Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক ২...

‘খাঁচা থেকে বেরিয়ে জানি না, কী করব’

সুমন্ত গুনগুন করে গেয়ে ওঠে— নাক কামড়াই, কান কামড়াই,/ কামড়ে দিলাম মন,/ তুমিই আমার/ আঙুরলতা এবং ত্রিভুবন...। সুমন্তর পিঠ, পিঠের ওপর শান্তার হাত এঁকে চলেছে, রাস্তা থেকে একটা বাঁশির সুর ভেসে আসে। ক্যামেরা তার মুখের ওপর নেমে আসে। বাঁশির শব্দ শোনা যায়।— ‘কালপুরুষ’ ছবির চিত্রনাট্যের একটা টুকরো। সম্প্রতি প্রকাশ পেল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য সংগ্রহ (দে’জ, ৭৫০.০০), এতে অন্য চিত্রনাট্যগুলি দূরত্ব, নিম অন্নপূর্ণা, গৃহযুদ্ধ, শীতগ্রীষ্মের স্মৃতি, ফেরা, বাঘবাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর, লাল দরজা, উত্তরা, মন্দমেয়ের উপাখ্যান, স্বপ্নের দিন ছবির।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

সুমন্ত গুনগুন করে গেয়ে ওঠে— নাক কামড়াই, কান কামড়াই,/ কামড়ে দিলাম মন,/ তুমিই আমার/ আঙুরলতা এবং ত্রিভুবন...। সুমন্তর পিঠ, পিঠের ওপর শান্তার হাত এঁকে চলেছে, রাস্তা থেকে একটা বাঁশির সুর ভেসে আসে। ক্যামেরা তার মুখের ওপর নেমে আসে। বাঁশির শব্দ শোনা যায়।— ‘কালপুরুষ’ ছবির চিত্রনাট্যের একটা টুকরো। সম্প্রতি প্রকাশ পেল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য সংগ্রহ (দে’জ, ৭৫০.০০), এতে অন্য চিত্রনাট্যগুলি দূরত্ব, নিম অন্নপূর্ণা, গৃহযুদ্ধ, শীতগ্রীষ্মের স্মৃতি, ফেরা, বাঘবাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর, লাল দরজা, উত্তরা, মন্দমেয়ের উপাখ্যান, স্বপ্নের দিন ছবির। চিত্রনাট্যগুলির শেষে বইটিতে বুদ্ধদেবের যে চলচ্চিত্রপঞ্জি তাতে তাঁর ছবি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিনেমা-সমঝদারের নানা রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেখান থেকে পাঠক হদিশ পেতে পারেন পরিচালকের সিনেমাপিপাসু গহন মনটির। এ দেশ তো বটেই, গত চার দশক ধরে তাঁর ছবি আন্তর্জাতিক সিনেমার মানচিত্রে নিয়ত আলোচিত, পৃথিবীব্যাপী প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত। নিজের ছবি নিয়ে কবি-চলচ্চিত্রকার এই মানুষটির মন্তব্য: “একটি ফাঁকা গ্লাসে কিছুটা স্বপ্ন, কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা ম্যাজিক মিশিয়ে যে ‘শেক’টি তৈরি হয় তাই আমার সিনেমা।” গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকাও লিখেছেন বইটির শুরুতে, তাতে জানিয়েছেন ‘সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার মিল-টিল নিয়ে আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। দায় আমার শুধু সিনেমার কাছে।’ সঙ্গে ছবিগুলির স্থিরচিত্র, পোস্টার, এবং পরিচালকের কর্মময় ও নির্জন মুহূর্তের ছবি বইটিকে অবশ্য-সংগ্রহযোগ্য করে তুলেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ প্রকাশ করেছে দ্য পোয়েট অব সেলুলয়েড (সম্পা: প্রেমেন্দ্র মজুমদার। ১৫০.০০)। শুরুতেই সম্পাদক প্রথম ছবি থেকে চিনিয়ে দিয়েছেন পরিচালককে: ‘দূরত্ব ওয়াজ দ্য পারফেক্ট মিরর অব দ্য কনটেমপোরারি টাইম ইন দ্য ফর্ম অব আ ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি হুইচ কনফার্মড দ্য মাস্টারস সিগনেচার ইন হিজ ভেরি ফার্স্ট ফিল্ম।’ দেশ-বিদেশের দুঁদে সমালোচকদের বহুবিধ অন্তর্ভেদী রচনা ও তাঁদের নেওয়া বুদ্ধদেবের সাক্ষাৎকারে ঋদ্ধ বইটি। রয়েছে বুদ্ধদেবের নিজের তিনটি রচনাও। আর আছে তাঁর ছবিগুলির পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্তির বিশদ বিবরণ, তাঁর সাহিত্যকর্মেরও বিবরণ। তাঁকে নিয়ে অবাংলাভাষী পাঠকের জন্যে এমন মূল্যায়ন হালফিল হয়নি।

দেশবিদেশের দিকপাল ফিল্ম-ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের ছবি নিয়ে আলোচনা অনিলকুমার দাশের লুকিং ব্যাক-এ (প্যাপিরাস, ২০০.০০)। গ্রেটা গার্বো, বাস্টার কিটন, এলিয়া কাজান, অরসন ওয়েলস থেকে শুরু করে সত্যজিতের আলোচনায় এসে শেষ হয়েছে বইটি। মুখবন্ধে গৌতম ঘোষ জানিয়েছেন এই রচনাদি ‘আ রিমাইন্ডার অব দ্য ইমপর্ট্যান্স অব ফিল্ম স্টাডিজ...।’

‘আমরা যেন স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পরেও দীর্ঘ বন্দিত্ব থেকে মুক্তি-পাওয়া পাখি হয়ে আছি— খাঁচা থেকে বেরিয়ে আমরা জানি না, এই মুক্তি নিয়ে কী করব।’— ১৯৭২-এ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলরাজ সাহনি’র দীর্ঘ ভাষণের একটি মন্তব্য মাত্র। আজীবন নাটক ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত এই মানুষটি (১৯১৩-১৯৭৩) আজও এ দেশে আধুনিক অভিনয়ের ইতিহাসে অন্যতম পুরোধা-পুরুষ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা নাসিরুদ্দিন শাহের মতো অভিনেতাদের আদর্শ তিনি। বলরাজের এ-রচনার সঙ্গে আর-একটি রচনা যুক্ত করে বেরিয়েছে রাখী এবং মনের কথা (দৃশী, ৫০.০০)। ক্ষিতীশ রায় আর সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চমৎকার অনুবাদে বলরাজের গদ্যসাহিত্য সৃষ্টির শক্তিকে চিনতে পারবেন বাঙালি পাঠক। রচনা দু’টির শেষে তাঁর জীবন ও কর্মের বিবরণ বইটিতে।

সপ্তর্ষি থেকে বেরিয়েছে চিন্ময় রায়ের যে জীবন ফড়িঙের (১৫০.০০)। প্রকাশকের তরফে জানানো হয়েছে: “ ‘কমেডিয়ান’ বলে আলাদা একটা শ্রেণিকে চিহ্নিত করা হয়, তাঁরা যেন যথার্থ অভিনেতা পদবাচ্য নন।... চিন্ময় রায় এখনও জীবিত। ক্রমশ ক্ষীয়মান যথার্থ এক বিশেষ অভিনয়ধারার শেষ প্রতিভূ বলা যেতে পারে। তাঁর জীবনকথা প্রকাশ করার আমাদের এই প্রয়াস আসলে এই সকল অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।” চিন্ময় রায়ের কর্মময় এই আত্মজীবনীর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে তাঁর ফিল্ম, থিয়েটার, রেডিয়ো-নাটকের বিস্তারিত তালিকা। প্রচ্ছদ দেবাশীষ দেবের। অজস্র স্মৃতির ভিতর দিয়ে একটু একটু করে গেঁথে দিয়েছেন নিজের জীবনটাকে পাঠকের কাছে। যেমন দিকপাল পরিচালকদের স্মৃতি: ‘‘তপন সিন্হা আমার শিক্ষক। কিন্তু সত্যজিৎ রায় পরিপূর্ণ পেশাদার। একদম চাপ দেন না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ফুরফুরে মেজাজ থাকত। স্বাধীন। পিছনে কোনও অভিভাবক নেই। কোনও গার্জেনগিরির ব্যাপার ছিল না। খোলামেলা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। ঋদ্ধ মানসিকতার মানুষ। ভুল হলেই বলতেন... ‘ভুল আমার। শটটা আর একবার নেব।’ তখনই বুঝতে পারতাম ভুলটা আমি করেছি। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ঠিক করে খুব কাছে এসে বলতেন— ‘ওই যে ডানদিকে তাকালে ওটা কোরো না।’ এই হলেন মানিকদা। সত্যজিৎ রায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE