ভূমিকাতে লেখিকা বলেছেন, অনুবাদ নিয়ে ইংরেজিতে অনেক বই থাকলেও বাংলায় এই ধরনের বইয়ের অভাব ছিল; তা পূরণের প্রয়াসেই এই কাজে হাত দেওয়া। তেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত আলোচনা: অনুবাদের প্রয়োজন, প্রক্রিয়া ও সমস্যা, প্রকৃতি ও বৈচিত্র, কবিতার অনুবাদ, রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ-ভাবনা, রবীন্দ্রকবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে ব্যাকরণ, মেঘনাদবধ কাব্য-এর ইংরেজি অনুবাদের তুলনামূলক আলোচনা, জীবনানন্দের কবিতার অনুবাদ, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অনুবাদের নিবিড় পাঠ, নবনীতা দেব সেনের হাইকু অনুবাদ, রবীন্দ্রকবিতার ছবিতে অনুবাদ, পরিভাষা অনুবাদ এবং ভারতীয় কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন তিনি। এই ব্যাপ্ত পরিসরে তিনি কেবল বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গেই বদ্ধ থাকেননি, সাহিত্যিক অনুবাদেও সীমাবদ্ধ থাকেননি। চেক ফর্মালিস্ট রোমান ইয়াকুবসন তিন ধরনের অনুবাদ আলোচনা করতে গিয়েতৃতীয় ভাগে রেখেছেন ‘ইন্টার-সেমিয়োটিক’ অনুবাদ, অর্থাৎ যেখানে প্রকাশমাধ্যম পাল্টে যায়। লেখিকা সেই বিষয় এনেছেন রবীন্দ্রকবিতার ছবিতে প্রতিগ্রহণ প্রসঙ্গে। গ্রন্থে বর্ণিত স্থান-নাম ও পৃষ্ঠাঙ্ক তন্নিষ্ঠ পাঠককে সাহায্য করবে।
অনুবাদ এমন একটি পথ বা মাধ্যম, যা দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস এবং একটি ভাষা-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনের নানা পরিপ্রেক্ষিত বোঝা সম্ভব। অনুবাদ কেবল একটি পদ্ধতি বা সেই পদ্ধতিজাত উৎপাদন নয়, অনুবাদ হল ইতিহাসকে বোঝার একটা মাধ্যম। লেখিকা নিজে বাংলা কবিতার সমালোচক হিসাবে পরিচিত; তিনি জানাচ্ছেন, বাংলা কবিতার নিবিড় অধ্যয়ন করতে করতে তিনি উপলব্ধি করেছেন— অনুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা বা অনুবাদের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তিনি যে এতদিন অনুবাদ নিয়ে স্বতন্ত্র কোনও বইয়ের কথা ভাবেননি তার কারণ, অনুবাদচর্চা নিজে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জ্ঞানচর্চার পরিসর।
বইটি বুঝিয়ে দেয়, একটি বিশেষ ভাষায় লেখা কবিতার বিভিন্ন প্রবণতা বিষয়ে চর্চা করতে গেলেও অনুবাদের মতো প্রতিগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের আদান-প্রদান, এবং একটি বিশেষ সময়ের সাহিত্যের পরিসর কী ভাবে নির্মিত হচ্ছে তা বোঝা দরকার। ইংরেজিতে রচিত অনুবাদচর্চার বিভিন্ন আকরগ্রন্থ তিনি পড়েছেন এবং তা থেকে তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করেছেন অনুবাদ সম্পর্কিত আলোচনায়। এই বইয়ে তিনি অনুবাদের ধ্রুপদী ঘরানাকেই মূলত অনুসরণ করেছেন। অনুবাদতাত্ত্বিক ইউজিন নাইডা অনুবাদের সমস্যা হিসাবে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রেক্ষিত থেকে শব্দের সমানতার সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেন। লেখিকা সেই প্রেক্ষিত থেকেই মূলত কবিতার অনুবাদের আলোচনা করেছেন। একটি মূল পাঠ ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে কী ভাবে অনুবাদে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, তা তিনি বিভিন্ন কবির বিবিধ কবিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য যথার্থ অনুবাদের কথা প্রস্তাব করেছেন।
একটি ভাষার সাহিত্য শুধু সেই ভাষার জটিল পরিসর বা আবর্ত থেকে জন্ম নেয় না। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় যে মেধা রয়েছে তা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় সঞ্চারিত হবে সাহিত্যের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়েই। একটি ভাষার সাহিত্য আসলে গড়ে ওঠে অন্য অনেক ভাষার সাহিত্যের প্রভাব ও প্রতিগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কবিতা অনুবাদের নিবিড় পাঠের মধ্য দিয়ে লেখিকা অনুসন্ধান করেছেন অনুবাদের রাজনীতি, অনুবাদকের আদর্শগত অবস্থান এবং তুলনামূলক অনুবাদচর্চার পরিসর। ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘অজাগর’ শব্দটি কেন বুদ্ধদেব বসু ও কেতকী কুশারী ডাইসন দু’জনেই ব্যবহার করেছিলেন ‘নিদ্রিত’ অর্থে আর রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন ‘সাপ’ অর্থে। অনুবাদ কেবল অনুবাদিত বইয়ের সারবস্তু দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করে না, পাঠকের নিজস্ব ভাষার যে গতি ও জটিলতা তার মধ্যে প্রবেশের মজা জাগিয়ে তোলে। আধুনিক ইউরোপীয় কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তও এ দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
নজরুলের কবিতার অনুবাদ পাকিস্তান-পূর্ব ও পাকিস্তান-উত্তর সময়ে কী ভাবে পাল্টে পাল্টে গেছে, উল্লেখ করেছেন লেখিকা। ইঙ্গিত করেছেন, কী ভাবে দেশভাগের মতো রাজনৈতিক ঘটনা অনুবাদের পরিসরকে প্রভাবিত করে। অনুবাদচর্চায় এ যেমন একটি প্রেক্ষিত হতে পারে, তেমনই দেশভাগ-চর্চাতেও অনুবাদের রূপান্তর একটি পরিসর হতে পারে। নজরুলের কবিতাকে পাঠক দেশভাগের কবিতা হিসাবে পড়েন না, কিন্তু নজরুলের কবিতার অনুবাদ আসলে দেশভাগের সাহিত্য হয়ে ওঠে। এ ভাবে অনুবাদ হয়ে ওঠে আন্তর্বিদ্যক, আন্তঃসাংস্কৃতিক। অনুবাদের মধ্য দিয়ে এ ভাবে একটি পাঠের নতুন জন্ম তৈরি হয় এবং একটি সাহিত্য প্রবেশ করে ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির নতুন নতুন বৃত্তে। অনুবাদ যে এক পাঠ-প্রকল্প, পাঠ-রাজনীতি এবং পাঠ-প্রক্রিয়া, লেখিকা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষ ভাবে।
বইটিতে তত্ত্বের উপরে বিশেষ জোর না থাকলেও, লেখিকা নানাবিধ তাত্ত্বিক প্ররোচনা তৈরি করেছেন। অনুবাদচর্চার নবীন পাঠকদের কাছে, বা অনুবাদ নিয়ে যাঁরা তার্কিক ভাবে ভাবতে ভালবাসেন তাঁদের এই বই কাজে দেবে। বাংলা সাহিত্য পাঠের নতুন পাঠ্যক্রম নির্মাণের আদর্শগত দাবিও বলা চলে বইটিকে।
মৃন্ময় প্রামাণিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy