Advertisement
E-Paper

ক্যানভাসে উন্মীলিত নিঃশব্দ কবিতার চিত্রকল্প

ক্যানভাসে উন্মীলিত নিঃশব্দ কবিতার চিত্রকল্প অ্যাকাডেমিতে চলছে সুমনা ঘোষের একক প্রদর্শনী। দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।কবিতা ও ছবির মধ্যে একটা সমান্তরাল সম্পর্ক আছে। সম-অন্তরাল বা সমান দূরত্ব বজায় রেখেই দুজনের চলা। তাতে তাদের মিলে যাওয়ার বা এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কখনও তৈরি হয় না। কিন্তু একের আলো বা একের অভিজ্ঞান প্রতিনিয়তই অন্যকে ছুঁয়ে যেতে চায়।

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

কবিতা ও ছবির মধ্যে একটা সমান্তরাল সম্পর্ক আছে। সম-অন্তরাল বা সমান দূরত্ব বজায় রেখেই দুজনের চলা। তাতে তাদের মিলে যাওয়ার বা এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কখনও তৈরি হয় না। কিন্তু একের আলো বা একের অভিজ্ঞান প্রতিনিয়তই অন্যকে ছুঁয়ে যেতে চায়। এরকম তুলনাও দিয়েছেন অনেক প্রাজ্ঞজন। যে ছবি হল অনুচ্চার কবিতা, আর কবিতা হল উচ্চারিত ছবি। একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ প্রবল। কিন্তু দুজনকেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের পরিসর বজায় রেখে অন্যের সারাৎসার আত্মস্থ করতে হয়। কবিতা নিয়ে যখন কেউ ছবি করতে চান, তখন কবিতার সত্তাকে প্রসারিত করার দায় থাকে তাঁর। কবিরও দায় থাকে ছবির আপাত স্থির প্রতিমাকল্পকে উন্মীলিত করার।

সুমনা ঘোষের সপ্তম একক প্রদর্শনী চলছে অ্যাকাডেমিতে। প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ২৫-টি ছবির মধ্যে বেশ কিছু ছবি তিনি করেছেন কবিতা অবলম্বন করে। কবিতার সচিত্রকরণ বা ইলাস্ট্রেশন তিনি করেন নি। কবিতার অন্তর্নিহিত বীজ থেকে পল্লবিত করে তুলতে চেষ্টা করেছেন ছবির নিজস্ব অবয়ব ও সম্পৃক্ত প্রাণ। কবিতার ছন্দিত সুষমা তাঁর ছবিতে উন্মীলিত করেছে কল্পরূপের বিভিন্ন আবহ। বাস্তবের ভিত্তি থেকেই জেগেছে সেই কল্পরূপ। আপাত-বাস্তবকে দ্রবীভূত করে সেই কল্পরূপ ব্যঞ্জিত করেছে জীবনের বা অনুভবের বিভিন্ন মাত্রা।

একজন অনামী কবিতা লেখকের একটি কবিতা-সংকলন থেকে কয়েকটি কবিতা বেছে নিয়েছেন শিল্পী। সংকলনটির নাম ‘রাত্রির শূন্যের প্রান্তে।’। আঁধার অনেক সময়ই সৃজনের গর্ভগৃহ। তার ভিতর যখন পার্থিব বা অপার্থিব আলোড়নে শূন্যতা সঞ্চারিত হয়, তখন সৃজনের মূল কেন্দ্রটিই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। সেই সংকটকেই নানাভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই প্রয়াসে ঝলসে উঠেছে নানাবিধ আলো। আবার আঁধারে তা আবিলও হয়ে গেছে। আলো-আঁধারের দ্বান্দ্বিকতা থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর ছবি। কবিতা সংকলনটির নামের সাযুজ্যে এই চিত্রমালার শিরোনাম দিয়েছেন শিল্পী: ‘অন দ্য এজ অব নকটারনাল ভয়েড’।

সংকলনের একটি কবিতার শিরোনাম ‘গন্ধ’-এর অনুসরণে যে ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী, তার নাম দিয়েছেন ‘গন্ধই চেনায়’। গন্ধ একটি বিমূর্ত অনুষঙ্গ। কবিতায় গন্ধের কথা বলা যায়। কিন্তু ছবিতে তাকে রূপায়িত করা যায় না। এটা ছবির একটা সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্র। তাই শিল্পীকে যা করতে হয়, তা হল এই বিমূর্ত বোধকে দৃশ্য-রূপে রূপান্তরিত করে নেওয়া। সুমনা তাঁর ছবিতে এটাই করেছেন। কবিতায় বলা হয়েছে গল্পই মানুষকে চেনায় প্রকৃতি থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত সমস্ত অভিজ্ঞান। তার পরেও অমোঘ এক শূন্যতা পরিব্যাপ্ত করে তাঁর চেতনাকে। কবিতার ভাষায়—‘তবু মধ্যরাতে জেগে উঠে দেখি/ তিমিরের গর্ভের ভিতর এক বিপন্ন শূন্যতা দোল খাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়।’ শিল্পী চিত্রপটকে দুই ভাগে বিভাজিত করেছেন। এক পাশে দিনের রৌদ্রাভা, অন্য পাশে রাতের তিমির। আলোতে অবস্থান করছে একটি পাখি। আঁধারে ভাসমান এক মানবী। মধ্যভাগে গন্ধলীন কুসুমিত এক বৃক্ষের তলায় নির্জনে দাঁড়িয়ে আছে একাকী মানুষ। বুকের কাছে তাঁর বিপন্ন শূন্যতা, আঁধারলীন বৃত্তের প্রতীকে রূপায়িত। দোলনেরও প্রতীক ধরা আছে মানুষটির হাতে। দৃশ্য-প্রতীক নির্মাণের স্বাধীনতা শিল্পীর একান্ত নিজস্ব। কবিতার বিমূর্ততাকে এভাবেই দৃশ্যপ্রতীকে রূপায়িত করে এর নিহিত ভাবকে প্রসারিত করেছেন শিল্পী।

আর একটি কবিতার প্রথম দুটি লাইনে বলা হয়েছে: ‘সপ্তপর্ণী বৃক্ষমূলে রেখে দাও বাসনা তোমার / হেমন্তে সুবাস এসে জাগাবে কামনা’। এখানে ‘বাসনা’-কে শিল্পী রূপায়িত করেছেন পাখির ডিমের প্রতীকে, ‘সপ্তপর্ণী বৃক্ষমূলে যার অবস্থান। আর ‘কামনা’ ব্যাঘ্ররূপী এক নারীতে রূপান্তরিত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে আঁধারের দিকে। যেখানে রয়েছে ভোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। মানবীর হাতে এক মানবের মুখ, যা তাঁকে ‘স্বপ্নিল’ করে রেখেছে ‘শান্তিনিকেতন’-এর অভীপ্সায়। এভাবেই বাকপ্রতিমাকে চিত্রপ্রতীকে রূপান্তরিত করে বিভিন্ন ছবিতে শিল্পী তাঁর নিজস্ব বোধের নানা স্তরকে ব্যঞ্জিত করেছেন। এই একই প্রদর্শনী এর পরে অনুষ্ঠিত হবে সোদপুরের জলসাঘর গ্যালারিতে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy