পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি বাঙালির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই তার চলার পথে চোরাগোপ্তা নানা রাজনৈতিক আক্রমণ। পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে খুব সহজ ছিল না। মানস ঘোষ সাংবাদিকতা সূত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন ১৯৭১-এ, স্বাধীন বাংলাদেশে তিন বছরেরও বেশি সময় ছিলেন কর্মসূত্রে। আলোচ্য বইটিতে তাঁর প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দলের প্রধান নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া বা তার অভাবের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা বাংলাদেশের জন্মলগ্নের রাজনীতি বুঝতে অপরিহার্য।
এর একটা বড় অংশ জুড়ে আছে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্ক। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মুজিব গ্রেফতার হন, তাঁকে রাখা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে। ২৬ মার্চ-পরবর্তী যে মুক্তিযুদ্ধ, তার নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয় ভারতে: তার নাম মুজিবনগর সরকার, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি সফল ভাবে সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অন্য নেতাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তার সফল লক্ষ্যে এগিয়ে দিয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন ছিলেন তাঁর নেতা ‘মুজিব ভাই’-এর অনুগত সহযোদ্ধা। পাকিস্তানের জেলে ন’মাস কাটিয়ে শেখ মুজিব যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেন, তখন তাজউদ্দীন-বিরোধী একটা গোষ্ঠী— তার মধ্যে অন্যতম খন্দকার মোশতাক ও মুজিবের ভাগ্নে শেখ মনি— শেখ মুজিবের মন বিষিয়ে তুললেন। লেখক জানাচ্ছেন, ’৭২-এর জানুয়ারিতে দেশে ফেরামাত্র সংবর্ধনাসভায় যাওয়ার পথে তাজউদ্দীনকে শেখ মুজিব বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ নিতে চান। ফলে দু’-তিন দিনের মধ্যেই তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন, শেখ মুজিবও রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মুজিব হন নতুন প্রধানমন্ত্রী, তাজউদ্দীন মুজিব-মন্ত্রিসভায় অর্থনীতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। লেখক এই ঘটনায় শেখ মুজিবের দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং কুচক্রী আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মকর্তাদের সাফল্য দেখেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধ শেষে নতুন রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতা তো তিনি তাঁর হাতেই রাখতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠী শেখ মুজিবকে উস্কেছিল ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের রূপকার-রাজনীতিক হিসেবে তিনি ক্ষমতা চাইবেন, এটা স্বাভাবিক।
তাজউদ্দীনকে নিশানা করে তাঁর বিরোধীরা ’৭১-পরবর্তী বাংলাদেশে নানা ভাবে ভারত-বিরোধিতার জিগির তৈরি করে। তাজউদ্দীন মুজিবনগর সরকারের প্রধান হিসেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের তাড়াতাড়ি নিজস্ব মুদ্রা চালু করা দরকার। তিনি ভারত সরকারকে এক টাকার নোট ছাপার বরাত দেন। নোটগুলো যখন প্রথম বাংলাদেশে চালু হয়, ব্যবসায়ী সংগঠন-সহ অনেকেই খুশি হয়। কিন্তু কুচক্রীরা ধুয়ো তোলে যে, ভারত নকল নোট বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চায়। এমন বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা চলে যে, তাজউদ্দীন ভারত সরকার ও ইন্দিরা গান্ধীর অঙ্গুলিহেলনে চালিত এক নেতা। এত অভিযোগের একটাও তারা প্রমাণ করতে পারেনি, কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের মধ্যে বোঝাপড়া দুর্বল হয়। এখানেই কুচক্রীদের সাফল্য। লেখকের ইঙ্গিত, বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেননি, তাজউদ্দীনকে ‘ভারতপন্থী’ বলার মধ্য দিয়ে এই গোষ্ঠী বস্তুত তাদের ভারত-বিরোধিতা পোক্ত করছিল, এবং তাদের আসল টার্গেট ছিলেন শেখ মুজিব নিজেই। মুজিব-হত্যা ও তার পরবর্তী আরও হত্যাকাণ্ডে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
মুজিব’স ব্লান্ডারস: দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য প্লট বিহাইন্ড হিজ় কিলিং
মানস ঘোষ
৭৯৫.০০
নিয়োগী বুকস
লেখক দেখিয়েছেন, শেখ মুজিবের আর একটা বড় ভুল স্বাধীন বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতির পরিসরকে রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে দমন করা। ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার বাসনা তাঁকে প্রায় একনায়কতন্ত্রের দিকে নিয়ে গেছে। ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার সুবিমল দত্তের প্রশ্নে মুজিব বলেছিলেন, মৌলানা ভাসানী কেন, কেউই তাঁর বা আওয়ামী লীগের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। এ রকম মানসিক অবস্থায় মনে হয় ‘আমি অপরাজেয়’, এই অবস্থা থেকেই নিজের চরম ক্ষতিরও বীজ বপন হয়। মুজিবের বিভিন্ন ভুলের মধ্যে তাঁর অগণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রী মনোভাব সবচেয়ে বড় ভুল। তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে, তিনি নিজের ভয়াবহ মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে এনেছেন।
বইটিতে ১৯৭২ সালের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিও আলোচিত। লেখক জানিয়েছেন, ঢাকার সংবাদ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তাঁকে বলেছিলেন, এই চুক্তি মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ও ভারত-বিরোধীদের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। বস্তুত তা হয়েছিলও। তখনকার বাংলাদেশে প্রচারমাধ্যমের একটা বড় অংশ, বিভিন্ন মুজিব-বিরোধী ও ভারত-বিরোধী শক্তি বলে— এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছে, এতে বাংলাদেশকে রাষ্ট্ররূপে গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে চিন পিছিয়ে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের চিনা রাষ্ট্রদূতেরা তাঁদের সরকারের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। এই চুক্তি স্বাক্ষর কি শেখ মুজিবের ভুল ছিল? মনে হয় না। হয়তো ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে সামরিক বা ভূ-রাজনৈতিক সহযোগিতার কথা না রাখলেই ভাল করতেন, রাজনীতি-কূটনীতিতে কিছু আঁতাঁত অঘোষিত থাকাই শ্রেয়।
দেশের মধ্যে বিরোধী পরিসরকে দমন, ভূ-রাজনীতির বড় শক্তিগুলোর ভারসাম্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের নৌকার কান্ডারির ভূমিকায় খামতি শেখ মুজিবের পক্ষে সুখকর হয়নি। দ্বিতীয়টা মুজিব বা অন্য নেতার অভিজ্ঞতার অভাব, পারদর্শিতার অভাব; কিন্তু প্রথম ভুলটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শনের ভুল। তার মাসুল তাজউদ্দীনের প্রিয় ‘মুজিব ভাই’ দিয়েছেন জীবন দিয়ে।
ট্রাজিক নায়ক বঙ্গবন্ধুর ভুলগুলি দেখানোর মধ্য দিয়ে লেখক একটা চর্চার জানলা খুলে দিয়েছেন: শেখ মুজিবের শাসন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বড় গলদগুলো না বুঝে শুধুই মুজিব-বন্দনা আওয়ামী লীগকে সুফল দেবে না। সঙ্গে যোগ করতে চাই, ভারতের কূটনীতির দিশাকেও সুষ্ঠু, স্মার্ট হতে হবে। আওয়ামী লীগই ভারতের বন্ধু, অন্যরা কদাচ নয়, এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে ভাবা প্রয়োজন: নানা রাজনীতির রং-সহ সমগ্র বাংলাদেশ কেন ভারতের বন্ধু হবে না!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)