Advertisement
E-Paper

ছবির চেহারা মাথায় ধরা ছিল

একটা গোটা সিনেমা হয়ে-ওঠার আগে শুধু বসবাস করত সত্যজিতের মগজে, লেখাজোকা কিছু ছিল না, এ তথ্য আমাদের কেবল বিস্মিত করে তাই নয়, মানুষটির কল্পনা আর সৃজনপ্রক্রিয়া সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে তোলে, নতুন এই বইটি বেরনোর সার্থকতা বোধহয় সেখানেই।

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
পথের পাঁচালী-র শুটিংয়ে মিচেল ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে সত্যজিৎ রায়

পথের পাঁচালী-র শুটিংয়ে মিচেল ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে সত্যজিৎ রায়

অভিজ্ঞতাটা ভয়াবহই হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। তখন প্রযোজকদের দরজায়-দরজায় ঘুরছেন, ‘পথের পাঁচালী’-র প্রস্তুতিপর্ব, চিত্রনাট্য শোনাবার একটা রেওয়াজ বহুদিন থেকেই চলে আসছে, এবং তাঁকেও বেশ কিছুদিন ধরে সে কাজটা করতে হয়েছিল। লিখেছেন, শোনানোর ‘‘শেষে সশব্দে হাই তুলে ‘তাহলে আপনার ছবিতে গান নেই’— এই উক্তি যে চিত্রনাট্যকারের প্রত্যাশায় কী পরিমাণ ঠাণ্ডা জল ঢালতে পারে সেটা যার অভিজ্ঞতা হয়নি সে বুঝবে না।’’ তাঁর এই লেখাটি ঠাঁই পেয়েছে দ্য পথের পাঁচালী স্কেচবুক-এ, হার্পার কলিন্স আর সত্যজিৎ রায় সোসাইটির যৌথ প্রকাশনা, অরূপকুমার দে-র অনুবাদে লেখাটির শিরোনাম: ‘দ্য হোল ফিল্ম ওয়াজ ইন মাই হেড’।

দ্য পথের পাঁচালী স্কেচবুক, সত্যজিৎ রায়। সম্পা: সন্দীপ রায়।

হার্পার কলিন্স ও সোসাইটি ফর দ্য প্রিজার্ভেশন অব সত্যজিৎ রায় আর্কাইভস, ৯৯৯.০০

শিরোনামটি দেওয়া হয়েছে তাঁর ওই লেখা থেকেই, ‘ছবির সম্পূর্ণ চেহারাটি আমার মাথায় ধরা ছিল’, লিখেছেন সত্যজিৎ। সে কারণেই কোনও লিখিত চিত্রনাট্য ছিল না ‘পথের পাঁচালী’র। সিগনেট থেকে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু-র জন্য ছবি আঁকতে হয়েছিল সত্যজিৎকে, সেখান থেকেই ‘পথের পাঁচালী’ ছবি করার ভাবনা আস্তে আস্তে গেঁথে যেতে থাকে তাঁর মাথার ভিতর। সিগনেট-এর স্বত্বাধিকারী দিলীপকুমার গুপ্ত ফিল্মপাগল মানুষ, ছবিটি করার জন্যে সত্যজিৎকে নিরন্তর উৎসাহ জোগাতে থাকেন। এ সমস্ত স্বীকারোক্তির শেষে অবশ্য মোক্ষম কথাটি লিখতে ভোলেননি সত্যজিৎ: ‘যদিও আমার কল্পনায় ছবির কেমন চেহারা হবে, সেটা আর তাঁকে বলিনি’।

একটা গোটা সিনেমা হয়ে-ওঠার আগে শুধু বসবাস করত সত্যজিতের মগজে, লেখাজোকা কিছু ছিল না, এ তথ্য আমাদের কেবল বিস্মিত করে তাই নয়, মানুষটির কল্পনা আর সৃজনপ্রক্রিয়া সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে তোলে, নতুন এই বইটি বেরনোর সার্থকতা বোধহয় সেখানেই।

সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘ছবির চেহারা কী হবে সেটা মোটামুটি মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটা স্কেচবুকে বেশ যত্ন সহকারে কমিক্‌সের ঢং-এ পর পর ছবি এঁকে ফেলি। যখন প্রোডিউসারদের দোরে দোরে ঘোরা শুরু হল, তখন এই খাতা হল আমার সঙ্গী।’ ওই খাতা বা স্কেচবুকটি যে প্রযোজক পাওয়ার ব্যাপারে কোনও কাজে লাগেনি, তা তো সকলেরই জানা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন সন্দীপ রায়, এ-বইয়ের সম্পাদক। মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘দ্য প্রোডিউসার্স হি অ্যাপ্রোচ্‌ড, হাওএভার, হ্যাড নো ইন্টারেস্ট, নর কুড দে আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য হোল প্রসেস’। উৎসাহ তো ছিলই না প্রযোজকদের, উপরন্তু সত্যজিতের সৃষ্টিপ্রক্রিয়াটিই তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি।

কেবল প্রযোজকরাই নন, বুঝে উঠতে পারেননি তৎকালীন পরিচালকরাও, বাংলা বা ভারতীয় সিনেমায় যাঁরা তখন একের পর এক ছবি করে চলেছেন, তাঁদের শিল্পগ্রহণের মনটা ছিল মূলত ‘সাহিত্যিকমন’, সত্যজিতের ভাষায় ‘চিত্রগত মন নয়’। তাঁরা ভাবতেন, ভাল গল্প মানেই ভাল ছবি, তাই যদি হবে, অবিভক্ত বাংলায় সেরা সাহিত্যিকদের অসামান্য সব কাহিনি তো ছিল, তবে কেন স্বাধীনতা পেরিয়ে ১৯৫৫ অবধি অপেক্ষা করতে হল ‘পথের পাঁচালী’র জন্য? আসলে ‘শক্তিমান পরিচালকের প্রধান গুণ হল বাক্যের সাহায্য না নিয়েও দৃশ্যকে বাঙ্ময় করে তোলা’— সত্যজিতের এই চিত্রগত মনটি তাঁদের ছিল না, ফলে ফিল্ম তৈরির শিল্পভাষা আর আদত ব্যাকরণও অনায়ত্ত ছিল।

তা ছাড়া ছকে-বাঁধা গল্প-বলার অভিপ্রায় থেকে যে ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি হয়নি, তা বলতেও কখনও দ্বিধা করেননি সত্যজিৎ। ‘আ নিউ অ্যাপ্রোচ’ শিরোনামে তাঁর যে লেখাটি আছে এ-বইতে, সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘ফিল্মফেয়ার’-এ, ১৭ অগস্ট ১৯৫৬-য়, ‘পথের পাঁচালী’-র মুক্তির ঠিক পরের বছর। সে লেখায় ‘পথের পাঁচালী’-তে কোনও ‘ক্লিয়ার-কাট প্লট’ নেই, এ বাক্যটি লেখার ঠিক পরের বাক্যেই লিখছেন, ‘আই ডু নট বিলিভ দ্যাট আ ফিল্ম নিডস আ ক্লিয়ার-কাট প্লট’। এটুকু লিখেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক কী কী দরকার হতে পারে একটা ফিল্মের— একটা বিষয় বা ভাবনা, এমনকী একটা পরিস্থিতি বা ঘটনা, কিংবা একটি বা কয়েকটি চরিত্র— ‘হুইচ অ্যাডমিটস অব মোস্ট এফেক্টিভ ডেভেলপমেন্ট ইন টার্মস অব ভিস্যুয়াল ইমেজেস’।

ভারতীয় ছবিতে এই ‘ভিস্যুয়াল ইমেজ’-এর খামতির কথা সখেদে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। এ-লেখাতেই ‘ভিস্যুয়াল অথেনটিসিটি ওয়াজ অব দি আটমোস্ট ইমপর্ট্যান্স’, এ কথা উচ্চারণের সঙ্গে জানাতে ভোলেননি ‘ফাইনালি, বাট মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট, দ্য ডিটেলস’। আমাদের প্রাচীন সাহিত্য বা চিত্রকলাতেও ভাব প্রকাশে কী ভাবে ছবির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, সে উদাহরণ টেনে এনে আক্ষেপ করেছেন, কেন ফিল্মকারেরা ভুলে যান ডিটেল-এর আবশ্যকতা। কোনও ছবি-করিয়ের শিল্পী হয়ে-ওঠার প্রাথমিক শর্তই ডিটেল-এর মধ্য দিয়ে তাঁর সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ করা।

‘ডিটেলের সার্থক প্রয়োগেই বিষয়বস্তু বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে’, এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পিছনে সত্যজিতের যে মনোভাব তার একটা হাতে-নগদ প্রমাণ এই স্কেচবুকটি। ‘পথের পাঁচালী’-র বিভিন্ন সিকোয়েন্সের ছবি সংবলিত এ স্কেচবুকের পাতা ওলটালেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে— কাশবন পেরিয়ে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া, অপুর জন্মের পর রান্নাঘরে উনোনের সামনে সর্বজয়ার পাশে বসা হরিহর আর তাদের স্বপ্ন বুনে চলা, ইন্দির ঠাকরুণ-সহ তাদের ঘরগেরস্তি-সংসার, এরকম আরও কত কী...

স্কেচগুলো শুরু হয়েছে আমেরিকার বিশিষ্ট পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসনের কথা দিয়ে, সেখানে মাত্র একটি শব্দেই তিনি চিহ্নিত করেছেন সত্যজিৎকে— ‘আর্টিস্ট’।

‘পথের পাঁচালী’র পরিচালকের ভিতর সেই আর্টিস্ট-এর ক্রমপরিণতির কথা এ-বইয়ে বংশী চন্দ্রগুপ্তের লেখায়: ‘অন আর্ট ডিরেকশন, মানিক অ্যান্ড পথের পাঁচালী’ (শান্তনু রায়চৌধুরীর অনুবাদ)। ছবি তৈরির আগেই, প্রস্তুতিপর্বে, ‘এক আসাধারণ ফিল্মজ্ঞ’ বলে মনে হয়েছিল সত্যজিৎকে, লিখছেন বংশী। সত্যজিতের সঙ্গে যুগলবন্দি, অন্য ছবিতে সেট সাজানোর কাজ থেকে তাঁকে করে তুলেছিল ‘পথের পাঁচালী’র শিল্প-নির্দেশক। ইন্দির ঠাকরুণের প্রাচীন ভাঙাচোরা ইমেজের সমান্তরালে হরিহরের প্রায় পোড়ো বাড়ির দরজার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বংশী, ‘পাইন কাঠের একটা নতুন দরজা বানিয়ে সেটাকে পুড়িয়ে ও ব্রাশ করে সেট-এর উপযুক্ত করে তোলা হয়েছিল। সম্পূর্ণ অবক্ষয়ের চেহারা দেওয়ার জন্য দরজার নীচের অংশ বেশি করে পুড়িয়ে খসিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর গোটা দরজাটাকে কস্টিক সোডা দিয়ে ব্লিচ করে নেওয়ার পালা। কারও চট করে বোঝবার সাধ্য থাকল না ওটা নতুন একটা দরজা, নাকি গাঁয়ের কোনও পুরনো ভাঙা বাড়ির দরজা।’

এ ভাবেই আছে আলোকচিত্রী সুব্রত মিত্রের বিশদ কথাবার্তা, ছবি করার দিনগুলি নিয়ে বিজয়া রায়ের স্মৃতিচারণ। রীতিমতো ঋদ্ধ এবং হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে স্কেচবুকটি ‘পথের পাঁচালী’র নানা অনুষঙ্গে। স্কেচ ছাড়াও আছে তখনকার সাদাকালো স্থিরচিত্র। নির্মীয়মাণ ফিল্মটির নানা দৃশ্য তো বটেই, শুটিং, শুটিংয়ের অবকাশে অভিনেতৃ-কলাকুশলীদের, সর্বোপরি সত্যজিতের। আবার সত্যজিতের তোলা অপু-দুর্গার ছবি। বুকলেট, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনা, চিঠিপত্র— সব মিলিয়ে ‘পথের পাঁচালী’র নির্মাণপর্ব ও মুক্তির অব্যবহিত এক সচিত্র ইতিহাস যেন বইটি। বাড়তি আকর্ষণ, সত্যজিতের কাছে হাতেখড়ি যে দুই অভিনেতা-অভিনেত্রীর, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রাক্‌কথন’ ও শর্মিলা ঠাকুরের ‘ভূমিকা’। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, দেশ-বিদেশের দিকপাল চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্বদের ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে ছোট-বড় মন্তব্য আর রচনা। আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছে যেমন এ-ছবি ‘দ্য বিগিনিং অব ট্রু ইন্ডিয়ান সিনেমা’, আর সত্যজিৎ ‘দ্য ফার্স্ট কনসামেট আর্টিস্ট অন দ্য সাবকনটিনেন্টস মোশন পিকচার সিন’। লিন্ডসে অ্যান্ডারসন ছবি দেখার পর ১৯৫৫-য় ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর রিভিউ-তে লিখেছিলেন ‘ইটস প্যাশনেট কনসার্ন উইথ দ্য লাইভস অব দি আন্ডারপ্রিভিলেজড’।

টেকনোলজি-দুরস্ত, বিশ্বায়নের প্রসাদপুষ্ট যে চৌখস বাঙালি নিয়ত ভুলে চলেছে ফিল্মের শিল্পভাষা, প্যারিসের সিনেমাথেক থেকে স্কেচবুকটি তার হাতে এসে পৌঁছচ্ছে... এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!

satyajit ray
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy