Advertisement
E-Paper

অসাম্য কেন বাড়ছে, তা কমানোর পথ কী

এক সময়ের বাম রাজনীতির প্রচলিত একটা স্লোগান ব্যবহার করে বলা যায়, টমাস পিকেটি তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইটির মাধ্যমে মূল ধারার অর্থনীতির সদর দরজায় বাঁ দিক থেকে একটি কামান দেগেছেন। কামানের গোলাটি বিশাল এবং কিঞ্চিৎ জটিল।

মৈত্রীশ ঘটক

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

এক সময়ের বাম রাজনীতির প্রচলিত একটা স্লোগান ব্যবহার করে বলা যায়, টমাস পিকেটি তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইটির মাধ্যমে মূল ধারার অর্থনীতির সদর দরজায় বাঁ দিক থেকে একটি কামান দেগেছেন। কামানের গোলাটি বিশাল এবং কিঞ্চিৎ জটিল। সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রায় সাতশো পাতার তথ্য ও বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ এই বইটি কিছু দিন বেস্টসেলার লিস্টে থাকলেও, অধিকাংশ সাধারণ পাঠক এর প্রথম পরিচ্ছেদের পর আর বেশি দূর এগোননি!

ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি,
টমাস পিকেটি। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৪৯৫.০০

বইটির বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, একটা বিষয়ে প্রগতিশীল থেকে রক্ষণশীল, সব অর্থনীতিবিদ একমত। সরকারি নানা সূত্র থেকে আয়কর, জমির দলিল এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কিত তথ্য একত্র করে, প্রথমে ফ্রান্স তার পর পৃথিবীর নানা দেশে (তার মধ্যে ভারত-ও আছে) আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদি যে তথ্যভাণ্ডার পিকেটি ও তাঁর সহকর্মীরা প্রায় দুই দশক ধরে গড়ে তুলেছেন এবং গবেষকদের ব্যবহারের জন্য অনায়াসলভ্য করে দিয়েছেন, তা যথার্থই এক মহার্ঘ সম্পদ। এ যাবৎ এই বিষয়ে যা তথ্যভিত্তিক কাজ হয়েছে (যেমন, ষাটের দশকে কুজনেটস এক জন পথিকৃৎ), দেশ ও কালের পরিধির বিস্তার এবং তথ্যসমৃদ্ধির দিক থেকে সে সবকে এই গবেষণা ছাপিয়ে গেছে।

বইটিতে প্রথমে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অর্থনীতির কতগুলো মূল সূচকের দীর্ঘকালীন বিবর্তনের বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে আয় ও সম্পদের বণ্টন, জাতীয় আয়ে পুঁজি এবং শ্রমের আপেক্ষিক ভাগ, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ও সুদের হার। প্রথম অংশের আলোচনায় বইটির মূল বক্তব্য হল, প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেখলেও বর্তমানে আয় ও বিত্তের অসাম্যের মাত্রা খুবই বেশি, এবং তা গত প্রায় অর্ধশতক ধরে ক্রমবর্ধমান। তার আগে মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনার ধাক্কায় অনেক ধনী সর্বস্বান্ত হওয়ায়, আর সরকারি নীতির কারণে (যেমন, আয়কর ব্যবস্থা ও আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের পত্তন) ১৯৩০-এর গোড়া থেকে ১৯৬০-এর শেষ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইয়োরোপে অসাম্য কমেছিল।

একটা দেশের সব মানুষকে আয় অনুযায়ী পর পর সাজিয়ে নিয়ে তার পর যদি দেখি যে দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের কত শতাংশ রোজগার করছেন, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে সংখ্যাটি ছিল প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। আর সেই সময়েই আয়ের ক্রমবিন্যাসের নীচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষ আয় করছিলেন দেশের মোট আয়ের ২০ শতাংশ। ১৯০০ সালে আমেরিকায় ওপরের ১০ শতাংশের আয়ের ভাগ ছিল এখনকার থেকে একটু কম, প্রায় ৪৬%, কিন্তু ১৯৪০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৩%। অসাম্যের ছবিটি চরিত্রগত ভাবে ইয়োরোপেও একই রকম, কিন্তু সব সময়েই তুলনায় কম তীব্র। যেমন, ২০১০ সালে ইয়োরোপের ধনীতম ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের ৩৫ শতাংশ উপার্জন করতেন।

বইটির দ্বিতীয় অবদান হল আয় আর বিত্তের এই ক্রমবর্ধমান অসাম্যের একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খাড়া করা। পিকেটি বলেছেন, এর মূলে আছে পুঁজিসঞ্চয়ের ভূমিকা। আয়ের দিক থেকে এক জন গড় নাগরিকের আয়ের বৃদ্ধির হার আর গড়পড়তা জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার কাছাকাছি হবে। কিন্তু, যাঁদের আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজি থেকে অর্জিত সুদ, তাঁদের আয়ের বৃদ্ধির হার হবে সুদের হারের কাছাকাছি। পিকেটি দেখাচ্ছেন, সুদের হার ঐতিহাসিক ভাবে অধিকাংশ সময়ই আয়বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি থেকেছে। সুদবাবদ অর্জিত আয়ের সিংহভাগ যদি আবার সঞ্চিত হতে থাকে, তবে স্বাভাবিক ভাবেই এই আয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, জাতীয় আয়ে পুঁজি থেকে অর্জিত আয়ের ভাগ ক্রমে বেড়েছে। পিকেটি বলছেন, যে ছবিটা এর থেকে ফুটে উঠছে, তা মেধাতন্ত্রের নয়, উত্তরাধিকার-ভিত্তিক ধনতন্ত্রের।

উদারপন্থীরা বলতেই পারেন, তা-ই যদি হয়, তাতে সমস্যা কী? কেউ যদি পরিশ্রম করে ধন সঞ্চয় করেন এবং সন্তান-সন্ততিকে তার উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত করেন, তাতে কার কী বলার আছে? সমস্যা হল, আর্থিক অসাম্য থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ফারাকও তত বাড়ে। আইনি ও বেআইনি, অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, সব মানুষ নয় সমান! যেমন, আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫ শতাংশ আর পুঁজির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের থেকে লাভের ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫%। তাই, প্রকৃত অর্থে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, বরং উল্টো।

পিকেটির মতে, এই অসাম্য অনিবার্য নয় এবং করনীতির মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ১৯৯২ সালে আমেরিকায় সর্বোচ্চ অর্জনকারী চারশো করদাতাকে গড়ে আয়ের ২৬% কর দিতে হত। প্রেসিডেন্ট বুশের করের হার কমানোর নীতির ফলে ২০০৯ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ২০%। যা কমানো যায়, তা বাড়ানোও যায়। ইয়োরোপে অসাম্যের মাত্রা আমেরিকার তুলনায় কেন কম, তার সহজ উত্তর হল, করের হারের ফারাক। পিকেটির প্রস্তাব, পুঁজি থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর আদায় করা হোক, এবং পুঁজি যেহেতু সচল, তাই সব দেশেই সেটা এক হারে করা হোক।

এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। সেই রকম, তাঁর তত্ত্ব যে অভ্রান্ত বা সর্বাঙ্গীণ, তাও বলা যায় না। পিকেটি নিজেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, গত চার দশকে আমেরিকায় আয়ের সার্বিক অসাম্যের বৃদ্ধিতে পুঁজি-লব্ধ আয়ের অবদান এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়, যা তাঁর পুঁজি-কেন্দ্রিক তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায় না। এখানে দক্ষ শ্রম থেকে অর্জিত আয়ের ক্রমবর্ধমান অসাম্যের একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়, যেমন ম্যানেজার বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের আয় সাধারণ শ্রমিকের মজুরির তুলনায় প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে।

তা হলেও, আয় ও বিত্তের ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে পিকেটি যে গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন, তা থেকে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন মূলধারার অর্থনীতির সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছে। এই প্রথম দেখছি, অসাম্যের প্রসঙ্গটি এমনকী রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের গবেষণাতেও বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

বহুপঠিত কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, বহুচর্চিত এই বইটির আপাত-জনপ্রিয়তার কারণটা ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট এবং তাতে ব্যাঙ্ক আর বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর ভূমিকা অতি-ধনীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের মনে এক গভীর বিরূপতা তৈরি করেছে। আমেরিকায় আর্থিক বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মনোভাব অনেকটাই পাল্টে গেছে— ‘ওপরের এক শতাংশ’ কথাটা এখন খুবই চালু। করদাতাদের টাকায় ব্যাঙ্কের লালবাতি জ্বলা আটকাতে হবে, এই রকম ধনীদের জন্যে ‘জিতলে ধনতন্ত্র, কিন্তু হারলে সমাজতন্ত্র’ মানসিকতার ফলে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর আগে আমেরিকায় রাজনীতিকরা ‘করবৃদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করতে ভয় পেতেন। এখন সেই অবস্থা খানিকটা হলেও পাল্টেছে।

আসলে, অসাম্যের প্রশ্নের সঙ্গে ন্যায়ের প্রশ্নটা অঙ্গাঙ্গী জড়িত। স্থান, কাল ও পরিস্থিতিভেদে কতটা অসাম্য সামাজিক ভাবে সহনীয় বা বৈধ, অসাম্যের বিরুদ্ধে নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে শেষ বিচারে সেটাই বোধ হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ অর্থনীতির শিক্ষক

maitreesh ghatak capital in the twenty-first century thomas piketty book review Economist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy