Advertisement
E-Paper

আজ তাঁর উপস্থিতি বড্ড জরুরি ছিল

উনিশ শতকের বাংলায় আধুনিক পর্বান্তরের গড়নপেটনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিচিত্র বিরাট ভূমিকার গবেষণায় বিশ্লেষণে অধ্যাপক ব্রায়ান এ হ্যাচার-এর কৃতিত্ব আমাদের সুপরিচিত। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ইডিয়মস অব ইমপ্রুভমেন্ট: বিদ্যাসাগর অ্যান্ড কালচারাল এনকাউন্টার ইন বেঙ্গল প্রকাশের পর প্রায় দু-দশক পার হয়েছে।

অশোক সেন

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ২২:২৫

বিদ্যাসাগর/ দ্য লাইফ অ্যান্ড আফটারলাইফ অব অ্যান এমিনেন্ট ইন্ডিয়ান, ব্রায়ান এ হ্যাচার। রাটলেজ, ৩৪৫.০০

উনিশ শতকের বাংলায় আধুনিক পর্বান্তরের গড়নপেটনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিচিত্র বিরাট ভূমিকার গবেষণায় বিশ্লেষণে অধ্যাপক ব্রায়ান এ হ্যাচার-এর কৃতিত্ব আমাদের সুপরিচিত। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ইডিয়মস অব ইমপ্রুভমেন্ট: বিদ্যাসাগর অ্যান্ড কালচারাল এনকাউন্টার ইন বেঙ্গল প্রকাশের পর প্রায় দু-দশক পার হয়েছে। ইমপ্রুভমেন্ট তথা উন্নতির বিবেচনায় ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমাজবিবেককে মাতৃভাষায় বোঝাপড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন হ্যাচার। সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলার তিনটি ধারা সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছিল।

সেই থেকে গবেষণার নিবিষ্ট ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লেখকের চেনাজানা, বিচারবিবেচনার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের জীবনভর এবং জীবনান্ত বহু ঘটনা জড়ো করেছেন লেখক। তাদের সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যায় প্রকাশ পাচ্ছে সেই মনীষীর বিশিষ্ট পরিচিতি। অন্যত্র বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এমন কয়েকটি ব্যাপার বাদ না গেলেও বর্তমান বয়ানে তাদের বড় একটা গুরুত্ব নেই। যেমন ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কৃত পাণ্ডিত্য অর্জন, পাঠ্যপুস্তক রচনার কৃতিত্ব, যৌবনে প্রগতিশীল ধর্মসংস্কারের সঙ্গে যোগাযোগ, বিধবা বিবাহ আন্দোলনের কর্মকাণ্ড। সমগ্রতার সন্ধানে জীবনান্ত (আফটার লাইফ) ঘটনার কথায় জোর দেন লেখক। বিদ্যাসাগরের মতো স্মরণীয় ব্যক্তির স্মৃতি-উদ্যাপনের, স্মরণিকার অজস্র দৃষ্টান্তে তাঁর জীবনবৈচিত্রের কোনও না কোনও লক্ষণের পরিচয় অবান্তর হয় না। তা বোঝাতে কর্মটাড়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে জীবনান্ত নজির প্রয়োগের শুরু করেন হ্যাচার।

নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতে নাগরিক জীবনের পাবলিক পরিসরে বীতশ্রদ্ধ বিদ্যাসাগর গ্রামের গার্হস্থ্য দৈনন্দিনেও অনেক অশান্তিতে আহত হন। পঞ্চাশোর্ধ্বে শান্তির খোঁজে জনবিরল কর্মটাড়ে মাঝে মাঝে বসবাসের উদ্দেশ্যে আমবাগান সংলগ্ন একতলা একটি বাংলো বাড়ি নির্মাণ করেন বিদ্যাসাগর। নাম দেন নন্দন কানন। কর্মটাড় স্টেশনের খুব কাছে। জায়গাটি ছিল সাঁওতাল প্রধান। তাঁদের সারল্য ও সততায় মুগ্ধ ছিলেন বিদ্যাসাগর। হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসার গুণে তাঁদের আপন করে নেন। আবার ভুট্টা লেনদেনের ব্যবস্থাও ছিল খাদ্য জোগানের অনুকূল। ২০১২-তে লেখক কর্মটাড় গিয়ে দেখছেন নন্দন কানন বহাল তবিয়তে আছে। আদি ডিসপেনসরি চাপা পড়লেও হালের একটি ‘বিদ্যাসাগর দাতব্য হোমিয়ো চিকিৎসালয়’ চালু রয়েছে। বাংলোর মুখোমুখি বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবীর নামাঙ্কিত একটি মেয়েদের স্কুল স্থাপিত হয়েছে। আমবাগানের শোভাবৃদ্ধিতে সংগঠকদের মনোযোগ প্রকাশ পায়। স্টেশনটির নাম এখন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি ও পরিচয় তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।

বিদ্যাসাগর: মধ্যাহ্নে ও সায়াহ্নে। শিল্পী: বি হাডসন (১৮৫১-’৫২)
ও যদুনাথ পাল (আনু. ১৮৯০)। উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ
গ্রন্থাগার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সৌজন্যে।

বাংলোর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন হ্যাচার। স্কুলের দু’টি মেয়ে তাঁকে ঘন গাছপালার আড়াল পেরিয়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি সমীপে পৌঁছতে সাহায্য করে। বৃক্ষরোপণের পরিকল্পিত সৌন্দর্যায়নে বিদ্যাসাগর যেন সহজে দেখা দেন না। লোকচক্ষুর আড়ালে যেতেই তো কোনও দিন এই নন্দন কানন-এর সূচনা। লেখকের এই মন্তব্যে ধরা যেতে পারে বিদ্যাসাগরকে চেনাজানায় কর্মটাড়ের জীবনভর আর জীবনান্তিক আবেদন।

বইটিতে বিদ্যাসাগরের স্বরচিত জীবনচরিত থেকে বহু হদিশ উল্লেখযোগ্য। বাবা মা উভয় কুলের স্বজনবর্গের পরিচয় দেন বিদ্যাসাগর। নিজের আট বছর বয়সে কলকাতায় আসার ঘটনায় শেষ এই জীবনচরিত। সেই মাইলস্টোন গুনতে গুনতে বাবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বিদ্যাসাগরের কলকাতা আসার পরিচিত গল্প। সে ভাবেই ‘ইংরেজি অঙ্ক’ শেখার সূচনা। বাবা মা পূর্বপুরুষদের জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতায় জড়িত ঈশ্বরচন্দ্রের নিজের গড়ে ওঠার বেশ কিছু নমুনা ধরা যায়। একান্নবর্তী পারিবারিক ব্যবস্থায় ভাঙন চোখে পড়ে। স্বনির্ভরতার প্রয়োজন বাড়ছে। টোল চতুষ্পাঠীতে ছাত্রের জোগান কমছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কলকাতায় কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা। মাইলস্টোন গোনাগুনতিতে ঈশ্বরের কৃতিত্বে মুগ্ধজনের তো ইংরেজি-শিক্ষার জরুরত নিয়ে তারিফের অন্ত নেই। বক্তব্য এই যে ‘মোটামুটি ইংরেজি জানিলে... সওদাগর সাহেবদিগের হৌসে ও সাহেবদের বড়বড় দোকানে অনায়াসে কর্ম করিতে পারিবেক।’ বিদ্যাসাগর চরিত থেকে কালের গতির পরিচয় বিশিষ্ট তাৎপর্যে বোঝা সম্ভব। সন তারিখের হিসেব করলে জানা যায় পলাশির যুদ্ধের বছর দুই আগে বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের জন্ম। মৃত্যু ১৮২৮। তখন আট বছরের বিদ্যাসাগর পাঠশালা পরবর্তী শিক্ষা অর্জনে পদব্রজে কলকাতা আসছেন।

ঔপনিবেশিক প্রতিকূলতার দরুন মানবিকতার (হিউম্যানিজম) অবরোধে বিদ্যাসাগরের নিজের কর্মকাণ্ডে বাধাবিঘ্নের অন্ত ছিল না। খানিকটা কম পরিচিত সব ঘটনার আলোচনায় তেমন অভিজ্ঞতার ধরন ধারণ বুঝতে চেয়েছেন লেখক। বাউল ফকিরের গানে আকৃষ্ট হতেন বিদ্যাসাগর। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বিদ্যাসাগর জীবনী-তে আছে অখিলদ্দিন নামে এক অন্ধ ফকিরকে রাস্তা থেকে নিজের বাড়িতে ডেকে অনেক ক্ষণ বিভোর হয়ে গান শোনেন বিদ্যাসাগর। থ্যাচার-এর মন্তব্য এই যে, যুক্তি আর বিশ্বাসের সঙ্গতিতে আমরা পাচ্ছি মানবিকতার সমগ্র অঙ্গীকার। রামকৃষ্ণ পরমহংস, মহেন্দ্রলাল সরকার এবং বিদ্যাসাগরের কিছু কিছু কথাবার্তার ব্যাখ্যা বিবেচনায় আয়রনির ব্যঞ্জনায় জোর দিয়েছেন হ্যাচার। তার সঙ্গে অবশ্য ঔপনিবেশিক অনুষঙ্গে অজস্র স্ববিরোধের যোগাযোগও নিশ্চয় উপেক্ষণীয় নয়।

একান্ত সুহৃদ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন বছরের কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড শোকাকুল হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রভাবতী সম্ভাষণ-এ লেখেন, ‘সংসার নিতান্ত বিরস ও বিষময় হইয়া উঠিয়াছে। কেবল এক পদার্থ ভিন্ন, আর কোনও বিষয়েই, কোনও অংশে কিঞ্চিন্মাত্র সুখবোধ বা প্রীতিলাভ হইত না। তুমি আমার সেই এক পদার্থ ছিলে।’ সমাজের প্রতিকূলতা ছাড়া সে সময় বীরসিংহের বাড়িতেও ভাইদের আচরণেও তেমন সদ্ভাব ছিল না।

বহুবিবাহের পক্ষবিপক্ষ হিসেবে নিজের পরম বন্ধু এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের তুমুল মতবিরোধ হয়। রুচি ও নৈতিকতার প্রশ্নে তর্কবাচস্পতি বহুবিবাহের সমর্থক ছিলেন না। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বিদ্যাসাগরের ত্রুটিবিচ্যুতির সমালোচনায় তিনি একটি সংস্কৃত নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ক্রোধান্ধ প্রতিক্রিয়ায় স্বনামে ছদ্মনামে বাচস্পতির কঠোর সমালোচনা করেন বিদ্যাসাগর। এ সব লেখার কোথাও কোথাও অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। আবার তর্কবাচস্পতির মৃত্যুতে বিদ্যাসাগরের শোকোক্তি যে দেশের শেষ প্রকৃত পণ্ডিতটি চলে গেলেন।

সে কাল এ কাল মিলিয়ে বিভিন্ন লেখকের রচিত বিদ্যাসাগর জীবনী এবং তাঁর সম্পর্কে বিশ্লেষণ আলোচনায় নিবিষ্ট বহু গ্রন্থের চেনাজানা, বোঝাপড়ায় হ্যাচার-এর তৎপরতা যথেষ্ট বলা যায়। ঔপনিবেশিক প্রতিকূলতার মোচড়ে মোচড়ে বিদ্যাসাগরের অনেক পথনির্দেশ ঠিক সফল হয়নি। বড় নিরুপায় যন্ত্রণায় ভরা তাঁর জীবনে করুণা উদ্যম ব্যর্থতা ক্রোধের সমাহার। প্রায় দু-শতক পরে আজও আমাদের নারীনিগ্রহ নির্যাতনের বাহুল্যে, শিক্ষাক্ষেত্রে অভাব অপচারের শেষ নেই। বিদ্যাসাগরের জীবনান্তিক বার্তা বলে ওঠে তাঁকে আজও আমাদের চাই। তেমন বাক্যেই বইটি শেষ করেছেন লেখক, ‘বিদ্যাসাগর, দাউ শুডস্ট বি লিভিং অ্যাট দিস আওয়ার!’

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসে অর্থনীতির ভূতপূর্ব শিক্ষক

book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy