Advertisement
E-Paper

নিজস্ব দর্শন থেকেই উদ্ভাসিত হয়েছে প্রাকৃতিক-সত্য

চিত্রকূট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল গৌতম বসুর অষ্টম একক। লিখছেন মৃণাল ঘোষচিত্রকূট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল গৌতম বসুর অষ্টম একক। লিখছেন মৃণাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৪ ০০:২৪

চিত্রকূট গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অষ্টম এককে গৌতম বসু তাঁর প্রদর্শনীর শিরোনাম দিয়েছেন ‘লিনিয়ার পোর্ট্রেটস’ বা রৈখিক প্রতিকৃতি। তাঁর ছবিগুলি রেখার প্রাধান্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলি শুধুই রেখা-নির্ভর নয়। রেখায় ঘেরা পরিসরে তিনি বর্ণ-প্রয়োগ করেছেন। রেখার সঙ্গে বর্ণের যুগলবন্দি তাঁর চিত্রপ্রতিমাকে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। একে তথাকথিত প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেও প্রকৃতি-নিরপেক্ষ বিশেষ এক দৃশ্যগত স্বাতন্ত্র্যে অভিষিক্ত করেছে। রং ছাড়া এটা সম্ভব হত না। তিনি ব্যবহার করেছেন টেম্পারা। ভূমিজ বা উদ্ভিজ্জ গুড়ো রং প্রাকৃতিক আঠার বাঁধুনিতে বেঁধে প্রয়োগ করেছেন। ১৯৮০ থেকে তিনি নিয়মিত এই মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। দীর্ঘ অভিনিবেশ ও অধ্যবসায়ে এই মাধ্যমটিতে প্রয়োগের এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছেন। যা সমকালীন চিত্রকলায় তাঁর নিজস্ব অবদান স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

শিল্পী: গৌতম বসু

প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে তিনি যে ভূমিকা লিখেছেন তাতে প্রদর্শনীর শিরোনামের সমর্থনে তিনি রেখারূপের দর্শন সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, রেখা চিত্রের একটি মৌলিক উপাদান। কিন্তু ‘প্রকৃতিতে বা আমাদের দৃশ্যময় জগতে রেখার কোনও অস্তিত্বই নেই’। এই উক্তিটি নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। আমরা যখন প্রসারিত দৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ প্রকৃতির দিকে তাকাই, তখন পরিসর বিভাজনের রেখাকে নির্দিষ্ট করে শনাক্ত করতে পারি না। সমস্তটাকেই বিভিন্ন বর্ণের বিস্তার বা তরঙ্গ বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা যদি নিকট দৃষ্টিতে অনুপুঙ্খভাবে প্রকৃতির এক একটি উপাদানের দিকে আলাদা ভাবে তাকাই তখন রেখাই আমাদের এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুকে আলাদা করতে প্রণোদিত করে। যেমন একটি গাছের অজস্র পাতা। প্রতিটি পাতার প্রান্তবর্তী সীমা তো রেখা দিয়ে ঘেরা। তেমনি একটি বই বা টেবিল, চেয়ার প্রত্যেকের প্রান্তসীমাই তো রেখা দ্বারা নির্ধারিত। প্রকৃতির এই রেখাকেই নিজের মতো রূপান্তরিত করে শিল্পী তাঁর চিত্রের অবয়ব গঠন করেন। বা কাঠামো তৈরি করেন। সেই রেখার সঙ্গে প্রকৃতির রেখার তখন আর কোনও মিল থাকে না। প্রকৃতির রেখাকে অনুসরণ করাও শিল্পী তখন প্রয়োজন মনে করেন না। তিনি তৈরি করেন নিজস্ব রেখাবিন্যাস পদ্ধতি।

গৌতমের ছবিগুলি রেখা নির্ভর এবং অবয়বী। কিন্তু রেখা বা অবয়ব দুটোই প্রকৃতি নিরপেক্ষ। প্রকৃতির অভ্যাসটুকু মাত্র আছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সত্যকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র এক সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আছে। সেই সত্য তাঁর নিজস্ব দর্শন থেকে উদ্ভাসিত। জীবনের গভীরে থাকে অবসাদের অমোঘ ইঙ্গিত। সেই শূন্যতার সঙ্গে অস্তিত্বেও এক সংঘাত চলে। তা থেকেই সৃষ্টি হয় রূপ। রূপের অন্তর্লীন সৌন্দর্য। প্রকৃতি নিরপেক্ষ শূন্যতার সেই সৌন্দর্যকেই দৃশ্যরূপ দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন গৌতম দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর পূর্বোক্ত লেখাটিতে তিনি ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’-এর অজাতবাদতত্ত্বের কথা বলেছেন। যাতে বলা হয় ‘জগৎ জাতই হয়নি’। মায়াবাদের এই শূন্য কোথাও তাঁর ভাবনাকে উদ্দীপিত করে। কিন্তু এই শূন্যকেই চরম বা পরম বলে মনে করলে কোনও শিল্পসৃষ্টি করা যায় না। এই ‘শূন্য’কেই অতিক্রম করতেই শিল্পী পূর্ণের ধ্যান করেন। তা থেকেই জেগে ওঠে ‘রূপ’। গৌতমের ছবিতে শূন্য-নিষ্কাশিত এই পূর্ণের সন্ধানের প্রয়াস আছে।

এইখানে তাঁকে বলা যেতে পারে প্রাচ্যবাদী এবং নব্য-ভারতীয় ধারার উত্তরসাধক। নব্য-ভারতীয় ধারা অবনীন্দ্রনাথে শুরু হয়ে নন্দলালে তুঙ্গ স্পর্শ করে বিনোদবিহারীতে এসে বিশ্বায়িত হয়েছে। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত তা বহু শাখা প্রশাখায় বিন্যস্ত হয়েছে। এর কোনও ধারারই নির্দিষ্ট অনুসরণ নেই গৌতমের ছবিতে। পুরাণ-কল্প-প্রবণতা নেই। প্রাচীন ভারতীয় রীতির পুনরুজ্জীবন-প্রয়াস নেই। কেবলমাত্র জীবনের ও বস্তুর অন্তর্লীন শূন্যতা থেকে রূপের অভিজ্ঞান গড়ে তোলা।

এই প্রদর্শনীতে তাঁর দু’ ধরনের ছবি ছিল। প্রাকৃতিক বস্তুকে অবলম্বন করে দৃশ্য উপস্থাপনা। এবং মুখাবয়ব বা প্রকৃতি চিত্র। ‘শেভিং ইনটু গ্লোরি’ ছবিতে ভূমিতে ঝরে পড়া তিনটি বট পাতার উপস্থাপনা। রিক্ততার ভিতরের গৌরব বা শূন্যের গভীরের পূর্ণের সন্ধান এই ছবির মুখ্য উপজীব্য। ‘দ্য বার্ডসেলার’ ছবিতে পাখি বিক্রেতার মুখ বা হাতে ধরা দণ্ডের উপর বসে থাকা পাখিদুটোতেই বাস্তবের আভাসটুকু মাত্র রেখে শূন্য-জারিত পূর্ণকে বের করে আনার চেষ্টা রয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy