Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

অতীতের অকপট, শান্ত চিত্ররূপ

রমাপদ চৌধুরীর হারানো খাতা পড়তে পড়তে আবার সেই শিউলি গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকার স্মৃতি মনে এল। শান্ত, শুভ্র, সুন্দর লেখা। অনেকগুলি পর্ব ক্রমান্বয়ে সাজানো।

হারানো খাতা, রমাপদ চৌধুরী। আনন্দ, ৩০০.০০

হারানো খাতা, রমাপদ চৌধুরী। আনন্দ, ৩০০.০০

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কোনও এক আশ্বিনের সকালে দীর্ঘ একটি শিউলি গাছের নীচে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ যাবৎ যত শিউলি গাছ দেখেছি, সব ক’টিই দৈর্ঘ্যে খর্ব, গাঢ় কমলা বোঁটার সাদা ফুল ঝরে পড়ে থাকতে দেখেছি তাদের পায়ের তলায়। দীর্ঘ গাছটি উঠেছে বাড়ির পাঁচিলের মাথা ছাপিয়ে। চোখ বন্ধ করে তার নীচে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার মাথায়, সারা শরীরে টুপটাপ ঝরে পড়ছিল অজস্র ফুল আর চেতনাকে ঘিরে ধরছিল শেফালির গন্ধ। শিউলিকে মরাঠি ভাষায় বলে ‘পারিজাত’। পারিজাত স্বর্গের পুষ্প। অনির্বচনীয় অনুভূতি।

রমাপদ চৌধুরীর হারানো খাতা পড়তে পড়তে আবার সেই শিউলি গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকার স্মৃতি মনে এল। শান্ত, শুভ্র, সুন্দর লেখা। অনেকগুলি পর্ব ক্রমান্বয়ে সাজানো। ভাষার প্রসাদগুণে মিশেছে প্রসন্ন আত্ম-অনুসন্ধান। শৈশবের শহর, দেশের বাড়ি, পরিশেষে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইডেন হিন্দু হস্টেল এবং সেই পরিক্রমার প্রসঙ্গে সেই সময়, তখনকার মানুষ, আচার-বিচার-সংস্কৃতি ও পালা-পার্বণের স্মৃতি। কখনও না-দেখা একটি যুগ অনায়াসে উন্মোচিত হয় পাঠকের মনের কাছে, যেন মন্থর কোনও রঙিন দীর্ঘ রেলগাড়ির একটি করে কামরা ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিপথ।

রমাপদ চৌধুরীর লিখনশৈলীর সঙ্গে আকৈশোর পরিচিত পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয় না— এ তাঁর সৃজনশীল গদ্যকার সত্তারই সম্প্রসারণ। স্বচ্ছ দৃষ্টি, স্পষ্ট উচ্চারণ অথচ কোথাও খেদ, বক্রোক্তি, উপহাসের প্রবণতা নেই। সময় ও মানুষের বিশ্লেষণে তিনি নির্ভুল, অথচ তাঁর কথার ভাঙা টুকরো মনের মধ্যে রয়ে গেলেও রক্তপাত ঘটায় না। যে উদার, প্রসন্ন মনোভঙ্গি দিয়ে লেখাটি সাজানো, ভাষা যেন তারই অদ্বৈত সত্তা। এমন প্রাঞ্জল, নির্ভার, মধুর বাংলা কদাচিৎ আজকাল লেখা হয়।

অথচ এমন লেখা বা লেখার নানা পর্ব ফাইলবন্দি হয়ে, পরিত্যক্ত কাগজের সঙ্গে দৃষ্টির অগোচরে পড়ে ছিল— লেখকের নিজেরও মনে ছিল না। ভক্ত-পাঠক সিদ্ধার্থ সিংহ খুঁজে বার না করলে পাঠকের কাছে অজানাই রয়ে যেত খাতাটি। পুরনো লেখার সন্ধানে লিপ্ত হওয়াতেও যেমন লেখকের অনীহা, তেমনই তাঁর নিস্পৃহতা লেখাটির পুনঃপাঠে। দীর্ঘ ছয় দশক লেখার পর লেখনী যিনি স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন, তাঁকেই সাজে এ উদাসীন মণিহার। খুঁজে যখন পাওয়া গেল, লেখাটির কোনও নাম ছিল না, পাতার নম্বরও ছিল না কোথাও কোথাও। ক্রমানুসারে সাজানোর প্রয়োজন ছিল। ছাপার আগে পড়েও দেখা দরকার। নিস্পৃহ রমাপদ চৌধুরী এ সবের মধ্যে প্রবেশ করতে চান না। হর্ষ দত্ত ও রমানাথ রায় এই দুই দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখাটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার— রমাপদ চৌধুরীর ধারণা। অথচ ‘হারানো খাতা’ যখন ধারাবাহিক প্রকাশের আগে বিজ্ঞাপিত হয়, আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম, এ নতুন লেখা।

ছেলেবেলার কাহিনির সূত্রপাত সে কালের বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের শহর খড়্গপুর থেকে। রেল-শহরে তখন বিলিতি সাহেব, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেব আর হাতে গোনা কিছু বাঙালিকে বাদ দিলে সারা ভারতের মানুষের বাস। রেলওয়েকে লেখক বেশ কয়েক বারই উল্লেখ করেছেন গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন বলে। ভাষা, বর্ণ, স্তর-বিভেদ অনেক কিছুই ঘুচিয়ে দিয়েছে রেলে প্রবাস আর রেল-কলোনিতে বসবাস। তখনকার রেল-শহরে অবশ্য ভিন্ন প্রদেশের মানুষের আলাদা পাড়া থাকত, ভিন্নধর্মী ও প্রান্তিক মানুষদের জন্যও স্বতন্ত্র লোকালয়। শৈশবেই রেল-শহরের বাইরে পুরী ও কাশীতে গিয়েছেন লেখক, পরে বন্ধুদের সঙ্গে কাশ্মীর। নিজেদের গ্রামের বাড়ি বর্ধমান জেলায়। সেখানে গিয়ে চিনেছেন গ্রামজীবন। খোপে-খোপে আলাদা করে মানুষকে রাখা রেল-শহরের রীতি-নিয়ম মন থেকে মানতে পারেননি। মাতামহের আদর্শের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তাঁর সত্তায়। বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় পণপ্রথার বিরোধ, গ্রামের গণ্ডি ছেড়ে সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য স্থানান্তর গমন— এ সবই ছিল মাতামহের উদ্যম। মানুষটিও ছিলেন আদর্শবান, আজীবন শিক্ষাব্রতী। প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণের বছর দশেক পর তাঁর মৃত্যু হলে খড়্গপুর রেলওয়ে ইংলিশ হাইস্কুল প্রাক্তন ছাত্র ও গণ্যমান্যদের একটি সভা আয়োজন করেছিল। সে দিন প্রখ্যাত ভাস্কর জি পালের তৈরি আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় মাতামহের।

বাঙালির বাবুয়ানা বা সম্পদশীলতার গর্ব কখনও লেখককে আচ্ছন্ন করেনি। ব্রিটিশের ভারতে জীবনের এক-চতুর্থ শতক কাটিয়ে স্মৃতিকথায় তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন দেশজ কারুশিল্প ও শিল্পীদের জন্য তাঁর মরমী অভিবাদন। কাঁসা-পিতলের বাসন, হাতে বোনা চাদর, গামছা, বালুচরি, বেনারসি শাড়ির ইতিহাস-ভূগোল— এ সবই তাঁর কাছে মহামূল্যবান।

মধ্যবিত্ত বাঙালির ঔপনিবেশিক মনোভাব তাঁকে স্পর্শ করেনি, রেল-শহরে বড় হয়েছেন বলেই হয়তো। ‘‘আমাদের রেল শহরটার রাস্তা বানিয়েছে মধ্যপ্রদেশের অন্ত্যজ মানুষ। কলকারখানায় এমন িক স্টেশনের কুলিকেও ডেকে এনেছি বিহার উত্তর প্রদেশ থেকে, আমাদের শহরে রিকশাঅলাকে আসতে দিয়েছি দক্ষিণ থেকে। কারণ ও সব কাজ গ্রামের দরিদ্র মানুষকে টানতে পারেনি...।’’

সেই সময়ের সামাজিক শ্রমবিভাজনের একটি মর্মান্তিক পর্ব— খাটা পায়খানার মেথরদের জীবন ও তাঁদের নিঃশব্দ, প্রান্তিক অস্তিত্ব নিয়ে বিশদ লিখেছেন রমাপদ চৌধুরী। সেপ্টিক ল্যাট্রিনের কথা শহরের শাসক বা রেল কোম্পানি কেউই ভাবেননি। মাথায় করে মানুষ মানুষের বিষ্ঠা বহন করছেন, এ দৃশ্য চোখ বা মনকে পীড়া দিত না। কলকাতায় এসে দেখলেন, সারা শহরে বিষ্ঠাপুরীষ ছড়িয়ে। তা সাফ করার কাজ একটি মাত্র সামাজিক শ্রেণির। ২০১৩ সালে আইন করে এ প্রথা বন্ধ করার পরও আজ সারা দেশে হাতে করে মূত্রপুরীষ সাফ করেন, বহন করেন কয়েক লক্ষ মানুষ। বয়ঃসন্ধির নানা কৌতূহল, দুষ্টুমির চৌর্যবৃত্তি, ইরানি বেদের মেয়েদের, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের সৌন্দর্যের আকর্ষণ ও কৌতূহল— নানা ঘটনার অকপট, প্রসন্ন স্বীকারোক্তি আছে কৈশোর পর্বে। সমাজবদ্ধ পাঠকের দেখার ভঙ্গি শিল্পীমনকে কোনও দিন আচ্ছন্ন করেনি। প্রান্তিক মানুষের জাতপাত, বাঙালি-অবাঙালির সংস্কৃতিগত দূরত্ব অথবা নারী সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতার প্রসঙ্গও। একটি উদাহরণ দিই: ‘‘শিল্পকর্মে, চিত্রকলায় এবং ভাস্কর্যে নারীর নগ্ন শরীর ও তার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সারা পৃথিবীতেই। আমাদের ভারতবর্ষের মন্দিরগাত্রেও, শিল্প মূলত একটি কৃত্রিম সৃষ্টি। না হলে, যে জীবন্ত নারীর নগ্ন দেহ, যার প্রতিফলন ঘটেছে কৃত্রিম শিল্পে, তার বাস্তব অস্তিত্ব অশালীন মনে করা হয় কোন যুক্তিতে?... সমাজদৃষ্টি। কিন্তু এই সমাজও তো মানুষেরই একটি কৃত্রিম সৃষ্টি। তার দৃষ্টি তো পরম্পরা ও বহুজনের দৃষ্টি। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। তার দৃষ্টিকে হেয় মনে করার কী কারণ থাকতে পারে?’’ ব্যক্তি ও সমাজের অবস্থানের বৈপরীত্যের প্রসঙ্গে নারীর পণ্যায়নের অর্থনীতি-রাজনীতির প্রসঙ্গটি অবশ্য লেখক আনেননি। পণ্যায়নের অর্থনীতি শ্লীল-অশ্লীলের আওতার বাইরে। শৈশব-কৈশোরের দেখা গ্রামাঞ্চল, ছোট শহর, কলকাতা, নানা চরিত্র, পালা-পার্বণ, উৎসব— সব কিছুর প্রবহমান ও সম্মিলিত স্মৃতি লেখক সত্তার নির্মাণের প্রক্রিয়ায় মিশে গেছে। শিল্পীসত্তার জাগরণের বৃত্তান্তে লেখক বাদ দেননি তাঁর অদেখা ঠাকুরদাদাকেও— যিনি সম্পন্ন কৃষক হিসেবে ধান্যবীজের সংরক্ষণের পরম্পরা জীবিত রেখেছিলেন, আর কাব্যিক নামকরণ করেছিলেন নিজের গ্রামের জলাশয়গুলির।

বড়ই মধুর লেগেছে কৈশোরে আত্মীয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানের উপলক্ষে বর্ধমানের দেশের বাড়িতে আসার বৃত্তান্ত, ‘ঝাংলাই’ সাপের কাহিনি, গ্রামের কিশোরী রিনার মধ্যে পাওয়া মাটির, গ্রামের, দেশের গন্ধ। এক কালের বর্ধমানের ঠগি ফাঁসুড়ে অধ্যুষিত পথঘাট, উটের গাড়ি ও সিন্ধি গাড়োয়ানের যাতায়াত— এই দেশের বাড়ি আসার মধ্যে দিয়ে লেখক খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব শিকড়। বালিকা রিনা-র সঙ্গে ‘চক্ষুমৈত্রী’র আজীবন স্মৃতি এবং তার দেখার মধ্যে দিয়ে গ্রামবাংলাকে ভালবাসা সাহিত্য সৃজনের শিকড়টিকে গেঁথে দিয়েছে মাটির সঙ্গে। শৈশবের সৌহার্দ্যের তীব্র মাধুর্য প্রেমের অনুভূতির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। খাতার কাহিনি শেষ হয়েছে কলকাতা শহরে এসে। গঙ্গার উপর পন্টুন ব্রিজ পেরোনো, স্টেশনে দাঁড়ানো বড় বড় ট্যাক্সি আর ফিটন, হেয়ার স্কুল, ইডেন হস্টেল, গড়ের মাঠ, উনিশশো চল্লিশের গঙ্গাজলে নিত্য ধোয়া ফুটপাথ, পুস্তকপিপাসু এক তরুণের চোখের সামনে খুলে যাওয়া সবুজ পত্র, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জের অরণ্য পৃথিবী... এই সময়, দৃশ্য ও মানুষগুলি অতীত হয়ে গেছে। হারানো খাতা-য় ধরা আছে তার অকপট, শান্ত চিত্ররূপ।

আত্মপরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে বা নিজের জীবনবৃত্তান্ত বলার জন্য এ লেখা নয়। যাঁরা একদিন তাঁকে আঘাত করেছেন, তাঁদের প্রতি বিরোধ বা দ্রোহ মনের ভিতর অনুভব করতে পারেননি লেখক। জেগে আছে এক ক্ষমাশীলতার আচ্ছাদন। ‘‘মনে পড়ছে শুধু হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি, সেই সময়ের ছবি... মানুষ, ঘটনা, উল্লাসের পাশাপাশি সে কালের মানুষের হতাশা, অপ্রাপ্তি, তবু অল্পে সুখমস্তি মনোভাব যা সমান দৃশ্যমান আজকের এই অকল্পনীয় বৈভবের পাশেই।’’

একবিংশ শতকের পাঠকের জন্য হারানো খাতা-র রূপকথা একটি অমূল্য উপহার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ramapada chowdhury book anita agnihotri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE