Advertisement
E-Paper

কুবির কেন অবজ্ঞাতই থেকে গেলেন

সুধীরবাবু লালন নিয়ে লিখছেন। আবার লিখছেন। সাধারণত একই বিষয় নিয়ে যখন কোনও লেখক বারবার লেখেন, তাতে পুনরাবৃত্তি এক ভয়ঙ্কর ছায়া ফেলে। ভয় হয় এ কি লোকগল্পের সেই একই কুমিরছানাকে বারবার দেখানোর মতো হয়ে যাবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো তাই হয়।

সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
লালন সাঁই কুবির গোঁসাই আর তাঁদের ১০০ গান, সুধীর চক্রবর্তী। ইন্ডিক হাউস, ৩২৫.০০

লালন সাঁই কুবির গোঁসাই আর তাঁদের ১০০ গান, সুধীর চক্রবর্তী। ইন্ডিক হাউস, ৩২৫.০০

সুধীরবাবু লালন নিয়ে লিখছেন। আবার লিখছেন। সাধারণত একই বিষয় নিয়ে যখন কোনও লেখক বারবার লেখেন, তাতে পুনরাবৃত্তি এক ভয়ঙ্কর ছায়া ফেলে। ভয় হয় এ কি লোকগল্পের সেই একই কুমিরছানাকে বারবার দেখানোর মতো হয়ে যাবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো তাই হয়। দু’পার বাংলার একাধিক লালন গবেষক লালনকে একপ্রকার বইবাজারের পুঁজি বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সুধীরবাবুর ক্ষেত্রটা আলাদা। লালন প্রসঙ্গ তাঁর বিভিন্ন লেখায় একাধিক বার এসেছে, কখনও প্রাসঙ্গিকতার স্বল্প পরিসরে, কখনও বা দীর্ঘাঙ্গ অবয়বে। সুধীরবাবুর ক্ষেত্রে মজাটা হল যে তাঁর লেখায় লালনের পুনরাবির্ভাব কখনওই পুনরাবৃত্তি নয়। প্রতিটি পুনরুত্থানেই যেন এক ভিন্ন লালনকে দেখি। একই তথ্য পুনর্ব্যবহৃত হলেও সেই ব্যবহারে থাকে নতুন কোনও অনুসন্ধানের হদিশ, লালন ফকিরের ব্যাপ্ত চরাচরে প্রভা পায় সুধীরবাবুর লেখনীর ব্যাপ্তি। এতদিন পর্যন্ত সুধীরবাবুর গবেষণালব্ধ লেখায় আমরা লালনকে পেয়েছি নানা রূপে— কখনও তাঁর গানের দ্যোতকতা উদ্ঘাটনে, তাঁর তীর্যক সমাজ ব্যঙ্গ কর্তনে, সাধকসত্তার কীর্তনে, লিঙ্গসাম্যের প্রসঙ্গে, কখনও বা তাঁর গানের কাব্যগুণের বিভাস-বিশ্লেষে— মোট কথা, এক গবেষকের দুরবিনে, যেখানে লালনই প্রধান, লালন-পালনই গবেষকের অভিলব্ধ। সেই নিরিখে তাঁর এই সাম্প্রতিক বইটি অনেকটাই ভিন্ন। বিষয়গত ভাবে বইটি দ্বিধান্বিত। বাংলার দুই মরমী সাধক ও পদকর্তাকে নিয়ে: লালন সাঁই ও কুবির গোঁসাই। প্রথম পর্বে এঁদের দুজনের ওপর আলাদা আলাদা গদ্যাংশ ও তারপরে, দ্বিতীয় পর্বে, তাঁদের ৫০টি করে গান।

বইটিতে, (এক) লালন উপস্থিত হয়েছেন তুল্যমূল্যের তারাজুতে, কুবির গোঁসাই-এর সমান্তরালে; (দুই) সুধীরবাবুর লেখক মানসে নৃতাত্ত্বিকের অনুসন্ধানের সঙ্গে পাই এক অন্য ধরনের সাবজেক্টিভিটি, এক ধরনের অটোএথনোগ্রাফি বা নৃতাত্ত্বিকের নৃতত্ত্ব। সামনে রাখা স্মৃতির আয়নাতে নৃতাত্ত্বিক ফোরগ্রাউন্ডে যেন দেখছেন নিজেকে, পিছন ফিরে নৃতত্ত্বে রত, খানিক দূরেই তাঁর গবেষণার সাবজেক্টরা— লালন ও কুবির। ডবল এক্সপোজার।

লালন ও কুবিরের গল্পকে বিশ্লেষণের ব্যাখ্যানে ধরেছিলেন নৃতাত্ত্বিক, বহু বছরের অধ্যবসায়ে, বারবার ফিরে যাওয়া ক্ষেত্র-সমীক্ষায়। সেই গবেষণার ও গবেষকের অধ্যবসায়ের গল্পকে আখ্যানের আধারে আবার ধরা। ফিরে ধরা। কুরোসাওয়ার ছবির মতো। গল্পের ভেতরের গল্পের ভেতরকার গল্প। কোলরিজের বিখ্যাত উক্তিটির সম্প্রসার করে বলা যেতে পারে, আ উইলিং সাসপেনশন অফ ‘দি উইলিং সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’। পক্ষান্তরে, জ্ঞানযোগ ও অদ্বৈত বেদান্ত-র ‘নেতি নেতি’-র যুক্তিক্রম। কেন না, নৃতাত্ত্বিক নিজেও তো নৃতত্ত্বের বিষয় হতে পারেন। সহস্রাক্ষ মাছির মতো উদ্যোগী হয়ে রসাল সাবজেক্টকে ওপর থেকে ভনভনিয়ে, খতিয়ে দেখছেন নৃতাত্ত্বিক, অথচ লিখছেন যখন, তখন যেন তিনি এক ভাবাবেগহীন বিনয়ী লেখক, যাঁর কলমে ‘আমি’ শব্দটাই অনুপস্থিত। তিনি যেন অবজেক্টিভ এক ক্যামেরা মাত্র, যে দেখতে জানে, দেখাতে জানে, ব্যক্তিক কোনও হেলদোল ছাড়াই। কিন্তু আসলে তো তা হতে পারে না। গল্পের পিছনে থাকে গল্পকারের গল্প। দুটো গল্প একসঙ্গে বলার কোনও উপায় কি খুঁজে পাওয়া যায়? দুরূহ প্রশ্ন। কেননা নৃতত্ত্ব বলে অধ্যয়ন ও বিদ্যাচর্চার যে ধারাটি নির্মিত হয়েছে, তার উত্থান-গল্পে রয়েছে উপনিবেশবাদের অভিসন্ধি-সূত্র ও তারপরে বিশ শতকের আধুনিকতাবাদের নির্মিতি। যার অনুষঙ্গে এসেছে তথাকথিত ‘ক্রিটিক্যাল ভিউয়িং’-এর নৈর্ব্যক্তিকতা। যেন নৈর্ব্যক্তিক ছাড়া ‘ক্রিটিক্যাল ভিউয়িং’ বা গভীর পাঠ সম্ভব নয়। তাই কি? কোনও অভিজ্ঞতাই তো একেবারে একশো ভাগ নিরপেক্ষ বা নৈর্ব্যক্তিক হয় না। ‘নৈর্ব্যক্তিক’ শব্দটার ঠিক মাঝখানেই তো ‘ব্যক্তি’! গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে কালচারাল স্টাডিজ ও পারফর্মেন্স স্টাডিজের উত্থানে দেখি এই নির্মিতিবাদের খণ্ডন, স্বয়ং নৃতত্ত্ববিদের ‘সাবজেক্ট’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। স্বীকৃত সাবজেক্টের মাধ্যমেই অবজেক্ট ও অবজেক্টিভিটির সন্ধান। যাকে আখ্যা দেওয়া যায়, ‘পারফর্মেটিভ রাইটিং’।

এই সন্ধান পন্থায় সুধীরবাবু আলোকিত করেছেন দুটি সমান্তরাল জীবন, লালন ও কুবির, যাঁরা কালে ও পাত্রে শুধু নন, স্থানেও ছিলেন নিকটবর্তী। দুটি সমান্তরাল রেখা যাঁরা সাধনার অনন্তে গিয়ে মিলে যান। অথচ অমিলও রয়েছে বেশ কিছু। তার কিছু যেমন তাঁদের স্বীয় স্বীয় রচন/বচন-তরিকার তারতম্যে, শ্রেণি ও সমাজগত অবস্থানের হেরফেরে, অধিকন্তু তাঁদের ভেদের জায়গাগুলি চিহ্নিত করেছে বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের হাতে তাঁদের বৈষম্যমূলক স্বীকৃতি। লালন ফকির আজ যেমন দুই বাংলার লোকনায়ক, বহুল চর্চিত ও গীত (সে বিকৃত রূপে হলেও), কুবির গোঁসাই-এর নাম জানেন ক’জন, তাঁর গান জানা তো দূরে থাক। অথচ অবাক কাণ্ড, লালনের গানের টেক্সট নিয়ে যে প্রবল বাকবিতণ্ডা বা তাঁর অর্ধশিক্ষিত মুরিদদের হস্তাক্ষরে লিখিত গানের খাতা নিয়ে যে সমস্ত প্রশ্ন ও দ্বন্দ্ব, শোনা গান আর পড়া গানের ভেদ-নিরূপণ, এ ধরনের কোনও সমস্যাই কিন্তু কুবির গোঁসাই-এর গানকে ঘিরে নেই। তাঁর গানের খাতা ভক্তদের হাতে সুসংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, তাঁর সমাধির পার্শ্ববর্তী ভিটেয়। ১২০৯ খানি গান রয়েছে তাতে; মূল না হলেও, মূলানুগ অনুলিখন। তা হলে কেন কুবির উপেক্ষিত রয়ে গেলেন? সে কি তাঁর গানে সাহিত্যগুণের অভাবজনিত কারণে?

আল্লা আলজিহ্বায় থাকে...
কৃষ্ণ থাকে টাকরাতে।

অথবা,

লক্ষী আর দুর্গা কালী, ফতেমা তারেই বলি
যার পুত্র হোসেন আলি মদিনায় করে খেলা।

এই ধরনের উচ্চারণে ভাবগুণ বা কাব্যগুণ নেই তা বলি কেমন করে? তা হলে এই উপেক্ষার কারণ কী হতে পারে?

সুধীরবাবুর সাবজেক্টিভ ন্যারেটিভ চরম ক্রিটিক্যাল হয়ে ওঠে, যখন জানতে পারি দেশভাগের রাজনীতি তাঁর গবেষণাকে কী ভাবে একাধারে ব্যাহত ও সমৃদ্ধ করেছিল। ষাটের দশকে তিনি পারেননি যেমন সীমান্ত পার হয়ে লালনের সাধনপীঠ ছেঁউরিয়াতে গিয়ে পৌঁছতে, তেমনই পারেননি কুবিরের জন্মস্থানে গিয়ে সর-এ-জমিন খোঁজ নিতে। সত্তর দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে পরে দুই বাংলার মধ্যে যাওয়া-আসার একটা সরু গলি খুলে গিয়েছিল কিছু দিনের জন্য। তারই ফাঁক দিয়ে যাতায়াত করে সুধীরবাবু জেনে নিয়েছিলেন দেশভাগে ভাগ হয়েছেন লালনও, কুবিরও। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছেদের চরম ফলস্বরূপ ভিন্ন খাতে বইতে বাধ্য হয়েছে তাঁদের প্রথম জীবনের গল্পকল্প। এই দ্বিখণ্ডীকরণের প্রকোপে যেমন হারিয়ে গিয়েছিল লালনের পারিবারিক উৎসপরিচয়, তেমনই ভিন্ন মিথে পরিবৃত হয়েছে কুবিরের জন্ম ও যৌবন বৃত্তান্ত। লালন ও কুবিরের সমসাময়িক বঙ্গভূখণ্ডে যদি সীমান্ত বসানো যেত, তা হলে দেখা যেত লালনের জন্ম এপারে, মৃত্যু ওপারে, আর কুবিরের ঠিক উলটো। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রকামী দ্বিচারণ ফান্দে ফেলে িদয়েছিল নৃতাত্ত্বিক বগাকে। সুধীরবাবুর ব্যক্তিক আখ্যান সেই নিরিখে প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, শেষে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যানে সমৃদ্ধই হয়েছে। তথ্য-তত্ত্বের তারাজুতে চড়েছে তর্ক-তহমতের ওজন, ব্যক্তিগত আখ্যানের অস্ত্রে লেগেছে ক্রিটিক্যাল ব্যাখ্যানের শান। সুধীরবাবুর কলমেই (আবার) বাংলা ভাষায় পরিচয় পেলাম এক ভিন্নতর দিকদর্শনের, পারফর্মেন্স স্টাডিজের নামাবলিতে যাকে বলে, ‘পারফর্মেটিভ রাইটিং’।

প্রশ্ন তবু থেকেই যায়—এই দুই ভাব-সাধকের একজন কেন প্রায় অবজ্ঞাত থেকে গেলেন? কুবিরের জীবনে ধর্মান্তরের নাটকীয় রসদ ছিল না তাই? কিন্তু হিঁদুর বেটা হয়েও তো কুবির আল্লাকে সেজদা দিয়েছিলেন? লালনের মতোই জাপ্টে ধরেছিলেন দুই সম্প্রদায়ের জগাই-মাধাই দুজনকেই, নদিয়ার সমন্বয়ী ধারা অব্যাহত রেখে?

রাম কি রহিম করিম কালুল্লা কালা
হরি হরি এক আত্মা জীবনদত্তা
এক চাঁদে জগৎ উজলা।

পক্ষান্তরে লালনও তো একই সুরে বলেছেন,

এক চাঁদে হয় জগৎ আলো
এক বীজে সব জন্ম হইল

লালন বলে মিছে কল
কেন শুনতে পাই?

অনতিদূর আগামীতে এ ধাঁধাঁর নিরূপণ-দায়িত্ব নেবেন হয়তো কোনও নৃতাত্ত্বিক। তার আগে সুধীরবাবুকে বলব, অগ্রজ ও গুরুপ্রতিম আপনি, কুবিরের ১২০০ গানের এক-চতুর্থাংশের হলেও, আখ্যান-ব্যাখ্যানের যুগ্মালোকে আলোকিত একটি সটীক সংকলন আমাদের হাতে তুলে দিন।

তার নাম হতে পারে ‘ব্রাত্য অবজ্ঞাত কুবির’।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy