বইপাড়ার অলিগলিতে ‘আখ্যান’-এর ছড়াছড়ি। সেই আখ্যান কেউ একটি প্রতিষ্ঠান ঘিরে তথ্যগর্ভ নিবন্ধের আধারে লেখেন, কেউ আবার কথাসাহিত্য আশ্রয়ে প্রকাশ করেন। সবিতেন্দ্রনাথ রায় যেমন তিন পর্বে কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নেপথ্যে রেখে ও তাকে ইতিহাসের কালপর্বে শামিল করে লিখেছেন। ১৯৩৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিস্তৃত কালপর্বের এই ইতিহাস মহাশ্বেতা দেবীকে আকৃষ্ট করেছিল।
পাশাপাশি, উপন্যাসের আধারেও আখ্যান লেখা হয়ে থাকে। তারই নজির রয়েছে অরিন্দম বসুর লেখা এই বইটিতে। ৩৯টি পর্বে বিন্যস্ত এই উপন্যাসে বইপাড়ার এক ক্ষুদ্র প্রকাশকের অস্তিত্বের সঙ্কটের সঙ্গে সময়ের ভিন্ন ইতিহাস প্রবহমান। কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসার আড়তে তমাল নামক শিক্ষিত তরুণ ছোট এক প্রকাশনা খুলেছে। বই প্রকাশের ব্যবসায় নেমে ক্রমশ সে এই পেশার নেপথ্যে নিরন্তর ঝুঁকি উপলব্ধি করে। অস্তিত্বের টানাপড়েনে নিরন্তর ঝড়ঝাপটার মধ্যে তমালের ‘কলেজ স্ট্রিট আবিষ্কার’ অব্যাহত থাকে।
অলিগলি চিনতে চিনতে তার মাথায় ছড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের নানা তথ্য। বটতলা বইয়ের ব্যবসা কী করে কলেজ স্ট্রিটে এসে পৌঁছল, এই স্থানের পূর্বাবস্থা, বাঙালির সামাজিক জীবনের ‘রেনেসাঁস’ সময়ের লেখাপড়া, বই, খবরের কাগজ, সব কিছুই তমালের মাথার মধ্যে জড়ো হয়। পুরনো বাড়ি, ছাপাখানা, বাঁধাইঘর, কাগজ পট্টি, এজেন্ট, ক্যানভাসার, মুটে-মজুর, দোকানদার, পুরনো বইয়ের বিক্রেতা, বইঘরের সামান্য মাইনের কর্মী, কম্পোজ়িটর, আর্টিস্ট, অন্য প্রকাশক, সাহিত্যের যশোপ্রার্থী, লেখক এবং পাঠক মিলেমিশে এক বিরাট জগৎ কলেজ স্ট্রিটের শব্দ, গন্ধ, রং, ছবি সহকারে প্রকাশিত হতে থাকে। সময়ের ভিন্নতায় ইতিহাস আর বাংলা সাহিত্যের নানা বাঁক কাছাকাছি আসে।
কলিকাতা পুস্তকালয়
অরিন্দম বসু
৪৯৯.০০
দে’জ়
উপন্যাসে ঘটনাবলির মধ্যে সদাজাগ্রত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনিও কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁর মধ্য দিয়ে ভেসে ওঠে এক প্রাচীন সময়সরণি। বহমান মুহূর্ত তার গন্তব্যকে খুঁজে নেয়। সম্পূর্ণ উপন্যাসের মধ্যে এই বিদ্যাসাগর পর্বটিই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ইতিহাসের তথ্যে বিদ্যাসাগর আর বর্তমানের আবহে তমালের কল্পনায় জীবন্ত বিদ্যাসাগর: “…তবে প্রথমবার চাকরি ছাড়ার পর আলু-পটল বেচেননি তিনি। বই বেচেছিলেন। পটলডাঙায়— আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা ছাপাখানা খুললেন। মেশিনের নাম ছিল সংস্কৃত যন্ত্র। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার। গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। বইয়ের দোকানও খুলেছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, এখন কলেজ স্ট্রিটের দোকানগুলোয় বই ব্যবসার যা নিয়ম তা বিদ্যাসাগর চালু করে দিয়েছিলেন পৌনে দুশো বছর আগে। আড়তদারি কথাটা বেশ ভালো। বইয়েরই তো আড়ত কলেজ স্ট্রিটে।” একাদশ পর্বে ইতিহাস-তথ্যের এই বিদ্যাসাগরের পাশেই জেগে থাকেন উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের কল্পনায় জীবন্ত বিদ্যাসাগরও, ৩৯তম পর্বে: “ভাবতে ভাবতেই তমাল দেখতে পেল বিদ্যাসাগর আর সামনে নেই। কোথায় গেলেন তিনি? এগিয়ে চলে গেলেন? মিলিয়ে গেলেন কোথায়? হাঁকুপাকু হয়ে ছুটে যেতে চাইছিল সে। পারল না। তার বদলে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।”
বইটির নামকরণেরও এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বিদ্যাসাগরের তৈরি সেই পুস্তকালয়ে না গেলেও স্বনির্মিত পুস্তকালয়ে তমালের গর্বিত পদচারণা। প্রচ্ছদচিত্রটি নজর কাড়ে বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্যে নজর কাড়ে বইয়ের প্রচ্ছদপট, আর উপন্যাসের উৎসর্গলিপিটি— ‘সেই নাম-না-জানা কর্মীদের, যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে চলছে বইপাড়া’ যেন বই-পড়া আর অনুভবেরও বৃত্তটি সম্পূর্ণ করে।
নজরে
“বামপন্থী কর্মী হিসেবে আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝেছি যে, ভারতে বামপন্থী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার সব থেকে বড় কারণ হল বামপন্থী সংকীর্ণতাবাদ।... আজ যখন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করে একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে, তখনো বামপন্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ত্যাগ করে সারা দেশে একটি বিশাল ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তোলার দায়িত্ব অনুভব করছেন না।” বরুণ দাসগুপ্ত কথাগুলো লিখেছিলেন বছর দশেক, কি তারও কিছু বেশি আগে। পরের দশক প্রমাণ করেছে, কী অব্যর্থ এই বিশ্লেষণ। স্মৃতিভিত্তিক বইটির মস্ত প্রাপ্তি এ ধরনের পর্যবেক্ষণগুলিই। গান্ধীবাদী পরিবারের সন্তান তিনি: সতীশ দাসগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্র, পিতা ক্ষিতীশ দাসগুপ্তের বন্ধু ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সোদপুরের বাড়িতে গান্ধী, নেহরু, আজ়াদ-সহ সব জাতীয়তাবাদী নেতাকেই দেখেছেন শৈশবে; কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই যোগ দিয়েছেন বামপন্থী রাজনীতিতে। দেখেছেন গেরিলা বামপন্থী আন্দোলনের সংগঠন। পরিণত বয়সে সাংবাদিকতায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। ফলে, তাঁর স্মৃতিকথা যে সাধারণের অভিজ্ঞতার কিছু বাইরে— তাতে আশ্চর্য কী।
স্মৃতির সরণি বেয়ে
বরুণ দাসগুপ্ত, সম্পা: অনুরীতা মুখোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ ঘোষ
৫৫০.০০
মান্দাস
তাঁর দেখার ভঙ্গিতে শ্রদ্ধার অভাব নেই, কিন্তু সেই শ্রদ্ধা প্রশ্নের পথে বাধা হয়নি। তিনি স্মরণ করেছেন, তাঁদের সোদপুরের বাড়ি থেকে হাওড়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েও মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছিলেন গান্ধী— হামে শয্যাশায়ী বালক লেখকের সঙ্গে দেখা করে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে। এই গান্ধী সম্বন্ধেই বরুণবাবু বলেছেন, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতার প্রথম অধিকারী তিনিই। নেতাজিকে দলছাড়া করা বা আজ়াদকে চাপ দিয়ে পথে আনা, এ সব করেছেন গান্ধী, তখন তিনি দলের চার আনার সদস্যও নন। অন্য দিকে, জ্যোতি বসু সম্বন্ধে লেখকের দু’শব্দের বিশ্লেষণ, ‘গ্লোরিফায়েড মিডিয়োক্রিটি’। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কথাটির মাহাত্ম্য হাড়ে হাড়ে জানে। ‘বাংলার গান্ধী’ হিসাবে পরিচিত জ্যাঠামশাই সতীশচন্দ্রও যে পরিবারের পরিসরে যথেষ্ট স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, জানাতে দ্বিধা করেননি লেখক— তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা না হারিয়েই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)