Advertisement
E-Paper

তবুও তোলা নেই কোনও শান্তিকল্যাণ

লুডোর বোর্ড হচ্ছে পাঠক। যার চৌখুপিতে লেখক ঝেঁকে ঝেঁকে ছুড়ে দেন মেধার বাতানুকূল গুটি। লেখাগুলি, যেমন লুডোর গুটির এক দিক নীচে থাকে তো অন্য পাঁচ দিক দেখা যায়, তেমনই ষড়ভুজ। চেনা বুদ্ধিজীবী লিখনবর্গকে পেঁচিয়ে গুটিয়ে নিংড়ে হিঁচড়ে একটা দশকর্মা, মানে কাব্যি, সিনেমা, বারফট্টাই, আখ্যান, গুরুতত্ত্ব, জেলেপাড়ার সং, থ্যাটার, কবিগান, হাফ আখড়াইও।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
দু ছক্কা পাঁচ, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। দে’জ, ২৫০.০০

দু ছক্কা পাঁচ, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। দে’জ, ২৫০.০০

লুডোর বোর্ড হচ্ছে পাঠক। যার চৌখুপিতে লেখক ঝেঁকে ঝেঁকে ছুড়ে দেন মেধার বাতানুকূল গুটি। লেখাগুলি, যেমন লুডোর গুটির এক দিক নীচে থাকে তো অন্য পাঁচ দিক দেখা যায়, তেমনই ষড়ভুজ। চেনা বুদ্ধিজীবী লিখনবর্গকে পেঁচিয়ে গুটিয়ে নিংড়ে হিঁচড়ে একটা দশকর্মা, মানে কাব্যি, সিনেমা, বারফট্টাই, আখ্যান, গুরুতত্ত্ব, জেলেপাড়ার সং, থ্যাটার, কবিগান, হাফ আখড়াইও। একটি টাটকা ফর্ম, যার মধ্যে লুকিয়ে জানা চেনা নানা ফর্ম আর মাধ্যমের অভিজ্ঞতা। আর একটা নতুন ভাষা। বাপ রে এখনও এত শব্দ আছে এই পোড়া ভাষায়! বিশেষ্যকে বিশেষণ বা ক্রিয়াকে বিশেষ্য করে ছেড়ে দেয়। সেই সবের কারক-প্রত্যয় নির্ণয় করতে নবকলেবরে পি আচার্য লিখতে হবে। মনে রাখবেন, ভাষা মানে শুধু ব্যাকরণ, এ নয়। দুটো আলাদা শব্দ দুটো আলাদা আবেগ অর্থের অনুষঙ্গের ইতিহাস। অন্য ক্রমে, অন্য ভ্রমে ভিড়িয়ে দিলে সেই চেনাত্ব থেকে তারা মুক্তও হয়। এ বিপরিচয়করণ। আর তাদের ব্যবহার? নষ্ট শসার খোসার অন্ত্যমিল যে হবে মারিয়ো ভার্গাস ঝোসা, তার মধ্যে এক ধরনের তীব্র বুদ্ধিদীপ্ততা আছে। না, তার জন্য পাঠককে দু’চারটে ঝোসা পড়ে ফেলতে হবে এমন ক্লাসরুম এটা নয়, জাস্ট এটুকু বুঝতে হবে যে খোসাচোসাধোসা ব্যতীতও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে ভাষার জীবনে, ভাষার সেই আমূল চমকে দেওয়ার ক্ষমতাকে জীবনের একটা সিরিয়াস ব্যাপার বলে খেয়াল করতে হবে। দেখতে হবে কী ভাবে গুরুচণ্ডালির মোক্ষমে ‘হিতৈষণা’র পরের শব্দই অভাবনীয় ‘হিড়হিড়’ আর যতিচিহ্নের বিশেষত কমার কেরদানিতে ভাষার চলনই কেমন আলাদা হয়ে গেল। পুরো আলাদা না কিন্তু। খেয়াল করলেই দেখবেন, বিদ্যেসাগর থেকে রবি ঠাকুর, মাইকেল থেকে উৎপলকুমার, লাতিন আমেরিকিরা থেকে বিনয় ও অন্যান্য মজুমদার, অনেকেই ইতিউতি, ভিস্যুয়াল খেয়াল করলেই দেখবেন, ক্ল্যাসিক থেকে পপুলার, ফ্রেম বাই ফ্রেম, অভূতপূর্ব এন্ট্রি নিচ্ছেন। কিন্তু অন্য মেক আপে, ভিন্ন কস্টিউমে। ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি?

না, তা বলে বিষয়টা লেখার খেলা নয়। যে, ভাষা বলে জিনিসটাকে তুলে নিয়ে গেলাম গোদা ব্যবহারের ঊর্ধ্বে আর দেখালাম নিজের কব্জি আর কালির ভেল্কি। বরং বার বার শিল্পের কাজলটানা চোখে ছুড়ে দেওয়া হয় করকরে বালি, বারে বারে প্রতি পদে ফিরে যাওয়া হয় মানুষের ক্ষমতা হিংসা হিংস্রতা লোভ ঘেন্না ঘ্যানঘেনে পচে ওঠা যৌন আগ্রাসন কদর্য দায়িত্বহীনতার দিকে, বার বার প্রশ্ন তোলা হয় লিখে কতখানি ঘা মেরে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেওয়া যাবে যার নাম সমাজ, তাকে। চন্দ্রিলের লেখা বার বার এই বলে যে আমাদের জীবন এই, ঘিনিয়ে মরছি ঝিমিয়ে পড়ছি ধুঁকছি যখন, যখন মহার্ঘ এ জীবন কুঠুরিতে ব্রয়লারের মতো ঝিমন্ত, কোথাও তবু অনন্ত তবুও শান্তিকল্যাণ আমাদের জন্য তোলা নেই। আমরা বিছে মেরে হিরো ও সারভাইভার, আর চার পাশে যাবতীয় প্রাণ ও সম্ভ্রমনাশ আর তার উলঙ্গ দেহভঙ্গিমা থেকে মুখ একটু সরিয়ে আমাদের চলে যাওয়া বাজারের দিকে চলে যাওয়াকে চন্দ্রিল প্রশ্ন করেন। তাঁর লেখায় দায় বা দায়িত্ব কখনও অমুকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় মতো ঝোলা ব্যাগ নয়। দায় প্রতিপক্ষের নয়, প্রতি পক্ষের। লেখকের প্রশ্ন, আলিগড়ের অধ্যাপকের শোওয়ার ঘরে উঁকি মেরে তাঁর সমকাম ক্যামেরা বন্দি করেছে যারা, তারা যে অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যে এ হেন আঘাত করে, এ প্রশ্ন কেন ওঠে না! আমোদ বা যুক্তিগেঁড়ে যাই হই, ‘দু ছক্কা পাঁচ’ আমাদের মধ্যবিত্ত নিঘিন্নে জীবন, যা কারও দায়িত্ব নেয় না, কলতলা ও নিচু বাজারের বাইরে যার কল্পনা খেলে না, তাকে হিঁচড়ে টেনে দাঁড় করায় আয়নার সামনে। না, সে করতে গিয়ে এইটে ঠিক আর ওইটে না, এ-রকম কোনও গুরুগিরি চন্দ্রিলের নয়। বরং একটা বহুখাঁজওয়ালা ক্যালাইডোস্কোপ যেন, সরে সরে নানা পরিপ্রেক্ষিত নেয়, মধ্যনিম্নবিত্ত গরিবগুরবো সব্বার কলঘরের মগ তারে মেলা জামা যৌন ঈর্ষা ইতরতা সব দেখে ফেলে, কখনও একটা পরিবারের মধ্যে, কখনও যেন শ্রেণিসংগ্রাম— মধ্যবিত্ত নিম্ন ও হীন— একের সঙ্গে অন্যে দাঁত নখ নিয়ে লড়ছে। এইটে মজা, এইটে পোস্টমডার্নইজমও। সংবেদনশীলতার কাছে এই নতজানু চন্দ্রিল তো ওই আর একপা গেলেই তাকে প্যানপেনে লিরিসিজম বলে মারছেন মারাত্মক ঠোনা ও ঠাঁটি। নিপুণ যুক্তিজালে ক্রমশ লোপ পেতে থাকে অভ্যস্ত যৌনতা, বিয়ে, মাসকাবারি বাজার, কোলকুঁজো টিফিন, গুলতানি, হামবড়াই, সন্তান, পিতা-মাতা, রবীন্দ্রনাথ। চোখে পড়ে নিজে কী ঘেয়ো বিশ্রী হেরো নিজস্বতাহীন, আর তারই একাকিত্ব হতাশা কেমন আমরা ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি অন্যের, বিশেষত ঘনিষ্ঠ অন্যের। তাকে, অন্যকে ছোট ক্ষতবিক্ষত পিষ্ট দলিত না করা অবধি আমার গ্লানি কমছে না।

বইটি সামনে থেকে পেছন থেকে উল্টে কাত করে যে ভাবে খুশি পড়ুন, কখনও মনে হবে নভেলা, ‘পাতালের টুকিটাকি’ বা ‘নারী ও বাঘরোল’ যেমন, এইসা স্তরান্বিত, কখনও অ্যালিগরিক্যাল চুটকি, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, লিরিক্যাল খড়গ। আছে সমুদ্রের, কোমর-ব্যথার, বাথরুমের ইন্টারভিউ। চন্দ্রিল বললেন, আপনার মুখ আপুনি দেখ, আর আমুদে পাবলিক ভাবল হ্যাহ্যাহ্যা বেড়ে মজার লেখে তো লোকটা। তবে তাতে কিছু যায় আসে না।

দু’একটা লেখা এই সংকলনে না থাকলেও পুরো ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হত না কিছু, আর কোথাও আর একটু কম বোঝালেও চলত হয়তো। আর, এই বইয়ে ‘আমরা’ মানে সর্বদা পুং, তবে মেয়েদের ব্যাপারটা লেখক যে জানেন না সেটা বারে বারে বলেছেন, বাদ পড়লুম বলে মুখে আঁচল কান্নার বা চোখ রাঙানোর কিছু নেই নিশ্চয়ই।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy