Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

উড়িয়েছেন ভারতের জয়পতাকা

বৈদ্যবাটির বঙ্গসন্তান এই সে দিনও ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষপদে। সর্বভারতীয় সত্তার পাশাপাশি বাঙালিয়ানাকে সযত্নে লালন করেছেন। বাঙালির সাহসের প্রতীক অরূপ রাহা।বৈদ্যবাটির বঙ্গসন্তান এই সে দিনও ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষপদে। সর্বভারতীয় সত্তার পাশাপাশি বাঙালিয়ানাকে সযত্নে লালন করেছেন। বাঙালির সাহসের প্রতীক অরূপ রাহা।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০৫
Share: Save:

বিলেতের ‘স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় এক বার লেখা হয়েছিল যে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র বাঙালিই নাকি নিজমুখে প্রকাশ্যে স্বীকার করে, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেওয়ার সাহস তার নেই। শুধু এই পত্রে নয়, সাধারণ ভাবে বাঙালির এ এক অপযশ। বাঙালি সমরভিরু। দুর্বল। শ্রমবিমুখ। বাঙালি মানেই শুদ্ধ ফিনফিনে ধুতি, বিলাসীবাবু।

প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান অরূপ রাহা বাঙালির এই অপযশের কাহিনীর বিরুদ্ধে যেন এক তীব্র প্রতিবাদ।

যশোরে পারিবারিক শিকড়। বাবাও ছিলেন লড়াকু মানুষ। তিনি ছিলেন এক চিকিৎসক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি তখনকার বর্মায় যান। আহত সৈনিকদের চিকিৎসা ছিল বাবার কাজ। সেই ননীগোপাল রাহার পুত্র অরূপ পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলে পড়ার সময়ই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। দেশের জন্য লড়তে চেয়েছিলেন তিনি। স্কুল থেকে ডিফেন্স কলেজ, কখনও এই বঙ্গসন্তান দ্বিতীয় হননি।

যশোর থেকে ছিন্নমূল পরিবার এ বাংলায় প্রথমে হাবড়ার মহিষা মছলন্দপুর, তার পর বৈদ্যবাটিতে বসতি স্থাপন করে। বৈদ্যবাটির ছেলে অরূপ। সেই অরূপ ধাপে ধাপে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হলেন ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সে দিন তাঁর ৯১ বছরের মা পারুল দেবীকে ফোন করেছিলেন অরূপ। মা, আমি এ দেশের বায়ুসেনা প্রধান হয়েছি। মা অশক্ত শরীরেও আবেগ আটকে রাখতে পারেননি। হাসতে হাসতেই তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন।

ছোট থেকেই নাকি তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিল বই। আর মা বলেন, ও খুব বাধ্য ছেলে ছিল। কথা শুনত সকলের। নিতান্ত বাঙালি হয়ে কখনওই থাকেননি। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির ছাত্র থাকার সময়ই তিনি পেয়েছিলেন এক উন্মুক্ত আকাশ।

১৯৭৪ সালে বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানের পাইলট হন তিনি। ক’জন বাঙালির ৪০০০ ঘণ্টা উড়ানের অভিজ্ঞতা রয়েছে! রাফ অ্যান্ড টাফ এই বাঙালি বায়ুসেনাপ্রধান হয়ে আর একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেন। মেয়েদের যুদ্ধবিমানের পাইলট করার ব্যাপারে দীর্ঘ দিনের লালিত ঔপনিবেশিক সংস্কার ছিল আমাদের সেনাবাহিনীর আমলাতান্ত্রিক মানসিকতায়। তিনি সেই প্রাচীর ভেঙে দেন।

অবসর গ্রহণের পর তিনি অনেক প্রাক্তন সেনা অফিসারের মতো দিল্লিতেই থেকে যাননি। অবসর জীবনকে একদম এক পাক্কা বাঙালির মতো করে কাটানোর জন্যই চলে গিয়েছেন কলকাতায়। বায়ুসেনার কাজের সুদীর্ঘ জীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতার এক বিরাট ঝোলা তাঁর কাঁধে। তবু তিনি শেষ পর্যন্ত এক প্রকৃত বাঙালি।

একটি প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই এসে যায়। প্রকৃত বাঙালি মানে? কে প্রকৃত বাঙালি? কিসে তার আগমার্কা বাঙালিয়ানা? শুধু তার পোশাকে? খাদ্যাভ্যাসে? অরূপবাবু ইলিশমাছ খেতে ভালবাসেন কি না, তিনি বাংলার বর্গসীমার এক স্থায়ী অধিবাসী কি না, বাংলাটা ঝরঝরে শুদ্ধ বলতে পারেন কি না— এগুলিই কি তাঁর বাঙালি হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য? কোঁচা লুটোনো ধুতি পরা, গিলে করা পাঞ্জাবি গায়ে বাংলা-বলা মাছভক্ত এক প্রজাতিই যদি এক জন বাঙালি হন, তবে হয়তো অরূপবাবুর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা এই প্রথাসিদ্ধ চিত্রের সঙ্গে মিলবে না।

ইংরেজি শিক্ষার আগে বাঙালি কি সে ভাবে তার আত্মপরিচয় খুঁজেছে? মনে হয়, রামমোহন-বঙ্কিমের আমল থেকে যখন জাতীয় চেতনার উদ্ভব হয়, তখন থেকে বাঙালিও তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান শুরু করে।

অরূপ রাহাকে দেখেছি, দিল্লিতেও তিনি যখন বায়ুসেনা ভবন থেকে সাউথ ব্লকে যেতেন, গুরুগম্ভীর বৈঠক করতেন, তখন তিনি এই অখণ্ড ভারতের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্রতী।

২০১৬ সালে ২২ জুলাই এএন-৩২ বিমান নিখোঁজ হয়ে যায় এক বার, সে বিমানে ২৯ জন কর্মী ছিল, তাদের মধ্যে ছিল চার জন অফিসার। তিনি নিজেই অবসর গ্রহণের পর বলেছিলেন, সে দিনের ওই বিমান নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ঘটনা। ভারতীয় বায়ুসেনা বিমানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সকলের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। সাউথ ব্লকে সেই সময় যখন তিনি সেই সঙ্কটমোচনে ব্যস্ত, ওয়ার রুম থেকে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন নানা স্থানে, তখন ভাবাই যাচ্ছিল না, এই মানুষটাই আমাদের বৈদ্যবাটির সেই বঙ্গসন্তান, যিনি ঘর অন্ধকার করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালবাসেন। আসলে অখণ্ড ভারতের সর্বভারতীয় সত্তার পাশাপাশি সারা জীবন ধরে তিনি রক্ষা করেছেন তার বাঙালি সত্তাকে। একের পর এক সার্ভিস মেডেল পাচ্ছেন, তখনও তাঁর সামরিক পোশাকের আড়ালো লুকোনো থাকত এই বাঙালি সত্তাটি।

জাতীয় মূল স্রোতে বাঙালির পরিসর অপস্রিয়মাণ। আজ হঠাৎ নয়। অনেক দিন থেকেই ইতিহাস বলে, গৌড়রাজ মহীপাল, বিগ্রহপাল, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন একদা হিমালয় প্রদেশেও বাঙালি উপনিবেশ স্থাপন করেন, দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নাকি গৌড়াধীশ লক্ষ্মণ সেন দিল্লিতেও দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। বারাণসী, প্রয়াগ ও শ্রীক্ষেত্রে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। বাংলার সেই অহঙ্কার আজ কোথায় গেল? টিমটিম করে জ্বলছে কিছু প্রদীপ। তবু শিল্প-সংস্কৃতি-গান-বাজনা-চলচ্চিত্র-নাটকে বাঙালির নতুন প্রজন্ম আসছে, কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষপদে বাঙালি? সে যেন এক ঐতিহাসিক অ-সম্ভব।

জম্মু-কাশ্মীরের বন্যা দেখতে আকাশপথে গিয়েছেন বাঙালি বায়ুসেনা প্রধান, সুইডেনে গিয়েও তিনি গ্রাইপেন যুদ্ধবিমান চালিয়েছেন, বিদেশের সংবাদমাধ্যমে সেই সব দৃশ্য প্রচারিত হয়েছে। এ সব কি চাট্টিখানি ব্যাপার? সার্জিকাল স্ট্রাইকের জন্য পাক সেনাবাহিনীকে চাপে রাখার রণকৌশল বহু দিন ধরে রচনা করেছেন কে? তিনিই। সাহস আর নিজের প্রতি বিশ্বাস অটুট থাকলে যে সত্যিই আকাশ জয় করা যায়, অরূপ রাহা তার প্রমাণ।

বঙ্গসন্তানের এই শীর্ষপদে আসীন হওয়ার ঘটনা যদি দেশের বঙ্গসমাজকে সার্বিক ভাবে উদ্বেল করে, এই পরিসরের সম্প্রসারণে আরও সক্রিয় হয় বাঙালি, তবে সে হবে এক বড় আনন্দ-সংবাদ। এক অতুল প্রাপ্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE