Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

রেলপথ আসলে কোনও নতুন পথ নয়

আধুনিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা নতুন হলেও বিশিষ্ট শাখা হিসেবে এখন স্বীকৃত। আলোচ্য গ্রন্থটি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃত হবে। উন্নত দেশ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অন্যত্র প্রসারিত করার ব্যাপারে মার্কসবাদীদের দৃঢ় তাত্ত্বিক মতবাদ ও তার বিপরীতে জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্য সুপরিচিত। লেখক এই দুই ধরনের মতের মধ্যে কুশলতার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ গদ্যে তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে প্রযুক্তির সামাজিক ইতিহাস নির্মাণে নিজ বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

মৃণালকুমার বসু
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

আধুনিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা নতুন হলেও বিশিষ্ট শাখা হিসেবে এখন স্বীকৃত। আলোচ্য গ্রন্থটি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃত হবে। উন্নত দেশ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অন্যত্র প্রসারিত করার ব্যাপারে মার্কসবাদীদের দৃঢ় তাত্ত্বিক মতবাদ ও তার বিপরীতে জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্য সুপরিচিত। লেখক এই দুই ধরনের মতের মধ্যে কুশলতার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ গদ্যে তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে প্রযুক্তির সামাজিক ইতিহাস নির্মাণে নিজ বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তবে প্রযুক্তির ব্যাখ্যা প্রথমে দিলে ভাল হত। ঐতিহ্যাশ্রয়ী শিল্পসমূহ যার চমকপ্রদ বর্ণনা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের আর্ট ম্যানুফ্যাকচার্স অফ ইন্ডিয়া বইতে আছে সে সব আলোচনার বাইরে রাখাই তাঁর উদ্দেশ্য। অথচ এখানে তাঁত, কাঁসা, শাঁখের কথাও আছে, আবার চাল, চিনি ও সরষের তেলের কথাও আছে। প্রথমেই বাষ্পীয় শক্তির প্রতিভূ হিসেবে রেল এসেছে। শেষে কয়েকটি নতুন শিল্প যেমন দেশলাই ও হোসিয়ারি শিল্পের কথা আছে।

ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ১৮৩০-১৯৮০,

স্মৃতিকুমার সরকার।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৮৫৯.০০

রেলপথের জন্য জমি অধিগ্রহণ, শ্রমিক নিয়োগ ও আধুনিক সেতু নির্মাণের ফলে গ্রামীণ নিঃসঙ্গতার অবসান হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেছেন। ছোট রেল, বাস ও লরি চালু হবার আগে এটি হয়েছিল বলা যায় না। রেল কর্তৃপক্ষের বিশাল কর্মযজ্ঞ বিপুল আলোড়ন এনেছিল সন্দেহ নেই। তবে মুগ্ধ বিস্ময়ের পাশে এর ভয়াবহতা ভুলে যাওয়া শক্ত। প্রথমে দামোদর নদের এক পাশের পাড় ভেঙে দিয়ে বাৎসরিক বন্যায় কৃষিজীবন বিধ্বস্ত করা হয়। অন্য দিকের পাড় কার্যত নিরেট প্রাচীরের মতো গড়ে নিকাশি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ফলেই ‘বর্ধমান জ্বর’ নামক ম্যালেরিয়া মহামারির কবলে বর্ধমান, হুগলি ও হাওড়া পড়ে। কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। আসলে, রেলপথ মূলত কোনও নতুন পথ নয়, তা আগেকার বাণিজ্য ও তীর্থপথকেই দখল করে নিজের স্বার্থে। রেনেলের ১৭৭৮ সালের সড়ক বিষয়ক গ্রন্থের বিবরণ ও পুরীর পথের জন্য গণেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ভ্রমণকাহিনী’তে উৎকলের গরুর গাড়ির রাস্তার বর্ণনা থেকে এর সত্যতা বোঝা যায়। অন্য দিকে, রেল শ্রমিকেরা নিশ্চিত আয়ের উৎস পেয়েছিল যাদের বেশির ভাগই অবাঙালি। এদের মানবিক সমস্যার কথা জটাধারীর রোজনামচা, শ্রীকান্তের সতীশের আখ্যান ও হিন্দি উপন্যাস ময়লা আঁচল বইয়ে রেলকর্মীর বর্ণনায় পাওয়া যায়।

অন্য দিকে, মার্কস রেলকে স্বাগত জানালেও বর্ধমানের রাজা সবল বিরোধিতা না করায় তাঁর ‘রাজভক্তি’কে কটাক্ষ করা হয়েছে। তিনি কাঞ্চননগর ছেড়ে শহরের নতুন এলাকায় (যা আসলে সপ্তদশ শতকের শহর) রাজপ্রাসাদ তৈরিতে ব্যস্ত। এর বছর ত্রিশ আগে ভিক্তর জাকমঁ বর্ধমানে এসে রাজা তেজচন্দের বিপুল অর্থ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। শুধু রাজপ্রাসাদ নয়, রাজা নগরায়ণের ব্যবস্থাও করেন। দুটি সেতু তৈরি করান, যা শাসকের তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর সেতুর চেয়ে বড়। কালনা পর্যন্ত পথ ও আধুনিক কালনা শহরকে গড়ে দেন। দুটি নীলকুঠিকে কার্যত শহর ছাড়া করেন। এমনকী ভগবানগোলার মতো ঈশ্বরীতলা তৈরি করেন। পরিকাঠামো গড়ার কাজটা তিনি করেছিলেন।

অথচ বিশ শতকে যখন চালকল গড়ে উঠল মূলত পশ্চিমবঙ্গে, তখন প্রায় ম্যালেরিয়া বর্জিত পূর্ববঙ্গে তার প্রভাব পড়েনি দেখা গেল। পরিবহণ ব্যবস্থা সেখানে থেকে গেল নৌকানির্ভর। অথচ এর ফলে লক্ষ বিধবা ও সধবা নারী ঢেঁকি থেকে হটে গেল। বিলেতের নারী শ্রমিকের মতো এদের নতুন পেশা জোটেনি। অথচ চালকলের সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। গোটা উনিশ শতক জুড়ে হিন্দু নারীদেরই জেলে বেশি দেখা গেল, অন্য দিকে নতুন লোহাশিল্পে, বিশেষত হাওড়ায় স্থানীয় কামার নয়, অবাঙালি শ্রমিকরা আধিপত্য গড়ে তুলল। তাঁত, কাঁসা ও শাঁখা-শিল্প ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যায়। তীর্থঙ্কর রায় পুরনো কাঁসা-শিল্পে মোরাদাবাদের ক্ষেত্রে যেমন প্রসার দেখেছেন, সে রকম ব্যাপার এখানে ঘটেনি। সরকারি মদতেও তাঁতিরা আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করেনি।

বিপরীত প্রান্তে আলোচিত হয়েছে নতুন কয়েকটি শিল্প, যেগুলো সহজ প্রযুক্তিনির্ভর হলেও আগে ব্যবহৃত হয়নি। এর মধ্যে জলনিরোধক পোশাক (ওয়াটারপ্রুফ), দেশলাই ও হোসিয়ারি শিল্প মধ্যবিত্তদের উৎসাহে পুষ্ট ও পরিচালিত। ঐতিহ্যাশ্রয়ী সামাজিক গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত ছিল এগুলো। সুরেন্দ্রমোহন বসু জাপান থেকে নতুন প্রযুক্তি শিখে এসে জলনিরোধক পোশাকের ব্যবসা ‘ডাকব্যাক’ নামে চালু করেন। আজও এটি আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করে গুণমান বজায় রেখে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে।

এর সঙ্গে দেশলাই ও হোসিয়ারি শিল্পের বিস্তারিত ও মনোজ্ঞ বর্ণনা বইটিতে আছে। স্বদেশি ভাবনাকে মূর্ত করার জন্য উদার রাজনীতিবিদদের বিশেষত রাসবিহারী ঘোষের অকৃপণ সহায়তা দেশলাই শিল্প পায়। ফলে বন্দে মাতরম্ দেশলাই কারখানা গড়ে ওঠে, তা বন্ধ হতেও দেরি হয়নি। নানা স্বদেশি কারখানা গড়ে ওঠে, কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক এই ব্যবসায় বিদেশি যন্ত্র, কাঁচামাল এমনকী কর্মীর ওপর নির্ভর করে ব্যবসা দাঁড় করানো শক্ত ছিল। উদ্ভাবনী শক্তিতে বাঙালি খুব পিছিয়ে ছিল না। মহেন্দ্রচন্দ্র নন্দী কাঠি তৈরির সহজ যন্ত্র তৈরি করেন, কিন্তু ব্যবসা চলেনি। কারণ কাঁচামাল ও যন্ত্র সুলভ নয়। অথচ সুইডেন ও জাপান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেড় মিলিয়ন দেশলাই বাক্স রফতানি করত শস্তায়, আর দেশি নাম ব্যবহার করত বলে স্বদেশি যুগে তাদের ব্যবসা ভালই চলত। দক্ষিণ ভারতের শিবকাশী নির্ভর শিল্প নাদার মহাজন সঙ্গমের নেতৃত্বে দলিত নারী ও শিশু শ্রমিকের সাহায্যে বড় ব্যবসা গড়ে তোলে, যা বাঙালিরা কখনও পারেনি।

তুলনামূলক ভাবে হোসিয়ারি শিল্পে বাঙালিদের সাফল্য অনেক বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। এটি গড়ে তোলেন অন্নদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় খিদিরপুরে মোজা তৈরির কারখানা দিয়ে, ১৮৮৯-এ। ব্যবসা চলেনি, এমনকী বড় জমিদারদের সহায়তায়ও। যন্ত্র ও বিদেশি সুতো দিয়ে প্রতিযোগীদের ঠেকিয়ে শস্তায় মাল বিক্রি বা ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। তবু নানা জায়গায়, বিশেষত কালীঘাটে এক শিক্ষিত ব্যবসায়ী ছিদ্রযুক্ত গেঞ্জি তৈরি করে সাফল্য অর্জন করেন। কিন্তু বিদেশিরা, বিশেষত জাপানি বা চিনেরা অনেক শস্তার মাল এখানে পাঠায়। দেশি মালের দাম বেশি।

ব্যবসাটি কুটির শিল্পে রূপান্তরিত হয় পূর্ববঙ্গে পাবনা শিল্প সঞ্জীবনী ও অন্যান্য কোম্পানির মাধ্যমে, যারা স্থানীয় মানুষের কাছে গেঞ্জিকে জনপ্রিয় করে। ময়মনসিংহ জেলায় মহিলারা গেঞ্জির কারখানা চালু করেন। বিদেশি মাল স্বদেশি ছাপ দিয়ে আসত, আর রাজনৈতিক কারণে বিক্রিও হত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সুবোধ ঘোষের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষ কলকাতা ও পূর্ববঙ্গে গোপাল গেঞ্জির কারখানা গড়ে তুলে মাড়োয়ারিদের সহায়তায় উত্তর ভারতে ব্যবসা প্রসারিত করেন। মাড়োয়ারিরাও গেঞ্জির কারখানা খুলে ব্যবসায় ভাগ বসান। দক্ষিণ ভারতে তিরুপ্পুর-কেন্দ্রিক হোসিয়ারি শিল্প সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে ব্যবসা বাড়িয়েছিল। বাঙালিরা বিদেশি বা দক্ষিণ ভারতের সুতোর ওপর নির্ভর করত।

স্বাধীনতার পর বিধানচন্দ্র রায় কল্যাণীতে সুতোর কারখানা গড়লেও তখন জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন এখানে হোসিয়ারি শিল্পের ক্ষতি করে। মোট ব্যবসা ক্রমশ কমে গেলেও বাঙালিরা আজও এই শিল্পে জোরালো ভাবে টিকে আছে। তবে বাঙালি ‘গোপাল’ ও মাড়োয়ারি ‘লাক্স’-এর তুলনামূলক আলোচনা থাকলে ভাল হত। সামগ্রিক ভাবে, সহজ প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে বাঙালিদের সাফল্য চোখে পড়লেও দেশের আর্থিক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকা স্পষ্ট হল না। তবে দেশীয় জীবনে প্রযুক্তি প্রয়োগ বিষয়ে বইটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য গবেষণা।

বইটিতে সুরুলের Chap (Cheap) সাহেব, Don (Dawn) সোসাইটি, বা চন্দ্রনাথ বসুর নামের আগে ‘ফেলো’ চোখে লাগে। ভূপেন্দ্রনাথ বসু কলকাতা কর্পোরেশনের ‘প্রেসিডেন্ট’, রমেশচন্দ্র দত্ত ‘১৮৬৬’-তে আই সি এস থেকে পদত্যাগ করেন, বা ‘মহিলারাই কেবল পালকি চড়তেন’ কয়েকটি তথ্যভ্রান্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE