Advertisement
E-Paper

গরিবরা কেন গরিবই থেকে যান

এক দিন শখ করে সপরিবার পাঁচতারা হোটেলে ডিনার করলাম বলে একেবারে বাড়ি বিক্রি করে দেনা চোকানোর অবস্থা হতে পারে? সেন্ধিল মুলাইনাথন আর এলডার শাফির বলবেন, হতেই পারে। হাতে বাজে খরচ করার মতো বাড়তি টাকা না থাকলে এক দিনের শখের, বা খামখেয়ালের, দাম এমন মারাত্মক হওয়া বিচিত্র নয়।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
স্কেয়ারসিটি: দ্য ট্রু কস্ট অব নট হ্যাভিং এনাফ, সেন্ডিল মুলাইনাথন, এলডার শাফির। পেঙ্গুইন, ৪৯৯.০০

স্কেয়ারসিটি: দ্য ট্রু কস্ট অব নট হ্যাভিং এনাফ, সেন্ডিল মুলাইনাথন, এলডার শাফির। পেঙ্গুইন, ৪৯৯.০০

এক দিন শখ করে সপরিবার পাঁচতারা হোটেলে ডিনার করলাম বলে একেবারে বাড়ি বিক্রি করে দেনা চোকানোর অবস্থা হতে পারে? সেন্ধিল মুলাইনাথন আর এলডার শাফির বলবেন, হতেই পারে। হাতে বাজে খরচ করার মতো বাড়তি টাকা না থাকলে এক দিনের শখের, বা খামখেয়ালের, দাম এমন মারাত্মক হওয়া বিচিত্র নয়।

কিন্তু, বাড়তি টাকা কাকে বলে? আপনি বিল গেটস-ই হোন বা মুকেশ অম্বানি, আপনার টাকার পরিমাণ তো নির্দিষ্ট। কোনও একটা কাজে টাকা খরচ করা মানে যে অন্য কোনও কাজে সেই টাকাটা খরচ না করতে পারা, এই কথাটা সবার জন্যই সমান সত্যি। কিন্তু, যাঁর হাতে যত টাকা, তাঁর পক্ষে সেই খরচা না করতে পারার খাতটাকে পিছিয়ে দেওয়া তত সহজ। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয়, তাদের তো বটেই, যারা কমবেশি মধ্যবিত্ত, তারাও আজ পাঁচতারার ডিনারে পয়সা খরচ করলে কাল ছেলের স্কুলের মাইনে দিতে সমস্যায় পড়ে।

আলোচ্য বইটা এমন লোকদের কথা নিয়েই। মুশকিল হল, হাতে টাকা থাক আর না-ই থাক, মাসের বাঁধা খরচগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। ফলে, স্কুলের মাইনের জন্য কাবলিওয়ালার দ্বারস্থ হতে হয়, বকেয়া বাড়ি-গাড়ির ইএমআই মেটানোর জন্য ধার চাইতে হয় ব্যাঙ্কের কাছে, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা চালান করতে হয় ক্রেডিট কার্ডে। কিন্তু, তাতেও রেহাই নেই, কারণ এ মাসের ধার মানে সামনের মাসে নিয়মিত খরচের ওপর সুদের বোঝার আঁটি। ধারের ওপর ধার জমে, সুদের বোঝা বাড়তেই থাকে। এক সময়, পুরো হিসেবটা সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে যায়।

বলতেই পারেন, এ সব কথা বলার জন্য একটা বই লেখার দরকার হল? এ তো আমরা হাড়ে হাড়েই জানি। জানি বলেই তো বইটা আরও দরকারি, কারণ এই আর্থিক ফাঁপরে পড়াটা যে গরিব বা স্বল্পবিত্তের চারিত্রিক গণ্ডগোলের জন্য নয়, এই কথাটা এর আগে কেউ বলেননি। বরং, দারিদ্রের জন্য, আর্থিক সংকটের জন্য চিরকাল দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন গরিবরাই। বলা হয়েছে, তারা অলস, অথবা অবিমৃশ্যকারী, এবং দারিদ্র তারই শাস্তি। হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ আর প্রিন্সটনের মনস্তত্ত্ববিদ জানিয়েছেন, অভাবী মানুষের ভাবনাচিন্তা আর পাঁচ জনের মতো হয় না। তাঁদের চিন্তার রাশ থাকে অন্যের হাতে— সেই অন্যের নাম হল ‘অভাব’। আসলে, চিন্তাশক্তির অনেকখানি— সেন্ধিল আর এলডার যাকে বলছেন ‘মেন্টাল ব্যান্ডউইডথ’— দখল করে রাখে অভাব। অভাব যে শুধু টাকারই হয়, তা নয়। সময়ের অভাবও অনেককেই ভোগায়। তবে, আপাতত শুধু টাকার কথাই হোক। গবেষণা দেখিয়েছে, অভাবে ভোগা মানুষ অন্যদের তুলনায় বেশি ভুল সিদ্ধান্ত করে। ফলে, আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে দেখে কাণ্ডজ্ঞানহীনতা মনে হয়, সেটা এই মানসিক চাপে থাকার ফল।

যেমন ধরুন, কাবলিওয়ালার কাছে চড়া সুদে ধার করলে যে সেটা বিপদ বাড়ায় বই কমায় না, এই কথাটা আমরা যেমন জানি, যিনি ধার করছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় তিনিও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু, টাকার অভাবে ঠেকে যাওয়ার সময় ওই সব দীর্ঘমেয়াদি বিপদের কথা তাঁর মনে পড়ে না। তিনি শুধু দেখতে পান, যে সুদের হারেই হোক, টাকাটা ধার করতে পারলে এই মুহূর্তের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে ফেলা যাবে। অভাবী মানুষের কাছে এই মুহূর্তটুকুই সব। ভবিষ্যতের চিন্তা করার বিলাসিতা তাঁর নেই। এখনকার লাভ দেখতে পাওয়া, অথচ ভবিষ্যতের বিপদের কথা মনে না পড়ার এই প্রবণতাটির নাম টানেলিং। সেন্ধিল আর এলডার জানিয়েছেন, কেউ যেমন স্বেচ্ছায় টানেল করে না, তেমনই অভাবী মানুষের পক্ষে এই টানেল এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবও নয়। মনই তাঁদের টেনে নিয়ে যাবে টানেলের দিকে, তাঁদের অজ্ঞাতসারেই।

টানেলিং-এর ফলে শুধু একেবারে ঘাড়ে এসে পড়া বিপদটাই চোখে পড়ে। ব্যাপারটা যেন অনেকগুলো বল নিয়ে জাগ্‌লিং করার মতো। অভাবী মানুষ তাঁর আর্থিক অনটন নিয়ে প্রতিনিয়ত জাগ্‌লিং করে চলেছেন। তার ফলে, কখনও আর টাকাপয়সার দিকটা গুছিয়ে ওঠা হয় না। যে খরচগুলো ধরাবাঁধা, সেগুলোও যেন আকস্মিক ভাবে নেমে আসে আকাশ থেকে।

বলতেই পারেন, এগুলো সব অজুহাত। চেষ্টা করলে এই অভাবের চক্রকে ভাঙা যায় না, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু, সত্যি বলতে, পালাবার পথ নেই। এক দিকে যেমন সত্যিই অপ্রত্যাশিত আর্থিক ধাক্কা থাকে, অন্য দিকে, সামলে ওঠার ইচ্ছেটাও অভাবের চোটেই মারা যায়। মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় ‘ইগো ডিপ্লেশন’ জিনিসটা অতি চেনা। মনের ওপর যদি এমন কোনও চাপ থাকে যেটাকে সামাল দিতে সচেতন মনের শক্তির বড় অংশটাই খরচ হয়ে যায়, তবে আমরা অনেক সহজে প্রলোভনে পা দিই। অর্থচিন্তা চমৎকারা, কাজেই সারাক্ষণ মাথায় অভাবের তাড়না থাকলে দুম করে বাজে খরচ করে ফেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ফলে, অভাবী মানুষের পক্ষে অভাব থেকে নিস্তার পাওয়ার কাজটা বেশ কঠিন।

তবে, সেই পথ আছে। দায়িত্ব অবশ্য বহুলাংশে সরকারের। লেখকরা তা আলোচনা করেছেন। তাঁদের অনেকগুলি প্রস্তাবই রীতিমত নতুন, এবং অনুমান করা চলে, অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের সমাজকল্যাণ নীতিতে তাঁদের প্রস্তাবের প্রভাব পড়বে। কিন্তু, বইটির মূল মাহাত্ম্য সেখানে নয়। বিহেভিয়রাল ইকনমিকস বা আচরণগত অর্থনীতি ক্রমে অর্থনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ধারায় পরিণত হচ্ছে। গত তিন দশকে অর্থনীতির এই শাখাটি যত পথ হেঁটেছে, বইটি তার নির্যাস। এবং, লেখকরা সেখান থেকে নতুন পথ খুলেছেন। প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা চলে, আচরণগত অর্থনীতির পথে এটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy