E-Paper

ভাবনার প্রগল্‌ভ ঐশ্বর্য

এই বিস্তর পরিশ্রমের কাজ যে অতি নিপুণতার সঙ্গে সম্পন্ন হতে পেরেছে, বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে তা বিশেষ সৌভাগ্যের।

সন্মাত্রানন্দ

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৪

নকশালপন্থী লেখক সরোজ দত্ত প্রায় মারমুখী ভঙ্গিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধমকাচ্ছিলেন এই বলে যে, মানিকবাবুর সহরতলী উপন্যাসের নায়িকা যশোদা লাথি মেরে তিনটে উনুন ভেঙে দিতে পারল, কিন্তু খলনায়ক সত্যপ্রিয়কে কেন একটি চড়ে কুপোকাত করল না। এমন একটা বিষম পরিস্থিতিতে সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থানে তখনও স্বল্পপরিচিত সত্যপ্রিয় ঘোষ অগ্রণী-সম্পাদক প্রফুল্ল রায়ের বলিষ্ঠ দেহের পিছনে আত্মগোপনের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যে-হেতু তাঁর নামও ঘটনাচক্রে সত্যপ্রিয়, সহরতলী-র খলনায়কের নামের সঙ্গে সমতা তাঁকে ত্রস্ত করে তুলছিল! এমন নির্মল মজার ঘটনা যিনি পরে সকৌতুকে বর্ণনা করতে পারেন, তিনি যে সুরসিক সুলেখক তা নতুন করে বলে দিতে হয় না।

এই রসবোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সত্যপ্রিয় ঘোষের স্মার্ট, তীক্ষ্ণ গদ্যভঙ্গিমা, যা ফেনিল সুরার মতোই পানপাত্র থেকে উপচে পড়ছে সতত; যার প্রাণবেগ যেমন নির্বারিত স্রোতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তেমনই ফেনাও উৎপন্ন করেছে কম নয়। ফেনার কথা পরে হবে, আগে স্রোতের কথা। সত্যপ্রিয় ঘোষের বিপুলকলেবর প্রবন্ধ-সঙ্কলন এল চিন্তার প্রগল্‌ভ ঐশ্বর্য নিয়ে। গ্রন্থটির সুসম্পাদনা করেছেন অভ্র ঘোষ; গ্রন্থিত দু’টি প্রবন্ধের বই সাহিত্যের অধিকার এবং মানিকসাহিত্যের যুক্তিতর্ক-এর পাশাপাশি অগ্রন্থিত বহু প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার এই বইয়ের ধার ও ভার দুই-ই বাড়িয়েছে। ভূমিকায় সম্পাদক জানিয়েছেন সত্যপ্রিয়র সমস্ত রচনা ফিরে পাওয়া কত দুঃসাধ্য, এবং সঙ্কলিত প্রবন্ধগুলি আহরণ করাও এত দিনে কতখানি শ্রমসাধ্য হয়ে উঠেছে। তবু এই বিস্তর পরিশ্রমের কাজ যে অতি নিপুণতার সঙ্গে সম্পন্ন হতে পেরেছে, বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে তা বিশেষ সৌভাগ্যের।

সঙ্কলনের সর্বাধিক মহার্ঘ রচনা সলঝেনিৎসিন-সম্পর্কিত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। স্তালিন-উত্তর রাশিয়ায় ক্রুশ্চেভের আমলে যখন ‘নিস্তালিনীকরণ’ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে, ক্রমশ লৌহযবনিকার অন্তরাল হতে লেবার ক্যাম্পের ভয়াবহ নিপীড়নের চিত্র মুখ ফুটে বলার সাহস ও সুযোগ উপস্থিত, সেই ক্রান্তিকালে সলঝেনিৎসিন তাঁর উপন্যাস ও গল্পে স্তালিনীয় নিপীড়নের প্রকাশ্য ভাষারূপ দিয়েছেন। কী ভাবে তা সমকালীন রাশিয়া ও কালক্রমে সমগ্র বিশ্বমানবতাকে স্পর্শ ও বিদ্ধ করেছে, প্রশ্নাতুর করে তুলেছে, সত্যপ্রিয়র প্রবন্ধপঞ্চকে তা বিশদে বর্ণিত। সঙ্গে সঙ্গে কান্তিবিদ লুকাচ (সত্যপ্রিয় লিখতেন লুকাক্‌স) যে ভাবে সলঝেনিৎসিনের বিপ্লবী চরিত্রের মূল্যায়ন করেছেন, তাও তাঁর প্রজ্ঞাপ্রখর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এর আগেই অবশ্য এক প্রবন্ধে সত্যপ্রিয় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় লুকাচের দৃষ্টিভঙ্গির তুল্যমূল্য বিচার করেছেন। সেটিও ধরলে এই ছয়টি প্রবন্ধ সলঝেনিৎসিন-বিষয়ে আগ্রহী পাঠকের কাছে দিগ্‌দর্শী হয়ে উঠবে।

প্রবন্ধ সংকলনসত্যপ্রিয় ঘোষ,

সম্পা: অভ্র ঘোষ

৯০০.০০

বহুস্বর

‘বাংলা সাহিত্যে গোর্কির প্রভাব’ প্রবন্ধটিকে বাঙালির গোর্কি-চর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা যেতে পারে। কেন প্রথমে বাঙালি বিবুধমণ্ডলীর কাছে গোর্কি গৃহীত হননি, কী ভাবে ক্রমে এ বঙ্গভূমে তিনি আলোচিত হতে লাগলেন, প্রভাব বিস্তার করলেন, বলতে গিয়ে সত্যপ্রিয় সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের সালতামামি উপস্থিত করেছেন, যা এই লেখার জন্য খুব জরুরি ছিল। রাজনৈতিক বাস্তবতা কী ভাবে এক ভাষার সাহিত্য ও তার উপর ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার একটা স্পষ্ট ‘কেস স্টাডি’ আমরা পেয়ে যাচ্ছি।

এমন কেস স্টাডি এ বইয়ে আরও রয়েছে। পূর্বাশা-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও তাঁর সহমর্মী সত্যপ্রসন্ন দত্ত কুমিল্লা থেকে কলকাতায় চলে এসে যেন আক্ষরিক অর্থেই নিজেদের রক্তমাংসের বিনিময়ে পত্রিকাটি লালন করে চলেছিলেন। শিশু পত্রিকা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যপত্রিকা ও অমিত সম্ভাবনাধর কবি-গদ্যকারদের সূতিকাগৃহে পরিণত হয়, কিন্তু এই বিকাশের মূল্য পরিশোধ করতে হয় সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে নিঃশব্দ ও ক্রমাগত আত্মবিলয়ে। বাংলা সাহিত্যে স্বল্পালোচিত আত্মদানের এই ইতিবৃত্ত চারটি রচনায় তুলে ধরেন লেখক।

প্রাক্‌-কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট— জীবনের এই দুই পর্বে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টিসম্ভার সম্প্রতি আলাদা আলাদা করে অনুধাবনের প্রয়াস দেখা দিয়েছে। সত্যপ্রিয় শ্রম ও নিষ্ঠা সহকারে এই দুই পর্বের সমনোযোগ আলোচনায় দেখিয়েছেন, দু’টি পর্বই একই মানিকের দ্বিমুখী প্রকাশ। প্রাক্‌-কমিউনিস্ট পর্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝি ও কমিউনিস্ট পর্বের সেরা উপন্যাস সোনার চেয়ে দামী। প্রাক্‌-কমিউনিস্ট মানিক ও কমিউনিস্ট মানিকের ভিতর অভেদত্ব আবিষ্কারের সপক্ষে যুক্তিসম্মত আলোচনা করেছেন সত্যপ্রিয়, মানিক বিষয়ক দশটি প্রবন্ধে।

একই ভাবে বইয়ে শরৎচন্দ্র, নজরুল, তারাশঙ্কর, জ্যোতির্ময়ী দেবী ও রমেশচন্দ্র সেনের সাহিত্যকৃতি বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে মনোজ্ঞ আলোচনা পাই। পরবর্তী কালের বাংলা কথাসাহিত্যের— সত্যপ্রিয়র চোখে যা তখন ‘সাম্প্রতিক’— গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে গৌরকিশোর ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ও সাধন চট্টোপাধ্যায়ের লেখালিখি নিয়ে পৃথক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন; ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতিচারণ, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন নিয়েও কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলনের ‘অগ্রন্থিত’ অংশে অন্তর্ভুক্ত।

আগেই লিখেছি, সত্যপ্রিয় ঘোষের রচনাকৌতুকীতে ফেনিল প্রগল্‌ভতা আছে। তা যেমন এক দিকে পাঠসুখ দেয়, তেমনই কখনও কখনও পাঠককে লক্ষ্য থেকে কিঞ্চিৎ দূরে নিয়ে গিয়েও ফেলে। যেমন, ‘কথাসাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা’ রচনাটিতে সূত্রাকারে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ থেকে আহৃত এগারোটি বাক্য তিনি উদ্ধৃত করেন, কিন্তু তার বিস্তারিত ব্যাখ্যার দিকে না এগিয়ে বিশ্ববরেণ্য লেখক ও চিন্তাবিদদের সানুরাগ উল্লেখে রচনার ইতি টানেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি মূল্যবান, কিন্তু তা এই প্রবন্ধের শিরোনামের সঙ্গে সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পারে না। ‘এক খোলা মানুষ’ প্রবন্ধটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন্ত স্মৃতিচারণা হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু প্রাবন্ধিকের স্বাভাবিক রঙ্গপ্রিয়তার কারণে তার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছেন লেখকের বৈয়াকরণ পিতৃদেব। যদিও মণীন্দ্র ঘোষকে নিয়ে এ বইয়ে পৃথক প্রবন্ধ ‘বাবার জীবনে গান’ রয়েছে।

“বিভূতিভূষণের যা কিছু ভালো, তা কৈশোরস্বর্গ থেকে পতনের আগেই পড়ে ফেলা দরকার,” মন্তব্য করেছেন লেখক। ‘তারপরে সে-সব পাঠে... রসাস্বাদন বা সম্ভোগ অসম্ভব’— এই প্রতিজ্ঞাবাক্যটি লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন পথের পাঁচালী ও অপরাজিত-র আলোকে, ও বিভূতিভূষণের পরবর্তী কালের ‘অধ্যাত্মবিদ্যা ও অতীন্দ্রিয়বাদ’-এর প্রতি অনাস্থায়। কিন্তু বিভূতিভূষণের আদর্শ হিন্দু হোটেল, অনুবর্তন, অথৈ জল কেন তাঁর নজর এড়িয়ে গেল! তা ছাড়া পথের পাঁচালী বা অপরাজিত কি পুরোপুরি শৈশব-কৈশোরের ভূস্বর্গ? দারিদ্রের নিষ্পেষণ, গ্রাম ও শহরের অবিরত চলাচল, জীবনসংগ্রাম, শ্রেণিবৈষম্য, কিছুই চোখে পড়ল না? সাক্ষাৎকার অংশে আরণ্যক-ও সত্যপ্রিয় ঘোষের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি জানিয়েছেন, কেননা সেটি নাকি মনুষ্যবিবর্জিত অরণ্যপ্রকৃতির বিবরণসর্বস্ব। তা হলে যুগলপ্রসাদ, ধাতুরিয়া, দোবরু পান্না, মটুকনাথ, মুসম্মত কুন্তা, ভানুমতী— এরা কারা!

ভূমিকায় সম্পাদক জানান, “দাদা বরাবর বামপন্থী ছিলেন, তবে বিশেষ কোনো দলের সদস্য হতে রাজি ছিলেন না।” বামপন্থায় সত্যপ্রিয়র ধ্রুব বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের জমি থেকেই তিনি কথাসাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা, সমকালীন পূর্বকালীন সব শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের মুখর আলোচনা করেছেন। কোথাও ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত পাল্টাননি। ওই উপাস্য আলোর চারিপাশেই খদ্যোতের মতো অনিঃশেষ আরতি করেছেন। একই দৃষ্টিভঙ্গিতে অনড় থেকে এত বিচিত্র বিষয় অবতারণার ফলে সঙ্কলনের আট-দশটি লেখা পড়ার পর ক্লান্তি জাগে, পাঠবেগ মন্থর হয়ে আসে: তত ক্ষণে মনোযোগী পাঠকমাত্রেই লেখকের অভিপ্রায় ও অভিমুখ বুঝে নেওয়ার সময় পেয়ে গেছেন।

এ সব মৃদু অনুযোগ সত্ত্বেও বইটি অত্যন্ত মূল্যবান এ কারণে যে, তা আমাদের জানতে সাহায্য করে— একটা সময়কাল পর্যন্ত আমাদের পূর্বজ লেখকরা কী নিয়ে ভাবতেন, কেমন করে ভাবতেন।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy