Advertisement
E-Paper

স্বচ্ছ ভারতের পাশেই অস্বচ্ছ ভারত

দেশ জুড়ে ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে। মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে এটি শুরু করা হয়, যাতে যোগ দিতে রাজনীতিবিদ থেকে চিত্রতারকা সকলেই সম্মার্জনী হাতে রাজধানীর রাস্তায় নেমে পড়েছেন।

গৌতম রায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

দেশ জুড়ে ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে। মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে এটি শুরু করা হয়, যাতে যোগ দিতে রাজনীতিবিদ থেকে চিত্রতারকা সকলেই সম্মার্জনী হাতে রাজধানীর রাস্তায় নেমে পড়েছেন। এই বহিরঙ্গ প্রসাধনের আড়ালে পড়ে থাকছে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অথচ গণমাধ্যম বা সরকারি নথিতে কার্যত অদৃশ্য সেই সব সাফাই কর্মীদের যন্ত্রণা, বঞ্চনা, শোষণ ও প্রতারণার কথা, যারা দলিত সমাজের মধ্যেও অতি-দলিত, দীনাতিদীন— মেথর, ডোম, ভাঙ্গি, বাল্মীকি, থোট্টি, ধানুক, মাদিগা, ভাতাল বা হেলা প্রভৃতি জাত-পরিচয়ে যারা নিত্য উচ্চ ও মধ্য বর্ণের দুর্গন্ধযুক্ত মল খাটা পায়খানা থেকে দু’ হাতে বের করে টবে ভ’রে মাথায় তুলে স্থানান্তরে নিয়ে যায়। এই অস্বচ্ছ ভারত মোদীর স্বচ্ছ ভারতের পাশেই রয়েছে। শহর-মফস্সলের আনাচে-কানাচে সম্পূর্ণ অবমানবের অস্তিত্ব নিয়ে দিন গুজরান করে চলেছে। এদের নিয়েই সাংবাদিক ভাষা সিংহের বই আনসিন অর্থাত্‌ অদৃশ্য, রাজ্যে-রাজ্যে সাফাই কর্মীদের অন্ত্যজ মহল্লায় দীর্ঘ কাল ঘুরে, গবেষণা করে যিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য প্রতিবেদন আকারে নানা সময়ে তুলে ধরেছেন।

কাশ্মীর থেকে শুরু হয়েছে তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষা। তার পর দিল্লি, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটকের মেথর-বস্তি পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখেছেন, ১৯৯৩ সালে খালি হাতে মল সংগ্রহ করে তা মাথায় করে অন্যত্র ফেলে আসার প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণীত হলেও রাজ্যে-রাজ্যে, কি বিভিন্ন পুরসভায় এই বর্বর প্রথাটি সমানে চলতে দেওয়া হচ্ছে। সর্বত্রই এ কাজে নিযুক্ত অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলারা, যাঁরা পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। এবং তাঁরা কেউ স্বেচ্ছায় বা সানন্দে এই ঘৃণ্য পেশায় পড়ে নেই। নিতান্ত শৈশবে— অন্য শিশুরা যখন খেলাধুলো করে, স্কুলে যায়— এই দলিতকন্যারা মায়ের সঙ্গে উচ্চবর্ণীয়দের মল পরিষ্কার ও বহন করার কাজে যেতে থাকে। মা অসুস্থ হয়ে পড়লে ঝাঁটা বা বেলচা তুলে নিতে হয় তাদেরই, মাথায় তুলে নিতে হয় পূরীষ-বোঝাই ঝুড়ি কিংবা টব। তার পর বাকি জীবনভ’র এই গ্লানি বয়ে যাওয়া। অন্যের মল পরিষ্কার করতে কারও আনন্দ হবে, এটা তারাই ভাবতে পারে, যাদের নিজের হাতে কখনও এই ঘৃণ্য কাজ করতে হয়নি। অথচ এ দেশের জাতিভেদপ্রথার সমর্থনকারীরা এই কাজের সদর্থক দিকও খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৩৬ সালে এক নিবন্ধে গাঁধী লেখেন— ‘একজন ভাঙ্গি বা মেথর সমাজের জন্য সেই কাজই করে, যা একজন মা তাঁর সন্তানের জন্য করে থাকেন। মা তাঁর সন্তানকে সুস্থ রাখতে তার ‘গু-মুত’ পরিষ্কার করেন। একই ভাবে একজন মেথরানিও সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সকলের পায়খানা সাফ করে...।’ অন্ধ্রপ্রদেশের থোট্টি রমণী নারায়ণাম্মা তাই গাঁধীকে কখনও হরিজনের শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারেননি। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন, শিশু সন্তানের ‘গু-মুত’ পরিষ্কার করতে যে মাতৃত্ব উদ্গত হয়, সমগ্র জাতির বিষ্ঠা হাতে-পায়ে মেখে মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তা তুলনীয় হতে পারে না। গাঁধী যে জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা জিইয়ে রাখতেই এই উদ্ভট তুলনা টেনেছেন, তা বুঝতে নিরক্ষর মেথরানিদেরও অসুবিধা হয় না।

গাঁধীর গুজরাত যখন নরেন্দ্র মোদীর ‘সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল’ গুজরাতে রূপান্তরিত, তখনও কি বর্ণহিন্দু ও তার নিয়ন্ত্রিত সমাজে দলিত, মলবাহক সাফাই-কর্মীদের এই পেশাকে যুক্তিসিদ্ধ করার চেষ্টায় কোনও খাম্তি লক্ষ করা গেছে? ২০০৭-এ কর্মযোগ বইয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী লিখছেন— ‘আমি মনে করি না, বাল্মীকিরা অন্যের মল সাফ করার এই কাজ কেবল রুজি-রুটির জন্য করে। তা যদি হতো, তা হলে বংশপরম্পরায় এ-কাজ তারা করত না। কোনও এক কালে নিশ্চয় তাদের কারও চেতনায় দৈব প্রত্যাদেশে এই আধ্যাত্মিক উন্মোচন ঘটেছিল যে, এ-কাজ তারা করছে ভগবানকে খুশি করতে। সেই অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিকতার প্রেরণাতেই শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রজন্মপরম্পরায় এ-কাজ করে যাচ্ছে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, তাদের পূর্বপুরুষরা ইচ্ছে করলে বিকল্প কোনও রুজিরোজগারের সন্ধান পেত না।’ জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে চিরস্থায়ী করার আদর্শ অপযুক্তি! অস্পৃশ্যতা, কারণ মল বহনকারী দলিতদের কেউ জল-চল করতে পারে না, পঙ্ক্তিভোজে ডাকতে পারে না, ছুঁয়ে দেখার তো প্রশ্নই নেই। মোদী তখনও ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তাঁর সরকার তখনই রাজ্যে কোনও মলবাহক খুঁজে পায়নি। সুপ্রিম কোর্টের তলব পেয়ে তারা জানাচ্ছে, গুজরাতে হাতে করে মল তুলে মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথা নাকি রদ হয়ে গেছে। এটা যে মিথ্যাচার, তার প্রমাণ হল মলবাহকদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে মোদীর গুজরাত সমানে টাকা নিয়ে গেছে।

মেথর-ভাঙ্গি-বাল্মীকিদের পূরীষ সাফ করাকে কখনও মাতৃস্নেহ, কখনও আধ্যাত্মিক কর্তব্যবোধ হিসাবে ব্যাখ্যা করার গাঁধী বা মোদীর প্রয়াসের অন্যতম ফল, এই সাফাই-প্রক্রিয়াটির যান্ত্রিকীকরণের কোনও আধুনিক, সভ্য প্রচেষ্টা আজও হল না। অথচ যত দিন যান্ত্রিক ভাবে এই আবশ্যক সাফাই-কর্মটি সম্পাদনের ব্যবস্থা না হয়, তত দিন সাফাই-কর্মীদের দস্তানা, গামবুট, দুর্গন্ধ-প্রতিরোধী মুখোশ ইত্যাদি সরবরাহ করাও হয়নি। পুরসভা-নিযুক্ত মেথরদের বেতন যত্‌সামান্য, অধিকাংশই অস্থায়ী কর্মী, মহিলাদের ক্ষেত্রে বেতন-বৈষম্য লজ্জাকর, মেথর বস্তিগুলির সংস্কার বা তাদের আবাসনের প্রয়োজন সম্পর্কে সরকার উদাসীন, যে হেতু সভ্য সমাজের বাইরে অদৃশ্য হয়ে থাকাই তাদের নিয়তি। সরকারি নথিতে অনুপস্থিত দেখানো হলেও জনসাধারণ এই মহাদলিতদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল, যেমন ওয়াকিবহাল জাতীয় সংসদ এবং সুপ্রিম কোর্টও। এখনও মাথায় ঝুড়ি বা টব নিয়েই খালি হাতে ডাব্বু-হাতা কিংবা বেল্চায় তোলা মল নিয়ে মেথরানিরা পাড়ায়-পাড়ায় কাকভোরে, প্রায় লোকচক্ষুর অগোচরে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটেন। যাঁরা ফ্লাশ-টয়লেট সাফ করতে নিযুক্ত, তাঁদেরও অধিকাংশই মহিলা এবং তাঁদেরও খালি হাতেই সে কাজ করতে হয়। উপচে-পড়া সেফটি ট্যাংক পরিষ্কার করতেও খালি হাতে ট্যাংকের ভিতর নামতে হয়। অম্বেডকরের জন্মশতবর্ষে সংসদ হঠাত্‌ই সমস্যাটি সম্পর্কে সজাগ হয়, আইন পাশ করে। কিন্তু তার পর ১৮ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক শুনানিতেও এই ঘৃণিত কাজটি রাজ্যে-রাজ্যে চালু রয়েছে স্রেফ সরকারের অসহযোগিতায়। নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির মতো কেন্দ্রীয় সরকারও এই অস্পৃশ্য জীবিকাকে অদৃশ্য করে রাখতে চায়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ভারতীয় রেল। প্রতি দিন দেশের সব রেলপথে টন-টন মনুষ্য-বিষ্ঠা পড়ে, যা সাফাই কর্মীদেরই পরিষ্কার করতে হয়। না, কোনও যন্ত্র দিয়ে নয়, খাটা পায়খানা সাফ করার মতোই হাতে করে বেল্চা-ঝুড়ি নিয়ে। কিন্তু যাঁরা এ-কাজে নিযুক্ত, রেলের নথিতে তাঁদের অস্তিত্ব নেই। রেল বোর্ডের বক্তব্য, তারা ঠিকাদারকে রেলপথ পূরীষমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়, ঠিকাদাররা কী পদ্ধতিতে, কাদের দিয়ে তা সাফ করায়, সেটা রেলের মাথাব্যথা নয়। অতএব দেশের বৃহত্তম কর্মী-নিয়োগ সংস্থা ভারতীয় রেল সাফাই কর্মীদের এই বিপুল বাহিনীকে ‘অদৃশ্য’ করে দিয়েছে। যাঁরা বাস্তবে নেই, তাঁদের জন্য ভাবনা অবান্তর। তাই বিষ্ঠা সাফাইয়ের যান্ত্রিকীকরণ কিংবা ট্রেনের টয়লেট আধুনিকীকরণের কোনও প্রস্তাব কখনও বিবেচিত হয় না। রেলপথ ও স্টেশন পরিচ্ছন্ন রাখতে পাশ্চাত্যের মতো ট্রেনে ‘বায়ো-টয়লেট’ বসানোর কোনও প্রকল্পের কথা শোনা যায় না। কেননা তাতে মলমূত্র সাফ করা যাঁদের জীবিকা, সেই বিপুল সংখ্যক মেথর-ভাঙ্গি-ডোম-বাল্মীকিদের মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কী হবে তখন মনুসংহিতায় নির্দিষ্ট শূদ্রদের নিয়তি? কী হবে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও সমাজের, তার ধর্মগুরু ও সমাজপতিদের, তার সরপঞ্চ আর চণ্ডীমণ্ডপের?

তবে ইদানীং ভাঙ্গি-বাল্মীকি-মেথর রমণীরা নিজেরাই এ কাজ বন্ধ করার আন্দোলনে নেমেছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করছে সাফাই কর্মচারী আন্দোলন, নবসর্জন ট্রাস্ট, গরিমা অভিযান, আপ্না থিয়েটার, দলিত রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সুলভ ইন্টারন্যাশনালের মতো বহু সংগঠন। মহিলারা শাবল-গাঁইতি নিয়ে খাটা পায়খানা ভাঙছেন, মল বওয়ার ঝুড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছেন এবং আর কখনও এই কাজ না-করার শপথ নিচ্ছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে গেলে যাতে স্কুলের পায়খানা তাদের দিয়ে সাফ করানো না হয়, সে ব্যাপারেও চাপ সৃষ্টি করছেন। এটাই স্বচ্ছ ভারতের যথার্থ অভিযান। প্রচারের আলো এঁদের ওপর কখনও পড়ে না। কিন্তু শতেক শতাব্দী ধরে মাথায় বহন করা অসম্মান-ভার ছুড়ে ফেলতে এঁরা আজ বদ্ধপরিকর। এঁদের প্রতিজ্ঞাদৃঢ় আন্দোলনের খবরই তুলে এনেছেন ভাষা সিংহ তাঁর মমতাময় মানবতা দিয়ে। তিনি নিজে এই সব মেথর মহল্লায় গিয়েছেন, বাস করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন অন্নপান। হীন-পতিতের ভগবানকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এই অবমানবদের সুখদুঃখে, তাদের দিনযাপনের প্রাত্যহিকতায়। সংবেদনশীল পাঠকদের তিনি ঋণী করেছেন এই অনবদ্য আখ্যানে।

gautam roy book review swachh bharat abhiyan swachh bharat
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy