Advertisement
E-Paper

ঝাড়ুর মতো সার্থক হোক জীবন

এ বই পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন রূপকথা। শুধু দানবের জায়গায় দারিদ্র, আর রাজপুত্তুরের জায়গায় রাখতে হবে মেয়েদের আত্মশক্তি। ঝাড়ু নাকি অযাত্রা। এলা ভট্ট কিন্তু ঝাড়ু দিয়েই শুরু করেছেন তাঁর বই। বলছেন, গুজরাতের গ্রামে অন্তত ১৮ রকমের ঝাড়ু হয়। গোয়াল ঝাঁট দিতে খেজুর পাতার চওড়া ঝাঁটা, উনুনের ছাই বার করতে শক্ত ঘাসের ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করতে নরম, পালকের মতো ঘাসের ঝাড়ু। বর্ষার পর মেয়েরা নানা ঘাস তুলে ছাদে বিছিয়ে, শুকিয়ে, ঝাড়ু বানায়। পুরনো ঝাড়ু গরুকে খাইয়ে, আবার নতুন ঝাড়ু তৈরি করে।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০২

ঝাড়ু নাকি অযাত্রা। এলা ভট্ট কিন্তু ঝাড়ু দিয়েই শুরু করেছেন তাঁর বই। বলছেন, গুজরাতের গ্রামে অন্তত ১৮ রকমের ঝাড়ু হয়। গোয়াল ঝাঁট দিতে খেজুর পাতার চওড়া ঝাঁটা, উনুনের ছাই বার করতে শক্ত ঘাসের ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করতে নরম, পালকের মতো ঘাসের ঝাড়ু। বর্ষার পর মেয়েরা নানা ঘাস তুলে ছাদে বিছিয়ে, শুকিয়ে, ঝাড়ু বানায়। পুরনো ঝাড়ু গরুকে খাইয়ে, আবার নতুন ঝাড়ু তৈরি করে।

এই হল উন্নয়নের মডেল, বলছেন এলা। যেখানে মানুষ জানে, কোথা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে তার ব্যবহারের সামগ্রী, ব্যবহারের পর কোথায় যাচ্ছে। যেখানে মানুষ বস্তুকে কেবল ব্যবহার করছে, তার আগে-পরে কিছুই জানছে না (দোকানের কেচাপের টম্যাটো কোথায় ফলেছিল? ফেলে-দেওয়া মোবাইল ফোন কোথায় যায়?) সেখানেই পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সংযোগ কমছে, ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এলার মতে, দারিদ্র এই ভারসাম্য নষ্টের ফল, আর তা ফিরিয়ে আনাই উন্নয়ন। আধুনিক প্রযুক্তিকে তিনি বাতিল করছেন না। কিন্তু যে প্রযুক্তি পরিবেশের দাবিকে সম্মান করে না, তাকে বাতিল করতে বলছেন।

ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ, আর সমাজের সঙ্গে পরিবেশের যে সংযোগ, এলা তাকে বলছেন ‘অনুবন্ধ’। মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে তার ভোগ্যবস্তুর, আর সেই দুইয়ের সঙ্গে পরিবেশের যে নিরবচ্ছিন্ন চক্র, তার মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে সচেতন, দায়িত্ববান হওয়াই অনুবন্ধের মূল কথা।

অনুবন্ধ/ বিল্ডিং হান্ড্রেড-মাইল কমিউনিটিজ, এলা আর ভট্ট। নবজীবন পাবলিশিং হাউস, ১৫০.০০

এ তো গেল দর্শন, যার শিকড় গাঁধীবাদে। এলা ভট্টকে যাঁরা চেনেন (কে-ই বা চেনে না) তাঁরা জানেন, তিনি আদতে কাজের মহিলা। সব্জিওয়ালি, মুটে-মজুর মেয়েদের নিয়ে আস্ত একটা ব্যাঙ্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন, যখন বিশ্বে কেউ তা কল্পনাও করে উঠতে পারেনি। তাঁর ‘‘সেলফ এমপ্লয়েড উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’’, সংক্ষেপে ‘সেবা’, প্রমাণ করেছে যে দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত মেয়েদের সংগঠিত করতে পারলে তাদের জীবিকা, জীবনযাত্রা কতটা উন্নত করা যায়। কতটা মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে মেয়েরা। চার দশকে গোটা দেশে এখন ‘সেবা’-র সদস্য ১৮ লক্ষ। সেই প্রত্যয় থেকে ‘অনুবন্ধ’-এর রুট ম্যাপও বাতলেছেন এলা। তা হল, ‘হান্ড্রেড-মাইল কমিউনিটি’ তৈরি করা। যেখানে বাস, তার ১০০ মাইলের মধ্যে মানুষকে নিয়ে এমন এক ‘কমিউনিটি’ তৈরি করা যায় যাতে রুটি-কাপড়-ঘর দিব্যি হয়ে যায়।

এ যে কেবল কথার কথা নয়, তা বোঝাতে এলা সেবা-র নানা গল্প বলেছেন। তার অনেকটা বলা হয়েছে গ্রামের মেয়েদের মুখ দিয়ে। সহজ, ঝরঝরে বলার ভঙ্গি। বাখতুরা গ্রামের গৌরীবেনের বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। ছয় কিলোমিটার দূর থেকে জল আনতে যেতে হত। গরু-ছাগলের জলও বইতে হত মাথায়। নিয়মিত চান, কাপড় কাচা তো স্বপ্ন ছিল। তাদের জীবন ঘুরে গেল যখন সেবা-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাপড়ে এমব্রয়ডারি করে হাতে টাকা এল। প্রতি কুর্তায় ১৫০ টাকা। যা এক মাসেও রোজগার হত না খেত থেকে। রোজগারের আশায় একত্র হওয়া মেয়েদের নিয়ে সেবা শুরু করল জলের জন্য আন্দোলন। চাষিদের সংগঠিত করে নানা গ্রামে কয়েকশো পুকুর আরও গভীর হল, সাফ হল। নতুন নতুন চাষ হল, গ্রাম গাছে গাছে সবুজ হল, কাচা জামা পরতে পেল সকলে।

পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন রূপকথা। শুধু দানবের জায়গায় দারিদ্র, আর রাজপুত্তুরের জায়গায় রাখতে হবে মেয়েদের আত্মশক্তি। মেয়েরা কী না পারে। ছ’হাজার টাকা ধার করে কেঁচো সার তৈরি করে, তা ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারে। জৈব চাষ করে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি চিনেবাদাম ফলাতে পারে। নিজেরা ‘কৃষিবাজার’ বসিয়ে বাড়তি লাভে জিনিস বেচতে পারে। মিস্ত্রির কাজ শিখে স্বামীকে হার মানাতে পারে। সাবেকি রূপকথার কেন্দ্রে যদি থাকে মেয়েদের অসহায়তা, পুরুষ-নির্ভরতা, এই ‘‘শুদ্ধ, দেশি রোম্যান্স’’ তবে সংগঠিত মেয়েদের সক্ষমতা নিয়ে।

প্রশ্ন সেখানেই। একশো-মাইলের মধ্যে উৎপাদন-বিপণন দারিদ্র কমানো যায়, মূলস্রোতের অর্থনীতিবিদরা সে দাবিকে বরাবরই উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে নারী আন্দোলনকে জুড়ে দেওয়ার (‘ইকো-ফেমিনিজম’) যুক্তি নিয়েও তর্ক তুলবেন অনেকে। গরিব মেয়েরা মরছে হাজার জ্বালায়, তাদের ঘাড়ে দূষণ-বিরোধিতা, পুঁজি-প্রতিরোধের দায় চাপানো কেন? কিন্তু ও সব তর্ক তুললে এই বইটির প্রতি একটু অবিচারই করা হয়। এ কোনও ‘পলিমিক’ নয়। শেষ বিচারে, গরিব মেয়েরা কী পারে, কী পেরেছে, এ বই তার সহজ-সরল বিবরণ।

নালিশ যদি কিছু থাকে তবে এই গল্পের ফাঁকটুকু নিয়ে। যা এলা বলেননি, আভাসটুকু দিয়েছেন তা হল, এই ধরনের সংগঠন কত পরিশ্রম, প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা-সাধ্য কাজ। মেয়েদের ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং দিতে আইআইএম আহমেদাবাদ, চাষের ট্রেনিং দিতে আনন্দ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁতে ট্রেনিং দিতে স্টেট হ্যান্ডলুম কর্পোরেশন, দাই প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি হাসপাতাল, ডিজিট্যাল প্রযুক্তির জন্য গুগল, এমন বিচিত্র, ব্যাপক যোগাযোগ তৈরি করা মুখের কথা নয়। গল্প যত এগোয়, তত স্পষ্ট হয়, এলা ও তাঁর সহযোগীদের আন্দোলনের ক্ষেত্র কত বৃহৎ। ষাটের দশকে ন্যূনতম মজুরির দাবি নিয়ে যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শুরু, এখন সেই ‘সেবা’-র অধীনে ১০৬টি সমবায় —চাষি, মাছ-সব্জি বিক্রেতা, মিস্ত্রি-মজুরদের। আবাসন থেকে স্বাস্থ্য, সব প্রয়োজনে গরিব মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শামিল করার বহুমুখী কার্যসূচি সেবা-র। নানা কাজের ধারা একে অন্যকে পুষ্ট করেছে।

মেয়েদের বহু উদ্যোগ শুরু হয়েও শীর্ণ হয়ে যায়। তার কারণ, ধারণা হিসেবে সমবায়, স্বনির্ভরতা অতি উত্তম, কিন্তু তা সফল করতে হলে শিক্ষিত, কুশলী, দক্ষ মানুষ চাই। সব বঞ্চনা পুরিয়ে দিতে যিনি জ্ঞান, সামাজিক যোগাযোগ, ও আত্মশক্তি প্রয়োগ করবেন। যিনি প্রত্যয়ী, নিরলস, নিবেদিত প্রাণ। গরিব মেয়েদের আড়ালে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখলেও, এ বইয়ের নায়ক এলা ভট্ট।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy