Advertisement
E-Paper

প্রতিবাদী রূপও মিলে যায় ধ্রুপদী চেতনায়

সম্প্রতি গ্যালারি ৮৮-এ অনুষ্ঠিত ইন্দ্রপ্রমিত রায়-এর প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০১

ইন্দ্রপ্রমিত রায় তাঁর ছবিতে চেতনার অন্তর্বর্তী আলোছায়ার রহস্যময় পরিমণ্ডলকে উদ্ভাসিত করতে ভালবাসেন। অত্যন্ত ঐতিহ্য সচেতন ও দেশ-কাল সচেতন সামাজিক ও নান্দনিক দায়বোধ সম্পন্ন শিল্পী তিনি। কিন্তু প্রতিবাদী চেতনাকে যেভাবে ধ্রুপদী-চেতনায় সম্পৃক্ত করে স্থৈর্য ও মগ্নতার বাতাবরণ তৈরি করেন, তাতেই তাঁর ছবি বিশেষ এক নান্দনিক তাৎপর্য পায়। আমাদের চিত্রকলা-ঐতিহ্যের আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদী প্রবহমানতাকে আত্মস্থ করে তাকে উত্তর-আধুনিক মননে অভিষিক্ত করতে চান তিনি। তাঁর প্রকাশভঙ্গি ক্রমশই সহজ ও লাবণ্যদীপ্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই আপাত-সারল্যের মধ্যেই সাম্প্রতিক জীবনপ্রবাহের নানা জটিল স্পন্দন খুব সূক্ষ্মভাবে সঞ্চারিত হতে যায়।

গ্যালারি ৮৮-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর ষোড়শ একক প্রদর্শনী। শিরেনাম ‘MEZZATERRA’, যার অর্থ মধ্যবর্তী সাধারণ পরিসর। ভূমিকা-স্বরূপ তাঁর একটি ছোট লেখায় শিল্পী জানিয়েছেন – এটি একটি কাল্পনিক পরিসর, একটি ভাবনা যা খুবই বাস্তব কিন্তু নমনীয়, যাকে কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

অনেক প্রতিধ্বনি ও প্রতিফলনের স্পন্দনের মধ্য দিয়ে তা একটি রূপের দিকে অগ্রসর হয়, আবার তা দ্রবীভূত হয়ে নতুন বোধের উৎসারণ ঘটায়। এই অন্তহীন হয়ে ওঠার বাস্তবতার সঙ্গে সংঘাত বাঁধে আজকের ভোগবাদী সমাজের উচ্চাকাঙ্খাদীর্ণ জীবন বোধের। এই সংঘাতের ভিতর থেকে মগ্নতার এক স্পন্দিত সৌন্দর্যকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন ইন্দ্রপ্রমিত।

তাঁর শিল্পশিক্ষা বিশ্বভারতী কলাভবন (১৯৮২-৮৭) এবং বরোদায় (১৯৮৭-৯০)। পরে তিনি লণ্ডনের রয়াল কলেজ থেকেও স্নাতকোত্তর করেছেন (১৯৯০-৯২)। ১৯৯৫ থেকে বরোদাতেই তিনি অধ্যাপনা করছেন। বরোদা তাঁকে আবিশ্ব ঐতিহ্য এবং উত্তর-আধুনিকতা আত্মস্থ করতে সাহায্য করেছে। শান্তিনিকেতন থেকে তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর সৃজন উৎসারিত তন্ময় এক প্রাচ্য ধ্রুপদিচেতনা। এই দুটি আলোকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছেন তাঁর মননে এবং তাকে সমন্বিত করেই গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেই মধ্যভূমি, যেখানে সংঘাত ও প্রশান্তি, আলোড়ন ও মগ্নতার দ্বৈতের সমন্বয়-প্রক্রিয়া চলে। এই সমন্বয়-প্রক্রিয়া থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর এবারের জলরঙের ছবিগুলি।

তাঁর ছবির বিষয় মূলত নিসর্গ। তিনি রৈখিক জ্যামিতির গাঠনিক বিন্যাস আর বর্ণ বিস্তারের আলোছায়ার দ্বৈতের মধ্যে এক কাল্পনিক পরিসর বিস্তার করেন। একদিকে বাস্তব দৃশ্যের যথাযথ স্বাভাবিকতা, আর এক দিকে আত্মগত কল্পনার জগতের বিমূর্ত অনুভব – এই দুইয়ের মধ্যবর্তী এক অনুভবে স্পন্দিত হয় তাঁর চিত্রপট। ‘হারবার’ ছবিতে তিনি এক বন্দরের দৃশ্য আঁকতে চান। সমুদ্রজলে আলোকরশ্মির স্পন্দন, দূরবর্তী পরিসরে জাহাজের আভাস – এ সমস্তকে আত্মস্থ করে, তারপর ছাপিয়ে গিয়ে মূর্ত-বিমূর্তের সংশ্লেষে ছবিটি হয়ে ওঠে এক আত্মগত নিসর্গ। ‘ফেস্টিভাল’ শীর্ষক ছবিতে নিবিড় নীল প্রেক্ষাপটে অন্তহীন আলোকবিন্দু বিচ্ছুরিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে এক অনৈসর্গিক আনন্দের পরিমণ্ডল। ‘ইউটোপিয়া-১’ ছবিটি অনেক উঁচু থেকে দেখা কোনও নগরীর অট্টালিকা শ্রেিণর সংহত দৃশ্যরূপ। আলোকিত মধ্যবর্তী পরিসর ও চারপাশের নীলিম ছায়াছন্নতার প্রশান্ত নৈঃশব্দ্যের পারস্পরিক সুর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শিল্পী ওই নিসর্গকে অতিক্রম করে আত্মঅনুভবের এক ধ্রুপদী সৌন্দর্যকে উন্মীলিত করতে চান।

ইন্দ্রপ্রমিত প্রায় সব ছবিতেই এক মগ্ন সৌন্দর্যকে রূপবদ্ধ করতে চান। বাস্তব ও তার ছায়ার এক দ্বন্দ্বাত্মক রহস্যের সন্ধান করে চলেন শিল্পী। প্রদর্শনী কক্ষে ছবির পাশে পাশে তিনি বিদেশি ও দেশি সাহিত্যের কিছু কিছু উদ্ধৃতি রেখেছেন, যা মূলত বাস্তবের অন্তরালবর্তী এই রহস্যের কথা বলে।

১৯৬০-এর দশকের শিল্পীদের মধ্যে ভূপেন খক্কর, শ্যামল দত্তরায়, বিকাশ ভট্টাচার্য, শক্তি বর্মন প্রমুখ শিল্পীর চর্চা জলরংকে একই সঙ্গে প্রতিবাদী ও ধ্রুপদী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর সম্ভাবনাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া যায় ইন্দ্রপ্রমিত সেই সাধনায় মগ্ন আছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy