Advertisement
E-Paper

উদ্ভাসিত শান্তিনিকেতনের সৌন্দর্যের উৎসমুখ

অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ।রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন বিশ্বভারতী-ই ধারণ করেছে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ফসল। বিশ্বভারতী আবিশ্ব-মনীষাকে একটি কেন্দ্রে সংহত করেছে। তাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে দেশের অন্তরে। কিন্তু বিশ্বভারতী শুধু মাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল না। শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও জীবনের প্রাণ থেকে জেগে উঠেছিল এই প্রতিষ্ঠান। সেই প্রাণের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে সমগ্র দেশেরও চৈতন্য-প্রবাহের। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন তাই ভারতবর্ষের মর্মবাণীকে পরিস্ফুট করে। কবি হয়তো এরকমটাই চেয়েছিলেন।

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০১

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন বিশ্বভারতী-ই ধারণ করেছে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ফসল। বিশ্বভারতী আবিশ্ব-মনীষাকে একটি কেন্দ্রে সংহত করেছে। তাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে দেশের অন্তরে। কিন্তু বিশ্বভারতী শুধু মাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল না। শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও জীবনের প্রাণ থেকে জেগে উঠেছিল এই প্রতিষ্ঠান। সেই প্রাণের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে সমগ্র দেশেরও চৈতন্য-প্রবাহের। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন তাই ভারতবর্ষের মর্মবাণীকে পরিস্ফুট করে। কবি হয়তো এরকমটাই চেয়েছিলেন।

অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছবিতে শান্তিনিকেতনের আনন্দ ও সৌন্দর্যের উৎসমুখটি মেলে ধরতে চেয়েছেন। অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর যে একক প্রদর্শনী, তার শিরোনাম: ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ: ফ্রেন্ডস অব রবীন্দ্রনাথ’। প্রবহমান বিশ্বকে সহমর্মিতায় সঞ্জীবিত করে রাখে যাঁরা, সেই প্রকৃতি ও মানুষ রবীন্দ্রনাথেরও বন্ধু। অরুণেন্দু রবীন্দ্র-গবেষণার সূত্রে শান্তিনিকেতনে কাজ করছেন বহু দিন থেকে। প্রকৃতি ও জীবনের একাত্মতা সম্পর্কে যে অনুভব জাগিয়েছে, তাকেই তিনি প্রকাশ করেছেন ছবিতে ও ড্রয়িং-এ।

ছবিগুলি ভূমিজ ও উদ্ভিজ্জ গুড়ো রঙে আঁকা। সঙ্গে রয়েছে তুলি ও কালি-কলমের রেখা ও কিছু জলরঙের ছোঁয়া। ছবির ক্ষেত্রে অরুণেন্দু নিজের পথ নিজে তৈরি করেছেন। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডির মধ্যে তাঁকে আবদ্ধ থাকতে হয়নি। স্থপতি হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতাকে যেমন কাজে লাগিয়েছেন, তেমনি পরিবেশবিদ হিসেবে প্রকৃতির প্রতি তাঁর ভালোবাসার অনুভব প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আর এর অলক্ষ্যে সন্তর্পণে ক্রিয়াশীল থেকেছে রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর বিশ্ববোধ ও পরিবেশ-ভাবনা। তাঁর ছবি কোনও বিশেষ ঘরানার অন্তর্ভুক্ত নয়। বিভিন্ন শৈলী ও আঙ্গিক-পদ্ধতির সমন্বিত রূপ। আধুনিকতার আঙ্গিক- পদ্ধতিতে কতগুলি বিশেষ অভিমুখকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন স্বাভাবিকতাবাদ বা ন্যাচারালিজম, প্রতিচ্ছায়াবাদ বা ইম্প্রেশনিজম অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেশনিজম, যার আদি উৎস আদিমতা এবং ঘনকবাদী জ্যামিতিক কৌণিকতা বা কিউবিজম। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন লৌকিক সারল্য সম্পৃক্ত উৎস ও প্রাচীন ধ্রুপদী আদর্শায়িত রূপচেতনা। এ সমস্ত আঙ্গিকের এক বা একাধিক উৎসের সমন্বয়ে একজন শিল্পী গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব রূপনির্মাণ পদ্ধতি। এক প্রান্তে অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতা, অন্য প্রান্তে পরিপূর্ণ বিমূর্ততা, এই দুইয়ের মধ্যে আন্দোলিত হয় সেই ‘রূপ’। অনেক সময়ই তা ফ্যান্টাসির বিভিন্ন আবহ তৈরি করে। কখনও তা প্রতিবাদী, দ্বন্দ্বাত্মক। কখনও প্রশান্ত, সমাহিত।

অরুণেন্দু প্রকৃতির ভিতর সেই শান্ততার সুরেলা অনুরণন শুনতে পান। সেই প্রশান্তিরই রূপ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। রেখা-বিন্যাসে লৌকিক সারল্যের সুস্মিত ছন্দ অনেক সময়ই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান অবলম্বন। সেই ছন্দকে তিনি রূপান্তরিত করেন। কল্পরূপের দিকে নিয়ে যান। ইম্প্রেশনিজমের আত্মগত বিশ্লেষণ বা রূপান্তরণ-পদ্ধতি সেখানে হয়ে ওঠে তাঁর অন্যতম এক অবলম্বন। প্রকৃতিতে যে আদর্শায়িত ছন্দের দোলা, সেই ছন্দটিকে যেমন তিনি রেখারূপে প্রতিস্থাপিত করতে চান, তেমনি সেই ছন্দের বিন্যাসে প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করেও যান অনেক সময়। গাছ নেই, পাতা নেই, মাঠ নেই, নদী নেই; রয়েছে শুধু এসবের প্রবহমান ছন্দ। সেটা পরিস্ফুট হয় রেখার বিন্যাসে যেমন, তেমনি ছায়াতপে এবং বিন্দুমাত্রিক বিচ্ছুরণের বিভিন্ন স্পন্দনে। এখানে অলঙ্করণের এক বিশেষ ধরন তৈরি করেন তিনি। যার ভিতর কখনও থাকে লৌকিক আলপনার অনুষঙ্গ। কখনও আদিবাসী চিত্রের সূক্ষ্ম স্মৃতি।

মানুষের মুখ এসেছে কিছু ছবিতে। দ্বিমাত্রিকভাবে সংস্থাপিত সেই মুখের সমাহারে করুণ কল্পরূপের বিশেষ ধরন তৈরি হয়। একটি ছবিতে যূথবদ্ধ কিছু মানুষ শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির প্রতি যে নৈরাজ্যমূলক আচরণ, তারই এক প্রতীকী প্রতিবাদ যেন এই ছবিতে। নিসর্গ রচনায় শান্তিনিকেতন-ঘরানার বিশেষ ধরন চিহ্নিত করা যায় রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের ছবির অনুষঙ্গে। অরুণেন্দুর ছবিতে এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন নেই কোথাও। আছে শুধু এসবেরই সমন্বিত দূরতর এক সারাৎসার। এ দিক থেকে তাঁর স্বকীয়তা অনস্বীকার্য।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy