আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা তথা রাজ্য জুড়ে যে নাগরিক আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল গণবিপ্লবের ইতিহাসে তা স্মরণীয়। এই সময়ের ঘটনাবলি, পত্রপত্রিকায় তার বিশ্লেষণ, আন্দোলনের সূত্রে পাওয়া স্লোগান, গানগুলি সঙ্কলিত করার প্রয়োজনীয় কাজের ফসল এই বই। দ্রোহপর্বে আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত একগুচ্ছ প্রবন্ধের পাশাপাশি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির লেখাও সংযোজিত, ঠাঁই পেয়েছে সমাজমাধ্যমে উগরে দেওয়া সাধারণ মানুষের রোষবহ্নির চিহ্নও। হুমকিতন্ত্র কী ভাবে সর্ব স্তরের মানুষেরই জীবন বিপন্ন করেছে, ধরা আছে কোনও লেখায়। ফুটে উঠেছে মিছিলে আসা শ্রমজীবীদের ক্লিষ্ট মুখচ্ছবি, জীবনসংগ্রামের খতিয়ান। দুর্নীতির পর্দা সরিয়ে বিপ্লবের সলতেয় অগ্নিসংযোগ করেছিল, এমন অন্তঃতদন্তমূলক প্রতিবেদনগুলিও মুদ্রিত। অপরাজিতা বিলের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষণ, বিলে ফাঁকির জায়গাটির ব্যবচ্ছেদও ধরা পড়েছে— ডাক্তারের অন্তর্দৃষ্টিতে ঘুণ ধরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রত্যক্ষ বিবরণও।
দ্রোহকালের দলিল
সম্পা: মোহিত রণদীপ, শুভ প্রতিম
২৫০.০০
আমরা
‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বিষয়ে বই, লেখালিখির অভাব নেই। সমসাময়িক আলোচনায়, প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণে, প্রকাশিত সংবাদে, নেতৃস্থানীয়দের ভাষণে জড়িয়ে ছিল ১৯৪৬-এর অগস্টের সেই নৃশংসতা, পরে সাহিত্যের পাতাতেও জায়গা করে নেয়। অঞ্জন বেরার বইটি সেখানে শুধুই ঘটনাপরম্পরা তুলে ধরে না: তৎকালীন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট বঙ্গীয় আইনসভায় দাঙ্গার আগে সদস্যদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা, ১৬ অগস্টকে মুসলিম লীগের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা সম্পর্কিত উদ্বেগ ও সদস্যদের বাদানুবাদকে তিনি যেমন বইয়ে জায়গা দিয়েছেন, তেমনই দাঙ্গা-পরবর্তী আইনসভায় বিরোধীদের আনা মুলতুবি প্রস্তাব ঘিরে বিতর্কও তুলে ধরেছেন। রেখেছেন দাঙ্গা প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের বক্তব্য, লেখা, কাগজের বিবরণও। এক প্রত্যক্ষদর্শীর লেখনীতে উঠে এসেছে মর্মন্তুদ চিত্র: “খুনেদের দলে আমাদের গাঁয়ের খুবই পরিচিত একজন... যার লাশ সে বহন করছিল সে আর কেউ নয়— রবীনের মেজ বোন।... ফ্রক পরা ফুটফুটে বালিকাই ছিল ওদের শেষ শিকার।” আজ যখন ভারত আবারও এক সাম্প্রদায়িক দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতির সম্মুখীন, ছেচল্লিশের দাঙ্গাকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। বইটি সে পথে সহায়ক হবে।
গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ১৯৪৬: বাংলা আইনসভার বিতর্কে বয়ান প্রতি-বয়ানের দ্বন্দ্ব
অঞ্জন বেরা
৫৫০.০০
গাঙচিল
১৩৩২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের গীতগ্রন্থ প্রবাহিণী। তাতে ছিল ২৩৫টি গান, সিংহভাগ গানের রচনাকাল ১৯১৫-র সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২৫। তত দিনে, সেই ১৮৮৪ সাল থেকেই একে একে বেরিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের নানা বই: ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, রবিচ্ছায়া, গানের বহি ও বাল্মীকি প্রতিভা, গান, বর্ষামঙ্গল ইত্যাদি; আবার ১৮৭৬ থেকে ১৯০৮ সময়কালে অন্য সম্পাদক-সঙ্কলকদের উদ্যোগে প্রকাশিত নানা গানের বইয়েও স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের কিছু গান। গীতগ্রন্থের এই সম্পূর্ণ চিত্রটিতে প্রবাহিণী-র স্থানটি বিশেষ গুরুত্বের— এর কয়েক বছরের মধ্যেই বেরোবে গীতবিতান-এর প্রথম সংস্করণ। এই সময়ে নিজের গানের বইয়ে গানের নির্বাচন ও বিন্যাস-ভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা আগের থেকে অনেক পাল্টেছে, তার প্রতিফলন মেলে প্রবাহিণী-তে। ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ জানান, এই বইয়ের গানগুলি গীতিকাব্য রূপে পড়া যেতে পারে। এই বইয়ে গানের পর্যায়-বিন্যাসটিও সুস্পষ্ট রূপ পেল, আবার অন্য দিকে গানগুলিতে রাগ-তালের উল্লেখ বর্জিত হল। দীর্ঘ, সংহত ভূমিকায় মুগ্ধ মজুমদার স্পষ্ট করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতগ্রন্থগুলির মধ্যে প্রবাহিণী-র অবস্থান ও ভূমিকা, গানগুলির পাঠভেদও বুঝিয়ে দিয়েছেন যথাস্থানে। জরুরি কাজ।
রবীন্দ্রনাথের প্রবাহিণীসম্পা: মুগ্ধ মজুমদার
৬২৫.০০
খসড়া খাতা
সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে চলা দুর্নীতি, আর তার জেরে তৈরি হওয়া সঙ্কট ও বিপন্নতার প্রেক্ষিতে দ্রোহ এক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, সঙ্গত প্রতিরোধ। কিন্তু রাজনৈতিক দ্রোহ যদি নৈতিকতা দ্বারা চালিত না হয়, তা হয়ে পড়ে স্বার্থ, ক্ষমতা, লোভের রাজনীতিরই শিকার। তাই দরকার ‘নৈতিকতার দ্রোহ’। এই ধারণাটিই বইয়ের নানা নিবন্ধে স্পষ্ট ও বিস্তৃত করেছেন অভ্র ঘোষ। চারটি উপবিভাগে বিন্যস্ত উনিশটি নিবন্ধ, উপবিভাগগুলির মুদ্রিত শিরোনাম না থাকলেও নিবন্ধের বিষয়ই সেখানে সাযুজ্যের ধরতাই। দুর্নীতি ও আধিপত্যের রাজনীতির মুখে মানুষের বিপন্নতা কী করে কখনও ভাববাদ কখনও বস্তুবাদ আঁকড়ে দ্রোহ জাগিয়ে তুলেছে, তার খোঁজ করেছেন লেখক। বামপন্থী রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন ভাবনার আলোয় কাছে-দূরের ইতিহাস পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি উপনীত হন বর্তমানে, সামাজিক-রাষ্ট্রিক নৈতিকতার অমোঘ প্রয়োজনীয়তায়— রবীন্দ্রনাথ যে রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা মনে করিয়ে দেন আমাদের, প্রসঙ্গক্রমে আসে গান্ধীর ‘গ্রামস্বরাজ’-এর কথাও। শিল্প-সাহিত্য ও মেধার পরিসর কেমন করে গ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে, অধুনা-বহুচর্চিত এই বিষয়টিও আলোচিত কয়েকটি নিবন্ধে। রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের বয়ানে ধর্ম ও তার হাত ধরে ঘৃণা কোন পথে আবশ্যিক শর্ত হয়ে উঠল, রয়েছে তার ছানবিনও: বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এক তথ্যচিত্রে বৃদ্ধার হাহাকারেই যার গোড়ার কথাটি: “হায় রাম, তোমার শেষে এই দশা হল যে, অন্যের বাড়ি ভেঙে তোমায় বাস করতে হয়?”
নৈতিকতার দ্রোহ
অভ্র ঘোষ
৪০০.০০
অক্ষর
“তোমার চোখের পাতা এত ওঠাপড়া করে কেন?” জিজ্ঞেস করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কী করা যায়, প্রশ্নে সুরাহাও জুগিয়েছিলেন: ‘মিরর এক্সারসাইজ় করো’। পঙ্কজ সাহার সঙ্গে ওতপ্রোত কলকাতা ও কলকাতাবাসীর দূরদর্শন-যাপন, সেই জীবনকথাই তিনি লিখেছেন এই বইয়ে। সেই সূত্র ধরেই এসেছে নানা গুণী ও মানীর কথা: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অন্নদাশঙ্কর রায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে অমর্ত্য সেন জ্যোতি বসু, আরও কত জন। সুপণ্ডিত গোলাম মুরশিদের স্বভাবের ‘সুন্দর এক গৃহিণীপনা’র জন্যই ‘আমরা জর্জদার গাওয়া এমন সুন্দর সব গান উপহার পেয়েছি’, জানিয়ে দেন লেখক; এডিটিং টেবিলে শঙ্খ ঘোষের ‘চলচ্চিত্রবোধ’ দেখে কেমন তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় এডিটর, সেই চমকপ্রদ কাহিনিও। অনায়াস সুখপাঠ।
দূরদর্শন নিকটদর্শন
পঙ্কজ সাহা
২৫০.০০
লালমাটি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)