বহু দশক আগে, কৈশোর পেরোতে পেরোতে, হাতে এসেছিল এক অভিনব বই। নাম, এ অস্থির জাগরণে। কবি শংকর চক্রবর্তী। কবিতার হাত ধরাধরি করে ছিল পরাবাস্তবস্পর্শী ছবি। এঁকেছেন ময়নূল হক বড়ভুঁইয়া। সে যুগে ছবি-কবিতার এমন চমকপ্রদ যুগলবন্দি খুব সহজলভ্য ছিল না। সে-বয়সে কেমন, কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম জানি না, তবে বইটি নিয়ে কাটিয়েছি অনেকখানি সময়। এই সব পঙ্ক্তি মনে তরঙ্গ তুলেছিল খুব— “রহস্যের কমণ্ডলু ভরে যায় জলে আজীবন,” কিংবা “যেন দিনগুলি/ রাঙামাটি দিয়ে গড়া বিস্তৃত মেঘের স্বাধীনতা,” অথবা “এই গৃহস্থের ঘরে/ নিঃসঙ্গতা আছে, জল নেই, শুধু অলৌকিক রোদ ও পাহাড় ঢুকছে প্রতিদিন...” ইত্যাদি।
তখন জানতাম না এই বইটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশিত ১৯৮২ সালে। এই কবির প্রতি আগ্রহের প্রধান কারণ ছিল তাঁর ভাষা। প্রতীকপ্রধান, সঙ্কেতনির্ভর আর পর পর কারুকার্যময় পার্থিব-অপার্থিব চিত্রকল্পে গাঁথা। লাইনের পর লাইনে চাপ এবং প্রবাহে উঠে আসে নানা অভ্যন্তরীণ আলোড়ন। সমকাল, সংবাদ বিচিত্রা কিংবা ঘটমান তাঁকে একেবারেই টানে না। এই কবিকে খুঁজে পেতে শুরু করি সত্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ কৌরব-এ, সেই সূত্রে ঝর্নাকলম সঙ্কলনে (২০০২), অন্যান্য পত্রপত্রিকায়। সম্প্রতি তাঁর সমগ্র কবিতার তিনটি খণ্ড হাতে এল।
কোনও সন্দেহ নেই, শংকর চক্রবর্তী বহুপ্রজ কবি। এই সংগ্রহ তিনটিতে সঙ্কলিত হয়েছে কবির ২৩টি কাব্যগ্রন্থ। শেষতম, ঢ্যাঙা খাটো পৃথুলার খেলা (২০২১)। তার আগের কাব্যগ্রন্থ, আহা, শত্রু খুঁজে নাও প্রকাশিত হয়েছিল একই বছরে। এক সঙ্গে কবিতাগুলি পড়লে তাঁর ধারাবাহিকতাকেও তারিফ করতে হয়। খুব আমূল ভাঙাচোরা বা পরীক্ষার চমকপ্রদ নতুন পথ তিনি খনন করতে চান না বটে, তবে অন্তঃশীলা ধারার মতো তাঁর কবিতা নতুন নতুন অনুভূতিদেশের দিকে যাত্রা করে চলে।
শংকর চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ গুলির নামও মায়াময় এবং এক ধরনের অভিযাত্রারই সঙ্কেতবাহী। তাঁর জাগরণ অস্থির তো বটেই, কিন্তু তার মধ্যে এক চলমানতা আছে। ফলে, টুকরো অন্ধকার, ভাঙা-ভাঙা নানা উন্মোচন, অস্তিত্ব, চেনা-অচেনা ভূগোলের ছায়া, আত্মকথন-আত্মমগ্নতা, দীর্ঘশ্বাস আর পরিভ্রমণের জানলা তাঁর কবিতাকে আলাদা এক স্বাদগন্ধ দিয়েছে। বইয়ের নাম থেকে কয়েকটি লক্ষ করা যাক— মেঘপাহাড়ের দিনগুলি, এমন জলের সঙ্গে কতদূর, ফেলে আসা আধকাপ চা, রাস্তা গেছে বাদামতলায় অন্যটি সাহাগঞ্জ প্রভৃতি। অবিরাম তাঁর চিত্রকল্পগুলিও উৎসারিত এবং বাস্তবকে নির্মাণ করতে থাকে। এ যেন এক উভমুখী খেলা। তাঁর কবিতার নামও হয়ে উঠতে থাকে সঙ্কেতমুখী, কখনও কখনও ভাষ্যধর্মী। যেমন, ‘জ্বলে স্থির ছবি যেন রঙের ভিতরে’, কিংবা ‘আমার পা’, ‘বনকুসুমের কথা’ অথবা ‘ডাকটিকিটের রঙ’, ‘দূরের যে দৃশ্য’ প্রভৃতি। যাকে সাধারণত দীর্ঘ কবিতা বলা হয়, তার থেকে সাধারণত দূরত্ব রাখেন শংকর চক্রবর্তী। ছোট, সীমিত পরিসরে এক-একটি পঙ্ক্তিতে টানা বহুত্বময় চিত্রশালা, শব্দবারুদ ঢুকিয়ে তাকে ফুটন্ত করে তুলতেই তাঁর অভীপ্সা। এই প্রয়াসই নানা বিভঙ্গে পূর্বাপর তাঁর কাব্যগ্রন্থে স্পষ্ট হয়ে আছে। তিনি কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন না, ফলে আবার এই প্রয়াসে লিপ্ত হন। এমনকি টানা গদ্যেও চলে আসেন এই চাপে।
কবিতাসংগ্রহ ১, ২, ৩
শংকর চক্রবর্তী
১২০০.০০ (একত্রে)
আলোপৃথিবী
কবিতা বিষয়ে মন্তব্য করতে করতে ছোট একটি রচনায় জানিয়েছিলেন ওয়ালেস স্টিভেন্স, কবিরা তাঁদের সঙ্কেতে-চিত্রকল্পে যে অদ্ভুত পৃথিবী গড়েন তার বাস্তবে ঢুকলে অনেক সময় চার পাশের দুনিয়াটাকেই অবিশ্বাস্য লাগে। যে-সব কবি ঘটমানতা থেকে অন্দরমহলে ডুব দিয়ে নানা বিমূর্ত অনুভূতিকে ছোঁয়াছুঁয়ি করেন, তাঁদের সমগ্র কবিতাপ্রয়াস পড়তে পড়তে মনে হয় এক রহস্যজগতে ঢুকে পড়েছি। “রিলং নদীর জলে দলবদ্ধ মাছ মৃত ভেসে উঠেছিল তাও জানি/ পাশের পাইন বনে আগুন লাগলেই যে নতুন আকাশ অন্য রঙে সেজে ওঠে/ শেষবার/ সেদিন কি পূর্ণিমার, লবণ সত্যাগ্রহের দিন?”
নিরুপিত ছন্দবন্ধে খুব আগ্রহ এই কবির নেই, ঝঙ্কারেও আসক্ত নন। গদ্যস্পন্দে মিশ্রকলাবৃত্তের চালেই তাঁর ক্রমাগত স্থিতি। তবে ‘আমি’ আর ‘আমার’ থেকে ‘তুমি’ আর ‘তোমার’ দিকে যাওয়ার একটা নিভৃত পথ আছে। তৃতীয় খণ্ডে এই পরিবর্তন বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ‘তুমি’ কখনও কবির নিজস্ব সত্তা, কখনও ‘অপর’। “ওগো ভোরবেলা আজ কি চিনতে পেরেছো তাকে/ বহুদিন পর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে তোমারই জন্মদিন।” (‘জন্মদিন’)। ‘সুস্থ হওয়ার আগে’ কবিতায় তাঁর স্বভাবের বাইরে গিয়ে চকিতে ঢুকে পড়ে ‘করোনার বাড়ি’। তবে সে নিতান্ত ব্যতিক্রম।
ময়নূল হক বড়ভুঁইয়ার একটি ছবির কথা বলে শেষ করি। ‘টুকুনের ঘর’ শীর্ষক কবিতার সঙ্গে ছাপা হয়েছিল সাদা-কালো স্কেচধর্মী এই ছবি। এক নগ্নিকা। রহস্যময় আলোছায়া। হাতে সাদা ফুল। পাশে জানলার দমকা আলোকময়তা। ছবিটি খুব সন্তর্পণে কবি শংকর চক্রবর্তীর ভুবনকে প্রতিবিম্বিত করে। সেই পরাবাস্তব, সেই দপ্ করা রোদ, মেঘ, জানলা এবং ভালবাসা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)