তাঁর বিপুল রচনা কী ভাবে পাঠ করতে হবে, সে ব্যাপারে পাঠকদের উদ্দেশে মহাত্মা নিজেই বলছেন যে, তিনি নিজেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবুক হিসেবে তুলে ধরতে চিন্তিত নন। তিনি আসলে আগ্রহী সত্যের আহ্বান মেনে চলতে, যা তাঁর কাছে ঈশ্বরের আহ্বানের সমতুল। “ফলে যদি কেউ আমার দু’টি রচনার মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখেন, এবং তার পরেও আমার মানসিক সুস্থতায় বিশ্বাস রাখেন, তবে তিনি যদি একই বিষয়ে লেখা আমার দু’টি লেখার মধ্যে শেষেরটিকে গ্রহণ করেন, তবেই ভাল হয়।” (হরিজন, ২৯-০৪-১৯৩৩)
নিজের রচনা বিষয়ে এই অবস্থান যাঁর, সেই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী এবং তাঁর রচনা ও জীবন নিয়ে মতান্তর, বিপরীত ও বিচিত্র ব্যাখ্যার সমাহার ঘটবেই। এক এক জনের কাছে এক এক রকম মানুষ হিসেবে প্রতিভাত তিনি। তবে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় দুই মলাটের মধ্যে পনেরো জন বিশিষ্ট মানুষের চোখে দেখা নানা গাঁধীর ‘একখানা মালা’ পাইনি আমরা। এঁদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের জীবনকালে ভালবাসা, তর্ক ও সমালোচনায় গাঁধীজির সঙ্গে জড়িয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ থেকে দৃষ্টিবদল শুরু হয়ে এই বই পৌঁছেছে হাল আমলের ঐতিহাসিক ডেভিড হার্ডিম্যান-এ। মাঝে আছেন রোম্যাঁ রোলাঁ, মহম্মদ আলি জিন্না, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভীমরাও অম্বেডকর, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মানবেন্দ্রনাথ রায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলকুমার বসু, পান্নালাল দাশগুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, অম্লান দত্ত ও অশীন দাশগুপ্ত। গাঁধী-দর্শনের এমন বহুত্ববাচক ও অভূতপূর্ব তালিকা দেখে পাঠকের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। পাঠক ভাবেন, ‘অমুক’ মানুষটি এই গ্রন্থে কেন স্থান পেলেন না! যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কোনও প্রতিনিধি নেই। তন্নিষ্ঠ গাঁধীবাদীদের অনেকে (অ্যান্ড্রুজ়, মীরাবেন থেকে মহাদেব দেশাই) থাকতে পারতেন। সহিংস বিপ্লবে বিশ্বাসীদের কারও কারও লেখা থাকলে উল্টো আলোও পড়ত। মনে পড়ছে নির্মলকুমারের ছাত্র ও গাঁধী-গবেষক ডক্টর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা, বামপন্থী হয়েও যিনি তাঁর নিজস্ব অভিমতের পাশাপাশি গাঁধীর চিন্তাকে গাঁধীর মতো করে বুঝতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যা নেই, তার চেয়েও যা আছে, তা-ই বা কম কী? বরং লেখক যদি পরে এমন কিছু মানুষের গাঁধী-ভাবনা নিয়ে দ্বিতীয় একটি খণ্ড প্রকাশ করেন, সেই আশা রইল।