Advertisement
E-Paper

নিজের সেই গ্রাম যেখানে শুধুই পরিচিত নিসর্গ

‘সিমা’য় চলছে পানেসর ও শাকিলা-র দ্বৈত প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ।বিশিষ্ট শিল্পী বলদেব রাজ পানেসর (১৯২৭-২০১৪) প্রয়াত হয়েছেন গত ৬ জানুয়ারি। শুধু শিল্পী নয়, তাঁকে জীবনশিল্পী বলাই হয়তো সঙ্গত। তাঁর মানসকন্যা শাকিলা এখন আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কোলাজশিল্পী। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা, কেমন করে গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের একটি শিশু ধীরে ধীরে একজন বড় শিল্পী হয়ে উঠলেন, সে সমস্তই বহু আলোচিত।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ২৩:৩৮

বিশিষ্ট শিল্পী বলদেব রাজ পানেসর (১৯২৭-২০১৪) প্রয়াত হয়েছেন গত ৬ জানুয়ারি। শুধু শিল্পী নয়, তাঁকে জীবনশিল্পী বলাই হয়তো সঙ্গত। তাঁর মানসকন্যা শাকিলা এখন আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কোলাজশিল্পী। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা, কেমন করে গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের একটি শিশু ধীরে ধীরে একজন বড় শিল্পী হয়ে উঠলেন, সে সমস্তই বহু আলোচিত। এখন প্রায় অতিকথা বা ‘মিথ’-এর পর্যায়ে চলে গেছে। পানেসরজির স্মরণে সিমা গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছে একটি প্রদর্শনী। সেখানে দেখানো হয়েছে পানেসর ও শাকিলা দু’জনেরই ছবি। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড হিজ ডিসাইপল’। পানেসরের রয়েছে ২৫টি, শাকিলার ২০টি ছবি।

পানেসরের মানবিক মহত্ত্বের কথা যথার্থ ভাবেই বহু আলোচিত। তাতে তাঁর শিল্পীসত্তা যেন একটু ছায়াবৃতই হয়ে গেছে। ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের সদস্য ছিলেন তিনি। সোসাইটির প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি আমরা নিয়মিত দেখেছি। তা সত্ত্বেও তাঁর শিল্পীসত্তার সামগ্রিক বিস্তার যেন একটু অধরাই থেকে গিয়েছিল। কেননা পূর্বাপর ভাবে তাঁর কাজ দেখার সুযোগ আগে খুব বেশি হয়নি। সেই দিক থেকে এই প্রদর্শনীটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম জীবনে অন্তত ১৯৯০-এর আগে পর্যন্ত, পানেসর ছিলেন কোলাজ মাধ্যমের শিল্পী। শাকিলার উত্থানের পর তিনি কোলাজ ছেড়ে দেন। এই প্রদর্শনীতে তাঁর দু’টি মাত্র কোলাজ দেখা গেছে ১৯৯০-তে করা। সেই কোলাজের গঠনশৈলী তাঁর স্বকীয়। সাঁটা কাগজ ও চলমান রেখার দ্বৈত দিয়ে প্রেক্ষাপটের পরিসরগত শূন্যতাসৃষ্টির নান্দনিকতায় তিনি নাগরিক জীবনের বিপন্ন সংঘাতকে তুলে ধরেন। মানবতার এই স্খলনকেই তিনি ভিন্ন রূপে প্রতীকায়িত করেছেন ১৯৯০-পরবর্তী তাঁর নিসর্গ রচনায়। সেই নিসর্গের গঠনশৈলীতে। কোলাজের অভিজ্ঞতার সারাৎসার কিছু থাকে। কিন্তু যে কারণে এই নিসর্গচিত্রগুলি অবিস্মরণীয়, তা হল, শহরের চারপাশে রয়েছে যে বিপুল প্রান্তিক পরিসর, সেই প্রান্তিক শূন্যতার সঙ্গে নাগরিক সমৃদ্ধির দ্বান্দ্বিকতাকে তিনি বার বার প্রশ্ন করেছেন। তাঁর নিসর্গ রচনায় এ ভাবেই সমাজবাস্তবতা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

পেশাগত জীবনে সংখ্যাবিদ্যা বিশারদ পানেসর তাঁর জীবনদর্শন বোঝাতে সংখ্যাবিদ্যার আলোকে তৈরি একটি অভিধা ব্যবহার করতেন। তা হল ‘হিউম্যান কোলাজ’। একজন সম্পন্ন মানুষ তাঁর পাশ্ববর্তী ব্যক্তিটির দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে। এ ভাবে তৈরি হবে এক পারস্পরিক বন্ধন বা মানব-শৃঙ্খল। এই হল সেই ভাবনার সার কথা। এই মানব বন্ধনই শাকিলাকে শিল্পী করে তুলেছে। সারল্যই তাঁর প্রধান অবলম্বন। গ্রামীণ মানবী শাকিলা ১৯৯০ সালে তাঁর জীবনের প্রথম যে কোলাজের ছবিটি করেছিলেন, তা ছিল কাগজ সেঁটে বিভিন্ন বর্ণের কিছু সব্জির সমাহার, যে সব্জি বিক্রি করতে প্রতিদিন তাঁর মা আসতেন কলকাতার তালতলা বাজারে, যেখানে পানেসরের সঙ্গে শাকিলার প্রথম দেখা হয়।

শাকিলার প্রকাশভঙ্গি ক্রমান্বয়ে পরিণত হয়েছে, যদিও এই সারল্য কখনও মুছে যায়নি। বরং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে সত্যকে উন্মীলিত করেছে। সেই সত্যের পাদপীঠ তাঁর নিজেরই ঘর-সংসার এবং গ্রাম। কিন্তু সেখানে প্রতিফলিত দেশ, এমনকী বিশ্ব। আবিশ্ব সন্ত্রাস তাঁর কাজের অন্যতম একটি বিষয়। তাঁর কাজের কেন্দ্রে থাকে তাঁর নিজের গ্রাম, গ্রামের জীবন ও নিসর্গ। সেই জীবনে প্রতিফলিত হয় পুরাণকল্প। মা কালী বারবার আসে তাঁর রচনায়। লৌকিকের সঙ্গে অলৌকিকের মেলবন্ধন ঘটে। নিসর্গ কখনও বিমূর্তের দিকেও চলে যায়। নিসর্গ, জীবন, পুরাণকল্প ও সন্ত্রাস এই চারটি মাত্রাকে আত্মস্থ করেও কোনও কোনও রচনায় তিনি অন্য এক মনস্তাত্ত্বিক ভুবনকে উন্মীলিত করেন, যাকে কোনও বিশেষ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

একটি রচনায় বড় মৃদঙ্গ ঝোলানো রয়েছে। পিছনে সাদা শাড়িতে আবৃত মুণ্ডিত মস্তক এক মানবী চলে যাচ্ছে। পিঠের উপর ঝুলছে আঁচলে বাঁধা চাবির গুচ্ছ। ও পাশে মুক্ত পরিসর। তাতে রয়েছে ফুল ও পাখি। এই মৃদঙ্গটি যে সুরের সঞ্চার করে তার অভিনবত্ব অসামান্য। দ্বিতীয় রচনাটিতে (৮ নং) আঁধারলীন এক বিস্তীর্ণ পরিসর। তার ভিতর রহস্যময় দু’টি মুখের আভাস। একটি মুখে আবার জিভটি বেরিয়ে আছে। মৃত্যুর তমিস্রার ভিতরও শিল্পী যেন পুরাণকল্পের দ্যোতনা আনেন। সারল্য নিয়েই এ ভাবে জীবনের গহনে অবগাহন করেন শাকিলা।

book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy