মতাদর্শ, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চোখে গান্ধীর গুরুত্ব, বুঝতে চাইছেন গান্ধী রবীন্দ্রনাথের মিতালি-সংঘাতের কোনও মুহূর্ত।

ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ আমাদের খানিকটা চেনা বিষয়। কিন্তু ওকাম্পোর গান্ধী সম্পর্কে আমি নেহাতই অজ্ঞ ছিলাম। যেমন তাঁর অনুবাদে একই ভাবে এই গ্রন্থে নজরে এল ওকাম্পোর নেওয়া ১৯৩৪ সালের মুসোলিনি-সাক্ষাৎকারের দৃষ্টিভঙ্গি। সে সাক্ষাৎকারে “নারীদের নিয়ে মুসোলিনীর অভিমতে কোনও দ্ব্যর্থের জায়গা ছিল না। তারা যেন রাজনীতিতে না ঢোকে কারণ তারা তা বোঝে না। তেমনই যেন দর্শন, সঙ্গীত, বা স্থাপত্যে না নাক গলায়— ওই একই কারণে।... এটা কি সম্ভব যে যারা তাদের শরীর দিয়ে মনুষ্যশরীর তৈরি করে, সেই নারীরা এতটাই হীনম্মন্যতায় ভুগবে যে তাদের সেই সৃষ্টির ধ্বংসে বা সুপরিকল্পিত অঙ্গহানিতে আপত্তি করবে না?” এই নিবন্ধটি হয়তো পুরনো এক বিতর্কের অবসানও ঘটাল। আমার মতো এক পাঠকের কাছে ওকাম্পো উজ্জ্বল হলেন আর একটু। ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার সুরে এই উন্মোচন অমিয় দেব মশায়ের কল্যাণে আমরা জানলাম। বহু বছর আগে নবনীতা দেব সেন লিখেছিলেন, “...শ্রীমতী ওকাম্পো যে ফ্যাসিজ়মে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন, এবং ইটালি ফ্যাসিস্ট দলের কর্মী হয়ে নানা প্রত্যক্ষ কাজে লিপ্ত ছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতবর্ষে যেতে পারেননি...” (বিবাগী ফুলের গন্ধ/ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অন্যান্য)— সেই মন্তব্য প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেল। অন্য দিকে, অত্যন্ত মননঋদ্ধ প্রবন্ধ, ‘ওকাম্পোর চোখে গান্ধী’— এক দিকে ওকাম্পোকে চেনায়, অন্য দিকে গান্ধীর পরিগ্রহণকে নতুন মাত্রায় সঞ্জীবিত করে। আত্মজীবনীতে ওকাম্পো লিখেছিলেন, “মহাত্মা ছিলেন বিশেষ ভাবে ভারতের ও সাধারণ ভাবে বিশ্বের দুঃখে আর্ত: রবীন্দ্রনাথও কাতর ও দুঃখমোচনে উৎসুক। কিন্তু তিনি সৌন্দর্যপ্রেমীও, যিনি জানেন তাঁর কাজ সুন্দরের গান গাওয়া ও সর্বত্র সুন্দরের সাধনা: একজন সন্ত, অন্যজন কবি। কাকে বাছব জানতাম না, যদিও তখন মহত্তর মনে হয়েছিল গান্ধীজিকে।...”

গদ্য সংকলন

অমিয় দেব

৭৯৯.০০

দে’জ়

প্রবন্ধগুলির বিশেষ একটি দিক হল তার প্রশ্নময় বিচারপদ্ধতি। কোনও স্থির সিদ্ধান্ত বা অনুশাসন তিনি পাঠকের উপর চাপিয়ে দিতে নারাজ। বহুস্বর এবং বহু শরিকের সঙ্গে মত বিনিময় তাঁর লক্ষ্য। নিজের সঙ্গেও যেন তর্কবিতর্ক। একপেশে নিদান ঘোষণায় এই লেখকের ঘোর আপত্তি। মনে রাখা ভাল, তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ শেষ হয় প্রশ্নবোধক বাক্যে। ‘মার্ক্সবাদ ও উদারনীতি’ প্রবন্ধে ‘পুনর্বিচার’-এর জিজ্ঞাসু অবস্থান: “... পাস্তেরনাক বা সলঝেনিৎসেন নিয়ে যে দ্বিধা আমাদের একদা ছিল তাতে কি কিঞ্চিৎ একপেশেমি ছিল না? সংস্কৃতি বিপ্লব তো বটেই, তিয়েনআনমেন স্কোয়ারও কি আমরা পুরো হজম করতে পেরেছি, বরাহনগরের কথা নাহয় না-ই তুললাম!”

জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত পরিসরে মাঝেমধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে নির্মল কৌতুক। যাদবপুরে সাম্মানিক ডি লিট নিতে এসেছেন শম্ভু মিত্র, তাঁকে সমাবর্তনের বিশেষ পোশাক পরানোর দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক দেব। “শুনেছিলাম তিনি চোখে কম দেখছেন তখন। জিজ্ঞেস করলাম ধরব কি না। বললেন, ধরবেন? থাক, লোকে বলবে সকাল থেকেই।”

‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধটিও বনিয়াদি প্রয়াস। বিশ্লেষণে, সমীক্ষণে, সঙ্গে-অনুষঙ্গে তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে তুলনামূলক সাহিত্যের বিশিষ্ট অভিমুখ, সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চার সঙ্গে তার সম্পর্ক, চিন-জাপান, পারস্য-আরব জুড়ে বা সুদূর পাশ্চাত্য থেকে অচেনা দেশকালে তার উড়ানের সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে কথা বলেন। তবে সবই দ্বিমুখী প্রস্তাবের সংলাপধর্মী অবয়বে। ওরহান পামুকের তুষার উপন্যাস পাঠের বিবরণটি চিত্তাকর্ষক। উনিশটি মাইলস্টোন তথা উনিশটি কবিতার অবয়ব সংস্থানকে নকশা এঁকে, প্রসঙ্গ ভেঙে তিনি পড়তে থাকেন। আবার প্রুস্ত-এর মহাউপন্যাস নিয়ে আলোচনায় মনে করিয়ে দেন, জেমস জয়েস এবং প্রুস্ত উভয়ে উভয়ের লেখালিখি নিয়ে ছিলেন শীতল এবং উদাসীন। অথচ, দু’জনের মনোজগৎ-রচনাজগতে সামীপ্য তো অহরহ।

একই আগ্রহে তিনি পড়েন বুদ্ধদেব সুধীন্দ্র বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ সুভাষ শক্তি, অলোকরঞ্জন আলোক সরকার কিংবা নবনীতা দেব সেনের কবিতা। ডেভিড ম্যাককাচ্চন, অশোক সেন, ভূমেন্দ্র গুহ প্রসঙ্গে স্মৃতিমেদুর তাঁর কণ্ঠ। পাঠককে ধরিয়ে দেন অমলেন্দু চক্রবর্তীর বা অভিজিৎ সেনের গল্প। এক দিকে বিশ্বসাহিত্য পর্যটন, আর অন্য দিকে নিবিড় সান্নিধ্যে বাংলা সাহিত্য, বন্ধুবৃত্ত, স্মৃতি, মৃত্যু, উজ্জীবন— যেন দুই মুখোমুখি প্রসঙ্গ দূরবর্তী আর নিকটবর্তীর টানাপড়েনে জাগ্রত হয়। খুবই জরুরি প্রবন্ধ ‘অনুবাদপাঠ’ এবং ‘ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস’-এ উজ্জ্বল উপস্থিতি লেখকের বন্ধু অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশের। “ভারতবর্ষ এক দৃঢ়প্রতিষ্ঠ স্বয়ংপ্রকাশ সত্য, এই বিশ্বাসের পুনঃপুনরুক্তিমাত্র না করে তিনি ভারতসন্ধানের কথা তুলেছেন, সেই সন্ধান যে কত জরুরি ভারতীয় ভাষার সাহিত্য সমূহের পক্ষে, তা জানাচ্ছেন।”

অমিয় দেব আমাদের অনেকের শিক্ষক। তাঁর প্রজ্ঞাবান মননটি আমাদের পথ দেখায়। তাঁর রচনাশৈলীর একটি বড় গুণ হল প্রাজ্ঞোক্তি বা এপ্রিগ্রাম দিয়ে অনেক কথা আয়তন-বান করে তোলা। এ গ্রন্থে অহরহ সেই দার্শনিক উদ্ভাসের দেখা মিলবে। যেমন, কতিপয় ১) ‘...অ-পণ্ডিত পাঠকের যা দরকার তা রসবোধ।’ ২) ‘তথ্য নিরঞ্জন। কিন্তু তার বিচার নিরঞ্জন নয়।’ ৩) ‘বস্তুত, সমাজ যতই এগোবে ততই রাষ্ট্রের কাজ কমবে।’ ৪) ‘সকল আমি-র প্রান্তেই কি এক তুমি থাকে?’ ৫) ‘গান্ধীর অহিংসার এক সার্বিক চেহারা ছিল।’

শেষে একটা অনুযোগ। ‘শুদ্ধিপত্র’ সংযোজনের পরেও আঁতকে ওঠার মতো বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ থেকে গেছে। ওঁর মতো করেই বলি: সেগুলি কি দ্রুত সংশোধন করা যায় না?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy