Advertisement
E-Paper

এই কলকাতা বাঙালির হারানো ঠিকানা

কিশোরী কৃষ্ণা তাঁর রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে দেখেন দুর্ভিক্ষের কলকাতা। বাঁচার আশায় পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ জীর্ণ, অতিজীর্ণ মানুষের খাদ্যাভাবে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য। ‘একটু ফেন দাও’ বলে সেই মর্মান্তিক ডাক।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ ২৩:১৭
লস্ট অ্যাড্রেসেস, কৃষ্ণা বসু। নিয়োগী বুকস, ৪৫০.০০

লস্ট অ্যাড্রেসেস, কৃষ্ণা বসু। নিয়োগী বুকস, ৪৫০.০০

খিদের কত বিচিত্র রূপ! উনিশশো তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের অনেক ছবি দেখেছি আমরা, ক্ষুধাশীর্ণ ক্লিষ্টতার সে সব ছবির দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভয় লাগে, যন্ত্রণা হয়, এমনকী বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয়। পাশের ছবিটি স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো। সারে সারে মানুষ কলকাতার রাজপথে। বুভুক্ষু মানুষ আরও একটু বিশৃঙ্খল হতেই পারত। কিন্তু হয়নি। মৃত্যুর থেকে এক পা পিছিয়ে থেকেও এই দলবদ্ধ শৃঙ্খলা চুপ করিয়ে দেয়। যে প্রবলতম যন্ত্রণা অভিযোগ বা বিক্ষোভ অতিক্রম করে যায়, তার সামনে আর কোনও অনুভব থাকে না, নীরবতা ছাড়া।

ঠিক এই রকম আর একটি ছবি, শব্দে লেখা ছবি, পেলাম কৃষ্ণা বসুর বইটিতে। সেও ১৯৪৪ সালের কলকাতার রাস্তার ছবি। কিশোরী কৃষ্ণা তাঁর রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে দেখেন দুর্ভিক্ষের কলকাতা। বাঁচার আশায় পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ জীর্ণ, অতিজীর্ণ মানুষের খাদ্যাভাবে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য। ‘একটু ফেন দাও’ বলে সেই মর্মান্তিক ডাক। ভেবে অবাক হন, এরা কেন ‘ফেন’ চায়, কেন ‘ভাত’ বা ‘খাবার’ চায় না? চাইলে পাবে না, সেটা জেনেই কি? এক দিন দেখেন, উল্টো দিকের বাড়ির সামনে কঙ্কালসার মানুষগুলোর লম্বা লাইন। ওই বাড়ি থেকে রুটি দিচ্ছে, তাই ঠেলাঠেলি। এ দিকে পাশেই পাড়ার দেশপ্রাণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, তাতে সারে সারে সাজানো সন্দেশ, রসগোল্লা, অমৃতি। মানুষের মিছিল এগোতে এগোতে দোকানের দিকে তাকিয়ে একটু মন্থর হয়, অপলক চেয়ে থাকে। তার পর চলে যায় ফেন চাইতে চাইতে। ভাঙাভাঙি করে না, লুটপাট করে না। লেখক আর কিছু বলেন না, কিন্তু আমরা ভাবি। কেন এই শৃঙ্খলা? চাইলে পাবে না বলেই?

এই সব ছবি কী বলে কলকাতা বিষয়ে, সে সব বিশ্লেষণের কথা। কিন্তু ছবিগুলো পেলে যে আমরা নিজেদের ইতিহাসটাকেই আবার নতুন করে চিনি, সন্দেহ নেই। কৃষ্ণা বসুর আত্মজীবনী বইটি এই জন্যই অত্যন্ত মূল্যবান। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তাঁর জীবনের কাহিনি ধরা এতে, নানা বাসস্থানের পর্বে পর্বে ভাগ করা। মুগ্ধ করে বইয়ের নামটি। ‘লস্ট অ্যাড্রেসেস’, ‘হারানো ঠিকানা’ (এই নামেই বাংলা বইটি বেরিয়েছিল তিন বছর আগে, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে)। আক্ষরিক ও প্রতীকী দুই অর্থেই নামটি সুন্দর। নিজের পুরোনো বাড়িগুলির মধ্যে হারানো জীবনের কথা তো রইলই। আর রইল কলকাতা ও বাংলার একেবারে অন্যরকম দিনগুলোর কথা। সেটাও বাঙালির হারানো ঠিকানা বই কী!

দুর্ভিক্ষের কলকাতা কেমন ছিল, কিছু ধারণা আমাদের আছে। কিন্তু পাশাপাশি ১৯৪৪-৪৫ সালেই যে আরও কত কী ঘটছিল এই শহরে, ইতিহাস বইতে তার খোঁজ মেলে না। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-র উপর বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি ‘কবিতা ভবন’ ছিল নতুন বাংলা সাহিত্যের আখড়া। ওই রাস্তাতেই স্ত্রী মীরার সঙ্গে রোজ হেঁটে বেড়ান গানের বিস্ময়পুরুষ শচীনদেব বর্মন, তখনও তিনি বম্বে পাড়ি দেননি। শিল্পী গোপাল ঘোষও কাছাকাছি থাকেন। আরও অনেকের সঙ্গে মিলে প্রদোষ দাশগুপ্ত তৈরি করছেন মডার্নিস্ট শিল্পীদের ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। বছরখানেক আগে মুক্তি পেয়েছে প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘শেষ উত্তর’। কিশোরী কৃষ্ণা ‘তুফান মেল’ আর ‘আমি বনফুল গো’ গানের প্রেমে পড়ছেন। হিন্দুস্থান পার্কের ‘ভালবাসা’ বাড়িতে এক বছরের মিষ্টি মেয়ে নবনীতা দেব-এর জন্মদিন পালন করতে যাচ্ছেন।

অল্প কিছু দিন পরেই এই সব রাস্তাতেই এখানে ওখানে মার্কিন সৈন্যদের টহল দিতে দেখা যাবে। শুধু টহল কেন, ইভটিজিং-এও সেনারা সমান ওস্তাদ! কলেজগামিনী দিদির সঙ্গে হেঁটে আসছেন কৃষ্ণা, হঠাৎই এক মার্কিন তরুণের ‘বিশেষ’ উৎসাহ প্রদর্শন। বাঙালি বাড়িতে বেড়াতে এসে সুদূর অতলান্তিক-পারের অন্য এক ছেলের মন-খারাপ, সে যে দেশে ফেলে এসেছে তার স্ত্রী-কন্যা! বিষাদের পাশে বিলাসও আছে। বালিগঞ্জ লেক-এর পাশের নিরালা রাস্তাটিতে নানা রংঢং-এর মহিলা সমভিব্যাহারে মার্কিন সেনাদের এলিয়ে পড়ার ছবি, যা দেখেও-না-দেখে পাশ কাটিয়ে যান বাঙালি ভদ্রলোকরা।

অবশ্যই একটা ‘উঁচু’ জায়গায় না থাকলে এই সব ছবি কেউ দেখতে পান না। সামাজিক ভাবে কতটাই এলিট পরিবারের কন্যা কৃষ্ণা, তাঁর পরিবারের দিকে এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়— তাঁর একান্ত নিজের চৌধুরি-গৃহ, বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত সুভাষ-শরৎ-শিশির-ধন্য বসু পরিবার নয়! বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরি সুপণ্ডিত মানুষ। কন্যাকে এমন শেক্সপিয়র পড়ান যে স্কুলের দিদিমণিরা ভাবেন, বাবা অনেক দিন লন্ডনে কাটিয়ে এসেছেন। মেয়েও সঙ্গোপনে চেপে যায় যে, লন্ডনে বাবা কোনও দিন যাননি, যা ইংরেজি শিখেছেন সব সেই পুব বাংলার শহর কিশোরগঞ্জে। কাকা নীরদচন্দ্র চৌধুরি প্রখ্যাত পণ্ডিত হলেও তখন দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর চাকরি করেন, সেই সূত্রে কৃষ্ণার প্রথম দিল্লি যাওয়া। আরও দুই কাকা। সবচেয়ে ছোট যিনি, বিনোদ, বিশ্বভারতীর প্রকাশনা কর্মী, তাঁর দৌলতে পাওয়া হলুদ মলাট লাল হরফের সরু বইগুলো কৃষ্ণার অতি প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয়, জাপানযাত্রী আর পারস্যযাত্রী কবির বই দুটি।

সমাজের উঁচু জায়গায় সুযোগসুবিধে মেলে জানি। কিন্তু সাক্ষাৎ যমদূতের হাত ফসকেও বেরিয়ে আসা যায় ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’ বলে, এতটা জানি কি? ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর, স্বাধীনতার এক মাস পর, দাঙ্গাদীর্ণ দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরছেন কৃষ্ণা। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝুপঝাপ করে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে কী সব, প্রথমে ভাবলেন বস্তা, মালপত্র, তার পর বুঝলেন মানুষের দেহ! এক দল শিখ বিভিন্ন কামরায় মুসলমান খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর ছুড়ে ফেলছে। তাঁর কামরাতেও এল তারা, বাঙালি শুনে ধরেই নিল মুসলমান! প্রাণ বাঁচাল সহযাত্রী এক শিখ বালিকা, যে তার গোটা পরিবারকে কচুকাটা হতে দেখেছে লাহৌরে। পঞ্জাবি ভাযায় প্রাণপণ বোঝাল, এঁরা উঁচু পরিবারের মানুষ, ‘প্রফেসর’, এঁদের ছেড়ে দেওয়া হোক।

উঁচু-নীচু সব মিলিয়েই জীবনের যে ক্যালাইডোস্কোপ, তাকে কে বেশি ভাল ধরতে পারে, ইতিহাস না সাহিত্য? প্রশ্নটা আমাকে চিন্তায় রাখে। কৃষ্ণা বসুর বই সেই দুশ্চিন্তা এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিল, এইটুকু বলতে পারি। অসাধারণ সুলেখিকা যে ভাবে স্মৃতি বুনে গিয়েছেন, তার দাম ইতিহাসের কাছে কতখানি, তিনি নিজেও কি পুরোটা জানেন? উনিশশো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কলকাতা ও বাংলার সামাজিক ইতিহাসের সন্ধান এখনও ভাল করে শুরু হয়নি। যখন হবে, এই ধরনের বই অমূল্য হয়ে উঠবে।

আর একটা কথা। কৃষ্ণা বসুর লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন বাংলা বইটি কতটা সুখপাঠ্য। আর ইংরেজি অনুবাদ বইটি? কৃষ্ণার কনিষ্ঠ পুত্র সুমন্ত্র বসু-র অনুবাদ বিষয়ে একটিই শব্দ: চমৎকার! ‘পড়া শুরু করলে ছাড়া যায় না’, এমন একটি শব্দ ইংরেজিতে (‘আনপুটডাউনেবল’) পেয়েছি আমরা। বাংলায় এখনও নেই!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy