Advertisement
E-Paper

নারীর সঙ্গে মিলিয়েছেন প্রকৃতির একাত্মতা

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত রাখি রায়-এর একক প্রদর্শনী দেখলেন মৃণাল ঘোষ।সবুজের সন্ধানে, ইন কোয়েস্ট অব গ্রিন – এই শিরোনামে অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি একক প্রদর্শনী করলেন রাখি রায়। এই একই বিষয় ভাবনায় তিনি কলকাতা ও মুম্বইতে আগেও প্রদর্শনী করেছেন।

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১

সবুজের সন্ধানে, ইন কোয়েস্ট অব গ্রিন – এই শিরোনামে অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি একক প্রদর্শনী করলেন রাখি রায়। এই একই বিষয় ভাবনায় তিনি কলকাতা ও মুম্বইতে আগেও প্রদর্শনী করেছেন। এবারের প্রদর্শনীটি ‘সবুজের সন্ধানে’র চতুর্থ সংস্করণ। উন্নয়নের দাপটে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ, যা প্রকৃতিকে প্রাণোচ্ছল করে, মানুষের জীবনে আনে সৌন্দর্য ও সুষমা। একজন মানবী হিসেবে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাঁকে ব্যথিত করেছে। সেই ভাবনাকেই তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে। এই প্রতিবাদী চেতনাকে তিনি রূপ দিচ্ছেন অবয়বী ও অলঙ্কৃত চিত্রপ্রতিমায়।

রাখির বিষয়ভাবনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য – মানবীচেতনার উন্মীলন। প্রকৃতি ও নারীকে তিনি একাত্ম করে দেখতে চান। এই বিশ্ব জুড়ে বৃক্ষ-লতা-ফুল-ফল প্রকৃতিতে প্রাণের প্রবাহ আনে। প্রকৃতির সমস্ত সৃজনের মূলে রয়েছে সবুজের সমৃদ্ধ অবদান। তেমনি মানুষের জীবনেও। নারী জীবন সৃষ্টি করে। জীবনকে লালন করে। এজন্য মানব জীবনে নারীর অবদান প্রকৃতির মতো। প্রাচীন যুগ থেকে বিশ্বের প্রায় সমস্ত সাহিত্যে ও দর্শনে নারীকে প্রকৃতির সৃজনময়তার সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়। রাখিও সেই চেষ্টা করেছেন। নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করেছেন। এই দুই সত্তার সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে দৃশ্যতার এক সাঙ্গীতিক রূপ সন্ধান করেছেন।

এটা করতে গিয়ে তিনি এক বিশেষ আঙ্গিক-পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন, যার ভিতর রয়েছে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। আমাদের চিত্রকলার আধুনিকতাকে ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত করার জন্য বা ঐতিহ্যের গভীর থেকে তুলে আনার জন্য বিংশ শতকের গোড়া থেকে এক নতুন শিল্প-আন্দোলন উৎসারিত হয়েছিল। তার নাম নব্য-ভারতীয় ঘরানা। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিল্পকলায় পাশ্চাত্য আধিপত্যের প্রতিরোধে আত্মপরিচয়ের নতুন নিরিখ তৈরি করতে চেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল থেকে বিনোদবিহারী পর্যন্ত বহু প্রতিভাদীপ্ত শিল্পী। এই আঙ্গিক বহু শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছিল। পরবর্তী কালের আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিকতার মধ্যে সেই ঐতিহ্যের স্পন্দন নানাভাবে কাজ করেছে।

রাখি এই ঐতিহ্য থেকেই প্রেরণা নিয়েছেন। তাঁর সৃজন-প্রক্রিয়ার একটা সদর্থক দিক হচ্ছে – তাঁর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা নেই। এটা তাঁকে প্রচলিত শিক্ষাজাত আঙ্গিকের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি নিজের মতো করে নানা উৎস থেকে আহরণ করেছেন। ধ্রুপদী পুরাণকল্পের বিন্যাস আছে তাঁর ছবিতে। রয়েছে তন্ত্র-আশ্রিত অলঙ্করণময় জ্যামিতিক স্পন্দন। মধ্যযুগীয় অণুচিত্রের বর্ণবৈভবের ঝংকৃত উদাত্ততা রয়েছে। এসেছে লৌকিকের সারল্য। এসবের সঙ্গে মিলেমিশে সঙ্গোপনে কাজ করেছে পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা। এই সমন্বয়বাদী আঙ্গিকপদ্ধতিতে তিনি ‘রূপ’-কে কল্পরূপের দিকে নিয়ে গেছেন। কোথাও তা এতটাই বাস্তবাতীত হতে পেরেছে যে সূক্ষ্মভাবে সুররিয়ালিজমের আভাসও এসেছে।

যেমন ‘মেটামরফোসিস’ শিরোনামে ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা ছবিটি। সব প্রাণের মধ্যেই শিল্পী মানবীসত্তার আরোপ করেছেন। যে প্রজাপতিগুলি উড়ছে তাদের অনেকেই মানবীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর প্রকৃত যে মানবী বসে জলের ভিতর পদ্মটি স্পর্শ করতে চাইছে তার সমগ্র শরীর, স্মৃতি সত্তা জুড়ে প্রকৃতির নানা স্মরণচিহ্ন। ‘প্রাণ’ শিরোনামে ছবি আছে, সেখানে প্রদীপ্ত সূর্যে নারীর মুখের আভাস। তাকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান সমস্ত প্রাণিকুল। মানবী ছাড়াও অজস্র পশু-পাখি-সরীসৃপ। সূর্য প্রাণের উৎস। সেই প্রাণের বন্দনায় উৎসবের আবহ সমগ্র বিশ্বপ্রবাহ জুড়ে। ‘স্ত্রী শক্তি’ ছবিতে বহু-হাত-বিশিষ্ট মানবী বসে আছে সন্তান কোলে নিয়ে। এই মানবী একান্তই আধুনিকা। অজস্র হাতের উপস্থাপনায় তাকে পুরাণকল্পে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। এই মাতৃত্ব ঘিরে সমস্ত প্রকৃতি মুখরিত হয়ে উঠছে। ‘দ্য ফ্লাইট’ ছবিটিতে অজস্র পাখি উড়ছে। উড়ছে মানবী ও শিশুরাও। ‘সেলিব্রেশন’ পূর্ণকুম্ভের ভিতর থেকে জেগে উঠছে নৃত্যরতা মানবী। এসমস্ত বর্ণিল ছবির পাশাপাশি কিছু কালিতে করা একরঙের ড্রয়িংধর্মী ছবিও আছে এই প্রদর্শনীতে। এর অধিকাংশই সমৃদ্ধ ডিজাইনের সুচারু দৃষ্টান্ত।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy