Advertisement
E-Paper

পিরিয়ড ফিল্মে পৌঁছতে চেয়েছিলেন

সত্যজিৎ আর সুরেশের পত্রালাপের ভিতর দিয়ে সত্তর দশকের যে দ্বিতীয়ার্ধটুকু উঠে এসেছে, তাতে জলছবির মতো ফুটে উঠেছে সে সময়ে সিনেমা বানানোর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া, শিল্পভাবনা থেকে বাণিজ্য-বিপণন সব কিছু।

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০২
পরিচালক: ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শুটিংয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে টম অল্টার ও রিচার্ড অ্যাটেনবরো। ছবি: সন্দীপ রায়

পরিচালক: ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শুটিংয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে টম অল্টার ও রিচার্ড অ্যাটেনবরো। ছবি: সন্দীপ রায়

মাই অ্যাডভেঞ্চার্স উইথ সত্যজিৎ রায়/ দ্য মেকিং অব শতরঞ্জ কে খিলাড়ি

লেখক: সুরেশ জিন্দল

৩৫০.০০

হার্পার কলিন্স

‘এইমাত্র মারি সিটনের চিঠি পেলাম। ওঁকে এক রকম বলাই ছিল তাই নিজের দায়িত্বেই উনি অ্যাটেনবরো-র কসটিউমগুলি লন্ডন থেকে আনার কাজটা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ওঁর নিজস্ব জিনিসপত্রের সঙ্গেই কসটিউমগুলি আসছে। ওঁর ধারণা আমরা বম্বেতে শুটিং করছি, আমি অবিশ্যি জায়গা বদলের কথা জানিয়ে দিয়েছি। শুটিংয়ের সময়টা উনি থাকবেন, এবং লন্ডনের কাগজগুলির জন্যে হয়তো এ-ছবি নিয়ে কয়েকটা লেখাও লিখবেন। আমি তোমার হয়ে ওঁকে আতিথ্যগ্রহণের কথা জানিয়েও দিয়েছি।...’ মোটামুটি এই রকমই ছিল সত্যজিৎ রায়ের ইংরেজি চিঠিটির বয়ানের প্রথমাংশ, ১৩ মে ১৯৭৭-এ সুরেশ জিন্দলকে লেখা। অ্যাটেনবরো অভিনয় করেছিলেন জেনারেল উট্রাম-এর চরিত্রে, আর তাঁর রাজনৈতিক সহকারী ক্যাপ্টেন ওয়েস্টন-এর চরিত্রে টম অল্টার।

সুরেশের বইটি এমন অজস্র চিঠির ঝাঁপি। আশ্চর্য ঝাঁপি বললেও অত্যুক্তি হয় না। সত্যজিৎ আর সুরেশের পত্রালাপের ভিতর দিয়ে সত্তর দশকের যে দ্বিতীয়ার্ধটুকু উঠে এসেছে, তাতে জলছবির মতো ফুটে উঠেছে সে সময়ে সিনেমা বানানোর পদ্ধতি-প্রক্রিয়া, শিল্পভাবনা থেকে বাণিজ্য-বিপণন সব কিছু। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা ভারতে তখন ফিল্ম তৈরির খরচ, প্রচার, বিজ্ঞাপন, ছবি-মুক্তির পরের অবস্থা... একটা আন্দাজ পাবেন নতুন শতকের পাঠক-দর্শকেরা।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শুটিং শুরু হয়েছিল ১৯৭৬-এর ডিসেম্বরে, আর তা মুক্তি পায় ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে। শুরুর বেশ কিছু আগে থেকে প্রযোজক সুরেশ জিন্দলের সঙ্গে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান শুরু সত্যজিতের। এ দেশে কোনও প্রযোজকের সঙ্গে পরিচালকের এ ধরনের পত্র-বিনিময় প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সত্যজিতের ক্ষেত্রে তো নয়ই, তাঁকে নিয়ে এতাবৎ বাংলা, ইংরেজি, বা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কম বই বেরোয়নি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তাঁর ছবির প্রযোজকের এই দীর্ঘকালীন পত্রালাপ কখনও পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়নি।

কেবল নির্মাণপ্রক্রিয়াই নয়, চিঠিতে উল্লেখিত মানুষজন সত্যজিতের লেখার গুণে স্কেচের রেখার মতো ফুটে উঠেছেন। তাতে সত্যজিতের জীবনীকার মারি সিটন, রিচার্ড অ্যাটেনবরো বা টম অল্টারের মতো অভিনেতা যেমন আছেন, তেমনই আছেন শিল্প-নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত আর সিনেমাটোগ্রাফার সৌম্যেন্দু রায়। আছেন তৎকালীন বম্বের অন্য অভিনেতারাও। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় এ-ছবির শিল্পসংক্রান্ত প্রস্তুতিপর্ব। অধিকাংশ চিঠিতেই সত্যজিৎ কসটিউম আর সেট নিয়ে কথোপকথনে মেতেছেন সুরেশের সঙ্গে, শুরুতেই যে চিঠিটির উল্লেখ করেছি, তাতেও তিনি খুঁটিনাটি নির্দেশ দিচ্ছেন— উট্রামের অফিসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলবেন ওয়েস্টন, তখন তিনি কী ধরনের বুট আর ট্রাউজার পরবেন। আর এই কথার পিঠেই উঠে পড়েছে উট্রামের স্টাডি-র কথাও। ফিল্ম-স্টিলের পাশাপাশি এ সব নিয়ে সত্যজিতের খেরোর খাতা-র স্কেচগুলিও ঠাঁই পেয়েছে বইটিতে, ফলে রীতিমতো প্রামাণিক হয়ে উঠেছে চিঠিগুলি।

কেউ যদি গোয়েন্দার মতো ক্লু খোঁজেন, সত্যজিতের শিল্প-অভিপ্রায়েরও হদিশ পাবেন এখানে। উনিশ শতকের ইংরেজ-নবাব দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে আসলে সত্যজিৎ পৌঁছতে চেয়েছিলেন পিরিয়ড ফিল্মে। ‘দেবী’, ‘চারুলতা’র প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছেনও সে-কথা অন্যত্র: ‘‘আমার কাছে আরেকটি আকর্ষণীয় উপাদান হল পিরিয়ড। বিগত যুগকে পরদায় মূর্ত করার সুযোগ আমি সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম... ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে। এই কাজটা করার আগে কিঞ্চিৎ অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, যার ফলে একটি বিশেষ পিরিয়ড সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়। তারপর আসে এই ধারণার ভিত্তিতে যথাযথ ডিটেল ব্যবহারের প্রশ্ন। এই ডিটেল এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যাতে আরোপিত মনে না হয়।’’

যে কোনও বাস্তব-সচেতন পরিচালকই তাঁর ছবির বাস্তবতার ন্যূনতম শর্ত রক্ষার্থে ডিটেলের প্রয়োগ করেন, কিন্তু সত্যজিৎ সে সব ছাপিয়ে তাঁর ছবির ন্যারেটিভে ডিটেলের সমান্তরাল বুনন রেখে দেন, ছবিতে বর্ণিত আখ্যানটি সেই সমান্তরাল ডিটেলের অভিঘাতে এক আয়তনিক তল তৈরি করতে করতে এগোয়, তাঁর গল্প বলার ধরনটি এ ভাবেই ঋদ্ধ হতে থাকে। বরাবরই সত্যজিৎ ছবিতে সংলাপের চেয়ে ডিটেল ব্যবহার করতেই বেশি ভালবাসেন, তথ্যমূল্য পেশ করার পাশাপাশি ইমেজের অন্তর্গত মূল ভাবনার দিকেও দর্শকের দৃষ্টি ফেরাতে থাকেন। আর এই ডিটেল মারফত বিগত পিরিয়ড রচনার চ্যালেঞ্জ যখন নেন তিনি, উনিশ শতকীয় জীবনের দুর্লভ স্বাভাবিকতা রচনা করতে চান পরিশীলিত শৈল্পিক ভারসাম্যে, তখন জরুরি উপাদানের সতর্ক নির্বাচনের প্রয়োজন ঘটে। সুরেশের সঙ্গে চিঠিপত্রে তার বিস্তর উদাহরণ।

চিঠিপত্র ছাড়াও অনেকটা অংশ অবশ্য এ বইয়ে সুরেশের আত্মকথন। কী ভাবে তাঁর সঙ্গে সত্যজিতের আলাপ, বা সত্যজিৎ যে মহিমময়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আত্মকথন ও চিঠিপত্রে মেশানো গোটা বইটাকে দশটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন: দ্য মিটিং, দ্য বিগিনিংস, রিসার্চ অ্যান্ড শেডিউলিং, কাস্টিং, ফাইনাল প্রিপারেশনস, ফিল্মিং, পোস্ট-প্রোডাকশন, দ্য রিলিজ অ্যান্ড আফটার, লুকিং ব্যাক। একটি অধ্যায় সত্যজিতের ‘আ ব্রিফ বায়োগ্রাফি’— একেবারেই বাড়তি। যা লিখেছেন সুরেশ তা তামাম দুনিয়ার অবাংলাভাষী সত্যজিৎ-আসক্ত মানুষজনের এতটাই জানা যে এর কোনও দরকারই ছিল না। অ্যান্ড্রু রবিনসন ভূমিকা লিখেছেন বইটির। তবে মুখবন্ধটি বড়ই চমৎকার, জাঁ-ক্লোদ কারিয়ের-এর।

এমন বই আগে কখনও পড়েননি, লিখেছেন কারিয়ের: ‘দ্য স্টোরি অব দ্য মেকিং অব আ ফিল্ম, স্টেপ বাই স্টেপ, ফ্রম বিগিনিং টু এন্ড।’ এও লিখেছেন যে, পরিচালক-প্রযোজকের সম্পর্কটা কখনও কখনও ‘ট্রেচারাস’, এমনকী ‘ভায়োলেন্ট’ হয়ে ওঠে, আবার তা ‘মিস্ট্রি’ও সকলের কাছে। কারিয়ের-এর কথাগুলি অকপটে স্বীকার করেছেন সুরেশ— মনোমালিন্য হয়েছিল আবার স্বাভাবিকও হয়ে গিয়েছিল সম্পর্কটা সত্যজিতের সঙ্গে, বেশ কিছু পত্রালাপ তো এই নিয়েই।

‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সত্যজিতের প্রথম হিন্দি ছবি, কিন্তু কী করে হিন্দি লিখবেন, এত দিন বাংলা আর ইংরেজিতেই চিত্রনাট্য লিখে এসেছেন। ফলে ইংরেজিতেই লিখলেন, শ্যামা জায়দি তা হিন্দি আর উর্দুতে অনুবাদ করলেন, অওধ-এর স্থানীয় মানুষজনের ভাষা তাতে প্রয়োগের জন্যে শ্যামার সঙ্গী হলেন জাভেদ সিদ্দিকি। সম্ভবত খেদ থেকে গিয়েছিল সত্যজিতের মনে। ১৯৮২-তে দূরদর্শন-এ প্রথম সম্প্রচার হল তাঁর দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের হিন্দি ছবি ‘সদ্‌গতি’, ১৯৮০-’৮১-তে যখন সে-ছবির চিত্রনাট্য লিখলেন শুটিংয়ের জন্যে, গোটাটাই নিজে লিখলেন হিন্দিতে, দেবনাগরী হরফে, সন্দীপ রায়ের হেফাজতে আছে সেই খসড়া খাতা। তাঁর এই বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা লিখেই মুখবন্ধ শেষ করেছেন জাঁ-ক্লোদ কারিয়ের: ‘আ লিজেন্ড... ইজ কামিং টু ভিজিট আস, টু শেয়ার হিজ ড্রিমস উইথ আস... ’।

Book Review My Adventures with Satyajit Ray: The Making of Shatranj Ke Khilari Suresh Jindal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy