Advertisement
E-Paper

ছেঁড়া কাগজের চিত্রপটেও ছন্দের স্পর্শ

সোদপুর ‘জলসাঘর’-এ অনুষ্ঠিত হিরণ মিত্রের কোলাজ ছবির প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।সোদপুর ‘জলসাঘর’-এ অনুষ্ঠিত হিরণ মিত্রের কোলাজ ছবির প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

ভালবাসার অপর নামই কি স্পর্শ? হিরণ মিত্র কোলাজের ছবির প্রদর্শনী করেছেন। ছোট ছোট চিত্রপট। রং-তুলির টানা-পড়েন নেই কোনও। ইচ্ছে মতো, অনেকটা শিশুরই মতো, কাগজ ছিঁড়েছেন। জড়ো করা ছেঁড়া কাগজ থেকে তুলে নিয়েছেন একটি দুটি। আঠা লাগিয়েছেন নিজের হাতে। তারপর সেঁটে দিয়েছেন চিত্রপটে। একটির সাথে ছন্দ মিলিয়ে আর একটি। এভাবেই গড়ে উঠেছে একের পর এক ছবি। খুব বড় নয়। ছোটর মধ্যেই ফুটে উঠেছে ছন্দের দোলা। নীরব সুর। মুখবন্ধ স্বরূপ একটি লেখায় লিখেছেন শিল্পী: ‘‘নিজেই ছিঁড়ি, নিজেই জুড়ি। ছুঁয়ে থাকি তাদের শরীর। ভালোবাসি, তাই নাম দিয়েছি ‘স্পর্শ’’।

১৯-টি এরকম কোলাজের ছবি নিয়ে সম্প্রতি প্রদর্শনী হল সোদপুরের জলসাঘর আর্ট গ্যালারিতে। কেবল কলকাতায় কেন্দ্রীভূত না থেকে শিল্পী ছড়িয়ে দিতে চাইছেন তাঁর ছবি মফসসলের ও গ্রামের মানুষের মধ্যে, যেখানে অনেকেরই আছে ছবির জন্য আগ্রহ, কিন্তু সুযোগ হয় না ,সব সময় কলকাতায় গিয়ে প্রদর্শনী দেখার। সেদিন সোদপুরের ‘জলসাঘর’ নামে যে কেন্দ্রটিতে উদ্বোধন হল এই প্রদর্শনী, অনেক অনুরাগী মানুষের সঙ্গে অজস্র শিশুও উপস্থিত ছিল সেই অনুষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানে মলয় মিত্র দীর্ঘ দিন থেকে কাজ করছেন ছোটদের নিয়ে। নাটক, গান, আবৃত্তি ইত্যাদি নানা সৃজনমূলক অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করে রাখেন তাদের। ছবির চর্চাও তার একটি। ছোটদের ভাল ছবি দেখানো এই কর্মপরিকল্পনারই একটি অঙ্গ। সেদিন ছোটরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে এই ছবি।

শুধু ছবি আঁকার জন্য নয়, হিরণ মিত্র সর্বার্থেই একজন শিল্পী। তিনি লেখেন। কবিতার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেছেন তাঁর প্রস্তুতিপর্ব থেকে। নাটক তাঁর শিল্পচর্চার আর একটি দিক। মঞ্চস্থাপত্য নিয়ে কাজ করছেন বহু দিন থেকে। এছাড়া গ্রন্থচিত্রণ, অলংকরণ, অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা দিকে ছড়ানো তাঁর ভাবনা ও কাজের অন্ত নেই। এই যে ছবি নিয়ে যাচ্ছেন কলকাতার বাইরে ছোট ছোট গ্যালারিতে, এটা সেই উদ্যোগেরই একটি অংশ।

এইভাবে জীবনের ও শিল্পের নানা নির্যাস সংহত হয়ে গড়ে ওঠে তাঁর ছবি। তিনি পৌঁছতে চান চিত্রচেতনার একেবারে উৎসমূলে। অবয়বকে ভেঙে ভেঙে রূপান্তরিত করেন নিরবয়বে। অবয়বের যেমন একটা রূপ আছে, তেমনি রূপ আছে নিরবয়বেরও। অবয়ব যেখানে নেই, প্রকৃতির পরিচিত কোনও রূপ যেখানে শনাক্ত করা যায় না, সেটাই নিরবয়ব। এই বিমূর্তের ভিতর দিয়েও হিরণ জীবনের কথা বলেন।

এই কোলাজগুলিতে সেরকম বাস্তবের প্রত্যক্ষ অনুষঙ্গ হয়তো কিছু নেই। কিন্তু আছে অন্য এক নির্মাণের খেলা। ছেঁড়া কাগজের একটি রূপ-কে অন্য একটি রূপের পাশে বসিয়ে তাদের আকার ও বর্ণের মধ্যে একই সঙ্গে সাযুজ্য ও সংঘাত তৈরি করে দেওয়া, তারপর সেই টানাপড়েনকেই অন্য রূপের ভিতর অনুপ্রবেশ করিয়ে চিত্রীয় পরিসরকে পরিপূর্ণ এক ভারসাম্যে স্থিত করা, যে স্থিতি অদৃশ্য এক জঙ্গমতায়, ছন্দে ও অশ্রুত এক সুরে আন্দোলিত হতে থাকে।

কিছু ছবি বর্গাকার, কয়েকটি আছে দীর্ঘ, প্রলম্বিত, আয়তাকার। আকার অনুযায়ী ছন্দের দোলা ও সামগ্রিক অভিব্যক্তিরও পরিবর্তন ঘটে।

এইভাবে কোনও নাটকীয়তার বাইরে গিয়ে অত্যন্ত পরিমিত রেখা, যা এখানে ছেঁড়া কাগজের প্রান্তবর্তী দৈর্ঘ্য, ও পরিমিত বর্ণে শিল্পী যে রূপের বিন্যাস করেন। তা তাঁর এত দিনকার স্বকীয় রূপ-ভঙ্গিরই এক সংবৃত ও মগ্নতাময় সংস্করণ হয়ে ওঠে।

তাঁর ছোট লেখাটিতে হিরণ ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিসের কথা বলেছেন। মাতিস তাঁর জীবনের শেষ পর্বে ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৫৪-তে প্রয়াণের আগে পর্যন্ত কিছু সাঁটা-কাগজের ছবি করেছিলেন, যাকে বলা হয় পেপারকাট-আউট। আমাদের দেশে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ও দৃষ্টি হারানোর পর ১৯৬০-এর দশকে রঙিন কাটা কাগজের সাঁটা ছবি করেছিলেন অনেক। দুই শিল্পীর ছবিতেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল দুরকম আনন্দের আবহ, মূর্ততায়, কখনও বিমূর্তেও।

হিরণের ছেঁড়া কাগজের সাঁটা ছবি সেই সমীকৃত রূপের সংবৃত প্রকাশ হিসেবে স্বতন্ত্র এক অভিঘাত সৃষ্টি করে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy