Advertisement
E-Paper

গড়ে উঠবে বিকল্প মানবিক মার্কসবাদ

আলোচ্য গ্রন্থটির লেখক এক জন নিষ্ঠাবান গবেষক। বিস্তর রুশ-জার্মান-ইংরেজি নথি পাঠ ও বিচার করে তিনি এই বইটি লিখেছেন। বইটির বিষয় গণতন্ত্রকে ঘিরে রোজা লুক্সেমবুর্গের চিন্তা ও চেতনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আপসহীন অঙ্গীকার।

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

‘‘স্বাধীনতা সবসময়ে তাদেরই জন্য যারা ভিন্নভাবে চিন্তাভাবনা করে।
কিন্তু তারা কি চিন্তা করে এবং কতটা স্বাধীনভাবে তারা চিন্তা করতে সক্ষম।
’’ —রোজা লুক্সেমবুর্গ

আলোচ্য গ্রন্থটির লেখক এক জন নিষ্ঠাবান গবেষক। বিস্তর রুশ-জার্মান-ইংরেজি নথি পাঠ ও বিচার করে তিনি এই বইটি লিখেছেন। বইটির বিষয় গণতন্ত্রকে ঘিরে রোজা লুক্সেমবুর্গের চিন্তা ও চেতনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আপসহীন অঙ্গীকার।

রোজা প্রকৃত গণতন্ত্রকে মেলাতে চেয়েছিলেন প্রকৃত কমিউনিজমের সঙ্গে। কেউ কেউ বলবেন এই সম্ভব-অসম্ভব মিলনের আর এক নাম সোনার পাথরবাটি। তা সে যা-ই হোক, বলশেভিক বিপ্লবের পর এই মহান মিলনের প্রত্যক্ষ ও বিরাট অভাব লক্ষ করেই তিনি লেনিনের শাসনপদ্ধতির সুতীব্র সমালোচনা করেন। এই সমালোচনাকে স্মরণে রেখেই লেখক রোজার রুশ বিপ্লবের বিশ্লেষণের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি আমাদের নিয়ে গিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারের গভীরে, এবং এই প্রয়াসের অন্য আর একটি নিদর্শন হল আলফ্রেড ডবলিন-এর দারুণ মহাকাব্য, যার শিরোনাম ‘কার্ল ও রোজা— একটি ব্যর্থ বিপ্লবের কাহিনি’।

আলফ্রেড ডবলিন ও শোভনলাল দত্তগুপ্ত সরাসরি রোজার আবেগদৃপ্ত মূল্যায়ন থেকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে প্রকৃত গণতান্ত্রিকতাকে পরিহার করে বলশেভিক নেতারা একটি ‘টপ টু বটম’ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র প্রায় কিছুই ছিল না। অন্য ভাবে বললে, আদর্শ-ঘোষিত লক্ষ্য শ্রমিক-কৃষকের সরকার ও প্রশাসন হলেও খোদ শাসন ব্যবস্থায় শ্রমিক-কৃষকদের যথাযোগ্য কোনও ভূমিকাই ছিল না। এই ভ্রান্তির উপর মনঃসংযোগ করেই রোজা দাবি করেছিলেন যে, কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থায় ‘টপ টু বটম’ শুধু নয়, ‘বটম টু টপ’ প্রক্রিয়ার স্থান অপরিহার্য। এই স্থানটি সুনিশ্চিত হলেই নতুন জমানার বিপ্লবী ভূমিকা ও অবস্থান সুরক্ষিত হবে।

দ্য সোস্যালিস্ট ভিশন অ্যান্ড দ্য সাইলেন্সড ভয়েসেস অফ হিস্টরি/ নিউ পার্সপেক্টিভস/রোজা লুক্সেমবুর্গ,
শোভনলাল দত্তগুপ্ত। সেরিবান, ৪৭৫.০০

জীবনের শেষ পর্বে লেনিন নিজেই এই ভ্রান্তি শুধরাতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণিদু’টি থেকে প্রশাসকদের অন্তত ৪০ শতাংশ প্রতিনিধি বেছে নিতে হবে। কিন্তু তাঁর এই চেতনা ও অঙ্গীকার অনেক দেরিতে এসেছিল। আমরা জানি যে, লেনিনের পর এই আমলাতান্ত্রিক যন্ত্র ও প্রক্রিয়াই নির্মম-নির্দয় হয়ে ওঠে স্তালিনের শাসনকালে। লক্ষণীয়, স্তালিনের আমলেই রোজার চেতনা, অঙ্গীকার ও আত্মত্যাগকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়, এবং তাঁকে বিলুপ্ত করা হয় কমিউনিস্ট নামপঞ্জিকা থেকে। এই করুণ পরিণতি আমাদের স্তম্ভিত করে না, কারণ রোজার গণতন্ত্র ও কমিউনিস্ট শাসনের ধারণার সঙ্গে স্তালিনের ঘোর নির্যাতনী মনোভাব ও আচরণের কোনও যোগই নেই। এক কথায়, রোজার উপর প্রতিবিপ্লবীর তকমা এঁটে তাঁকে নিক্ষেপ করা হয় আঁস্তাকুড়ে।

এ প্রসঙ্গে যা বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয় তা হল, শত মতভেদ থাকা সত্ত্বেও লেনিন কমরেড রোজাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বহু বার। লেখক এই গ্রহণ-বর্জনের দ্বান্দ্বিকতাকে মূল্য দিয়ে বলেছেন যে, লেনিন রোজাকে তুলনা করেছিলেন উচ্চাকাশে ভাসমান ঈগলপাখির সঙ্গে। লেনিনের এই বিচার উদ্ধৃতির যোগ্য: ‘‘পোল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে রোজা ভুল করেছিলেন; ১৯০৩ সালে মেনশেভিকদের সম্পর্কে তাঁর বিচার ভ্রান্ত ছিল, মূলধনের চক্রবৃদ্ধির তত্ত্ব নিরূপণ করতে গিয়েও রোজা ভুল করেছিলেন...কিন্তু তাঁর এই সব ভ্রান্তি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন এবং এখনও বর্তমান ঈগলপাখির মতো। শুধু এইটুকু নয় যে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে কমিউনিস্টরা তাঁর স্মৃতি লালন করবে, তাঁর জীবনী এবং রচনা সংগ্রহের প্রকাশ উপযুক্ত নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেক কমিউনিস্টদের জন্য।’’ রোজাও তীক্ষ্ণ মতভেদ সত্ত্বেও লেনিনকে এক বিরাট ও মহান বিপ্লবীর শিরোপা দিয়েছিলেন। লিও ট্রটস্কির প্রতিও তাঁর ছিল অবিচল শ্রদ্ধা। একাধিক বার তিনি বলেছিলেন যে, এঁরা দু’জনেই ছিলেন সোভিয়েত বিপ্লবের দুই অসামান্য স্থপতি।

আসলে রোজা প্রকৃত দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার ভিতের উপরেই তাঁর গণতান্ত্রিক চেতনা ও লক্ষ্যকে দাঁড় করাতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ‘ডায়ালেকটিক্যাল কোর’ অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক অন্তঃসারের প্রতি নিবেদিত থেকেই তিনি ‘টপ টু বটম’ এবং ‘বটম টু টপ’-এর সৃজনশীল আন্তঃসম্পর্ক নিরূপণ করতে চেয়েছিলেন। নরমান গেরাস থেকে শুরু করে বন্ধু অটোকার লুবান রোজার চিন্তা-চেতনার এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের নজর দিতে বলেছেন। এক দিকে, রোজা যেমন দাবি করেছিলেন যে, বলশেভিক বিপ্লব সফল হয়েছিল দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা লেনিন ও ট্রটস্কির অনবদ্য অবদানের জন্য; অন্য দিকে তিনি জোর দিয়েছিলেন শোষিত জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের উপর, যা কিনা বিপ্লবের রূপ ও অবয়বকে উন্নীত, একাগ্র করে। এই দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার সম্মানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন: ‘‘ফ্রম দি আপারমোস্ট সামিট অফ দ্য স্টেট ডাউন টু দ্য টিনিয়েস্ট প্যারিশ, দ্য প্রোলেতারিয়ান ম্যাস মাস্ট দেয়ারফোর রিপ্লেস দি ইনহেরিটেড অরগ্যানস অফ বুর্জোয়া রুল— দি অ্যাসেমব্লিজ, পার্লামেন্টস অ্যান্ড সিটি কাউন্সিলস— উইথ ইটস ওন ক্লাস অর্গানস— উইথ ওয়ার্কার্স’ অ্যান্ড সোলজার্স’ কাউন্সিলস... ওনলি থ্রু কনস্ট্যান্ট, ভাইটাল, রেসিপ্রোকাল কনট্যাক্ট বিটুইন দ্য ম্যাসেস অফ দ্য পিপল অ্যান্ড দেয়ার অরগ্যানস, ক্যান দি অ্যাক্টিভিটি অফ দ্য পিপল ফিল দ্য স্টেট উইথ আ সোস্যালিস্ট স্পিরিট।’’ (‘হোয়াট ডাজ দ্য স্পার্টাকাস লিগ ওয়ান্ট?’)

আজ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ভাঙনের পর রোজার গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের সত্য ও ভূমিকাটি অবধারিত ভাবে আমাদের স্মরণে আসে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভেঙে পড়েছিল, কারণ সেখানে জেঁকে বসেছিল স্তালিনীয় অপশাসন। রুমানিয়ার অপদার্থ নেতা চচেসকু যে রোজার পথানুসারী ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। যারা নতুন সমাজতন্ত্র গড়তে চায়, তাদের রোজার বিধানই মেনে নিতে হবে, যা এখনও নিজস্ব নিয়মে ক্রিয়াশীল লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে। শুধু রোজা নয়, সঙ্গে বুখারিন, গ্রামচি, ভালটার বেঞ্জামিনকে কেন্দ্র করে হয়তো বিকল্প মার্কসবাদ নির্মাণ করতে হবে, যার ভিত্তি হবে জনসাধারণের কর্মকাণ্ড ও অগ্রগতি। বস্তুত, রোজার গণতান্ত্রিক চৈতন্য ও আবেগের বিশ্লেষণ পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে নিকোলাই বুখারিন ও গেয়র্গ লুকাচের দিকে, যেহেতু তাঁদের গণতান্ত্রিক কণ্ঠকেও রুদ্ধ করতে চেয়েছিল স্বৈরাচারের দাপট। মোদ্দা কথা হল, স্তালিনীয় কমিউনিজমের চির পতন ঘটেছে অনেক আগে। বিকল্প মানবিক মার্কসবাদ গড়ে উঠবে ভিন্ন ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। এবং সেই বিকল্প ঐতিহ্যের স্তম্ভ হবেন রোজা লুক্সেমবুর্গ, নিকোলাই বুখারিন, আন্তোনিও গ্রামচি, গেয়র্গ লুকাচ আর ভালটার বেঞ্জামিন।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy