Advertisement
E-Paper

পাশে দাঁড়ালে সাহানারাও পারেন

শি ল্প নিয়ে আকচাআকচির সুবাদে আমরা সবাই প্রচুর তত্ত্ব জেনে গিয়েছি। কিন্তু এই সব কচকচি আর বাস্তবের মধ্যে যে ফারাক, তা সাহানা সর্দাররা বোঝেন নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই। উত্তর মাকালতলা গ্রামের সাহানা সর্দারের বিয়ে হয়েছিল, গ্রামের আর চারটে মেয়ের মতো, খুব কম বয়সেই।

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১৪
চন্দ্রশেখর ঘোষ

চন্দ্রশেখর ঘোষ

শি ল্প নিয়ে আকচাআকচির সুবাদে আমরা সবাই প্রচুর তত্ত্ব জেনে গিয়েছি। কিন্তু এই সব কচকচি আর বাস্তবের মধ্যে যে ফারাক, তা সাহানা সর্দাররা বোঝেন নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই। উত্তর মাকালতলা গ্রামের সাহানা সর্দারের বিয়ে হয়েছিল, গ্রামের আর চারটে মেয়ের মতো, খুব কম বয়সেই। ঘুটিয়ারি শরিফের অন্য বিবাহিত মেয়েদের মতোই, সন্তান আসতেও দেরি করেনি সাহানার জীবনে। সন্তানের দু’বছর বয়সে ঘরে সতিন ঢোকে। শুরু হয় সাহানার উপর অত্যাচার। গল্পটা চেনা।

সাহানা সন্তান-সহ ফেরেন বাপের বাড়িতে। দাদাদের ঘাড়ে চাপে একটা নতুন মুখের অন্ন যোগানোর চাপ। সাহানা ও তাঁর সন্তান, তাঁর নিজের পরিবারেও ব্রাত্য হয়েই ফেরেন। কাজ পান গ্রামের কাছেই এক প্লাস্টিক কারখানায়।

কারখানাটি প্লাস্টিকের দস্তানা তৈরি করে। কিছু হাসপাতাল সেগুলো ব্যবহার করে, আবার দোকানে চুলের কলপ কিনলে সেগুলো ফ্রি পাওয়া যায়। দস্তানা তৈরির কর্মীর দলে নাম লেখান সাহানা। মাসে ৪০০ টাকা বেতন।

সাহানার এক দাদা একই কাজ করেন কলকাতায়। বেতন সাহানার বহু গুণ। তাত্ত্বিকরা বলবেন লিঙ্গবৈষম্য। তা বলুন, কিন্তু সাহানার পরিস্থিতি তো তাতে বদলায় না। তিনি তো সেই তিমিরেই। এবং তিনি তা মানতে পারেন না। এই না-মানার জায়গা থেকেই তৈরি হয় এক উত্তরণের ভিত।

সাহানার সঙ্কটমুহূর্তে ত্রাতার ভূমিকা নেয় ‘বন্ধন’। ব্যাঙ্ক নয়। বন্ধন কোন্নগর। একটি অসরকারি প্রতিষ্ঠান। অধুনা বন্ধন ব্যাঙ্ক-খ্যাত চন্দ্রশেখর ঘোষের প্রথম পদক্ষেপ।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস। ১২ তারিখ। শুরু হয় সাহানার সংগ্রাম। বন্ধন তাঁকে প্রাথমিক মূলধন দেয়, মনোহারি দোকান শুরু করার জন্য। আট হাজার টাকার মতো। কিন্তু সাহানার কাছে তার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। বাবার কাছ থেকে এক চিলতে জমি পান সাহানা দোকান করার জন্য। আর বন্ধন ধরে থাকে হাত। শেখায় হিসাব লিখতে এবং রাখতে। কখন কাঁচা মাল আনতে হবে, কতটা মাল জমিয়ে রাখা যেতে পারে। বেশি রাখলে ক্ষতি কেন, এই সব।

সাহানার সঙ্গে আমার দেখা এই বছরের অগস্ট মাসে। এই দু’বছরে সাহানা নিজেকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছেন ওই মাত্র আট হাজার টাকার পুঁজি ব্যবহার করে। নিজের আর মেয়ের প্রয়োজন মিটিয়ে, তিনি মাসে হাজার তিনেক টাকা বাঁচান। দোকানে দুটো রেফ্রিজারেটর। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকা সরিয়ে রাখছেন। গড়াচ্ছেন গয়নাও। ‘দেখুন’, বলে গর্বের সঙ্গে খাতা খুলে দেখিয়ে দিলেন, ১ লক্ষ ২৭ হাজার ১৪১ টাকার লাভ তিনি কী ভাবে করলেন।

এটা একজন বুদ্ধিমতী মহিলার উত্তরণের কাহিনি হিসাবে সরিয়ে রাখা যেত। কিন্তু বন্ধনের হাত ধরে সাহানা পাকা শৌচাগার করেছেন, বাকি সরকারি সুযোগ কী আছে— তাও খুঁজছেন। মনে পড়তে পারে, এই বন্ধনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি এই কাজ করবেন বলে এক সময় স্বেচ্ছায় দারিদ্রকে বরণ করে নিয়েছিলেন। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বন্ধন— দ্য মেকিং অব আ ব্যাঙ্ক বইটিতে লিখছেন, সন্তানকে ডিম খাওয়ানোর পয়সাও ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতত্ত্বের এই ছাত্রটির।

তবে কি এটা বন্ধনের গল্প? না। এই কাহিনি সক্ষমতার। প্রতিবন্ধকতা পেরনোর। চন্দ্রশেখর যা করেছেন তা সাধারণ নয়। এবং সবাই তা পারবেও না। সাহানার গল্পও সাধারণ নয়। কিন্তু সাহানার গল্প আমাদের শেখায়, প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য দারিদ্র দূর করার পথে কতটা রসদ জোগায়। তত্ত্বের জ্ঞানের সঙ্গে, বাস্তববোধ এবং মানবিক দরদ মেশালে, বহু সাহানা তৈরি করা সম্ভব। বন্ধন নিজেই ২০ হাজারের বেশি সাহানাকে নিয়ে কাজ করছে। এনজিও-রা একে বলেন ‘এমপাওয়ারমেন্ট’। আমরা বলি সক্ষমতা।

আসলে, একটা কারখানা তৈরি হলেই স্থানীয় লোকের বেকার সমস্যা মিটে যায় না। হয়তো ওই লোকেদের সেই কারখানায় কাজ করার দক্ষতাই নেই। তখন কারখানার মালিক কী করেন? শ্রমিক নিয়ে আসেন বেঙ্গালুরু থেকে! তা হলে ওই স্থানীয় মানুষগুলোর কী হবে? সারা জীবন তাঁরা আর্থিক মানচিত্রে ব্রাত্য হয়েই থেকে যাবেন? না কি, তাঁদের সক্ষম করা চেষ্টা করা হবে? তাঁদের হাত ধরতে হবে?

দারিদ্রের ভয়ানক আবর্তের মধ্য থেকে বেরোতে প্রয়োজন এই হাত-ধরা। এটা আমলারা পারবেন না। সরকারি লালফিতে সাহানাদের পায়ে বেড়ি হয়ে থাকবে। সাহানাদের প্রয়োজন এই সক্ষমতা তৈরির পথে হাত ধরার প্রতিষ্ঠানের। সেটা পারে বন্ধনের মতো অসরকারি সংস্থারাই।

বন্ধন/ দ্য মেকিং অব আ ব্যাঙ্ক।

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

র‌্যান্ডম হাউস, ৪৯৯.০০

Bandhan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy