Advertisement
E-Paper

একই দোকানে মক্কা, মদিনা আর কৃষ্ণ, কালীর ক্যালেন্ডার

ছোটকুলবেড়িয়ায় ১১০০ ঘর মুসলিমের মাঝে মোদকরাই সবেধন নীলমণি হিন্দু পরিবার। নদিয়ার কিনারে মুর্শিদাবাদের গা-ঘেঁষা গ্রাম দেশভাগের পরে কোন দিকে পড়বে তা নিয়ে সংশয় ছিল।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১

হোয়াট্সঅ্যাপে পলাশির গোকুল শেখের মেসেজটা এসেছিল রামনবমীর দিন তিনেক বাদে। ‘ভাত কাপড়ের ধর্ম হয় না, পানি-রক্তের জাত হয় না! মনুষ্যত্বের ওপরে কোনও ধর্মের কথা চলে না!’

পলাশির যুদ্ধের সৌধ-ঘেঁষা গাঁ, গোকুলদের ছোটকুলবেড়িয়ায় নিস্তরঙ্গ জীবন বয়ে চলেছে কুলকুল করেই। বছরখানেক আগে সে-গ্রামের স্বপন মোদকের সঙ্গে আলাপ কলকাতা হাইকোর্টে। গ্রামের পড়শি আদুরি বিবির মেয়ের জন্য একটি মামলার ক্ষতিপূরণের টাকা জোগাড় করতে এসেছেন। উকিলবাবুকে পাকড়ে প্রবীণ স্বপনই তখন যাবতীয় দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত।

ছোটকুলবেড়িয়ায় ১১০০ ঘর মুসলিমের মাঝে মোদকরাই সবেধন নীলমণি হিন্দু পরিবার। নদিয়ার কিনারে মুর্শিদাবাদের গা-ঘেঁষা গ্রাম দেশভাগের পরে কোন দিকে পড়বে তা নিয়ে সংশয় ছিল। স্বপনের ঠাকুরদা তারাপদ মোদকও তখন ভেবেছিলেন জমিজমা বেচে অন্যত্র ঠাঁই গাড়বেন। কিন্তু প্রাণের বন্ধু গফুর শেখ, করিম মল্লিকেরা রুখে দাঁড়ালেন। ‘‘সে কক্ষনও হবেনিকো! মোটেও যেতে পারবা না, তোমরা!’’

স্বাধীনতার ৭০ বছর পার করেও সেই প্রীতির বাঁধন অটুট রয়েছে। মহসিন শেখের ছোট ছেলে গোকুলের নামটাও স্বপনের ভাই বিমলের রাখা। মহসিনের বড় ছেলে সফিকুলের সঙ্গে মিলিয়ে গোকুল! গ্রামে কারবালার মেলার সময়ে একদা জারি গানে ‘পিয়াসনামা জঙ্গ’-এর সুর ধরতেন স্বপন-বিমলেরা। আর এই চৈত্র মাসের শেষে শিবের গাজনে বাজনায় মাতাবেন স্বপনের ছোটবেলার বন্ধু নাসিরুদ্দিন মল্লিক-পটল শেখরা।

সেই গ্রামে ঘুরে ঘুরে পলাশির মাঠে বেড়াতে বেড়াতেই এ সব গল্প শুনছিলাম! এখন হিন্দি গানের দাপটে বাংলার রঙিন সব সংস্কৃতি ফিকে। তবে জীবনের ছন্দ বেসুর, বেতালা হয়নি। পয়লা বৈশাখ পলাশি স্টেশন লাগোয়া মীরাবাজারে স্বপনের বন্ধু জয়নাল হুসেন খাতাবইয়ের দোকানে একই সঙ্গে মক্কা, মদিনা ও কালী, কৃষ্ণের ক্যালেন্ডার বিলোবেন। বেশির ভাগ দোকানে এটাই রেওয়াজ। হিন্দু, মুসলিম সকলেই খদ্দের যে! সত্তর বছরে পলাশি স্টেশনের কাছের এই তল্লাট গোষ্ঠী-সংঘর্ষের খিটিমিটি কার্যত দেখেইনি।

গ্রামের নব্য যুবক গোকুল শেখ, টুটন শেখ, উজ্জ্বল রহমানরা কেউ কেউ রোজা রাখেন, মাজারে সুতো বাঁধেন। আবার বিশ্বকর্মা পুজোয় গাড়িপুজো করেন, দুগ্গাপুজোর ভোগের ঘুগনিটা পারতপক্ষে ছাড়েন না। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাতদিন পড়ে থাকার সময় নেই কারও। রেল কিংবা পুলিশ, সিআরপি, বিএসএফের পরীক্ষার ধকলেই সব ক’টার জীবন ঝাঁঝরা। মেয়েরা সালওয়ার কামিজের থেকে শাড়িতেই ঢের বেশি স্বচ্ছন্দ গ্রামে। ঘোমটার বা়ড়াবাড়ি নেই। দল বেঁধে অনেকেই ইঞ্জিন-ভ্যানে পুজোর ঠাকুর দেখতে যান।

গ্রামের একলা হিন্দু-বাড়ি বলে আত্মীয়কুটুমরা মাঝেমধ্যে স্বপনবাবুদের একটুআধটু উটকো প্রশ্ন করেন বটে! কিন্তু তা বলার মতো কিছু নয়। স্বপন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিচু স্বরে বলেন, ‘‘সব সময়ে মনে হয়, এখানে মায়ের গর্ভের মতো নিশ্চিন্তে আছি। গোটা গ্রাম যা সম্মান করে, ভালবাসে!’’

কথাটা শুনে খটকা লাগে। সত্যি বলছে তো লোকটা! কই এ রাজ্যে কোথায় কোন সম্প্রদায়ের পাল্লা ভারী, তা নিক্তিতে মেপে দেশের সংখ্যাগুরু সমাজের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠছে বলে যাঁরা নিত্য হা-হুতাশ করেন, তাঁদের হিসেব তো এর সঙ্গে মিলছে না! যাঁরা বাইরের দাড়ি-টুপি দেখে মানুষ ভাল কি মন্দ বলে দেগে দেন, তাঁরাও স্বপন মোদকের কথায় কিছুতেই খুশি হতে পারবেন না।

তবে ছোটকুলবেড়িয়ার প্রবীণ মানুষটি নিছকই আবেগসর্বস্ব নন। তাঁর বাপপিতেমোর জন্মভিটে গ্রামটুকুর বাইরেও একটা দুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ওয়াকিবহাল। স্বপন বলেন, ‘‘আমিও জানি, সব ধার্মিক লোক এক রকম হয় না। সব ধর্মেরই কিছু লোক থাকেন যাঁরা চান, তাঁদের ধর্মই সবার উপরে ছড়ি ঘোরাবে। তাঁদের নিয়ে যত ঝঞ্ঝাট।’’ ছোটকুলবেড়িয়ায় এই সমস্যা নেই। দেশ-বিদেশ কত হিংসা-রক্তপাতে তোলপাড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেদের গ্রামে এক মুহূর্তের জন্য বুক কাঁপেনি মোদকদের। গ্রামের লোকের ব্যবসাপাতি, চাষবাস টাল খায়নি। পাশের বাড়ির চাঁদ বিবির ছোট ছেলে ইসমাইল রোজকার মতো রাতভর কলেজের পড়া ঝালাই করতে মোদক-বাড়ি স্বপনের ভাইপো দীপের বিছানায় শুতে এসেছেন।

ফোনে গোকুল শেখের কথাগুলো কানে বাজছিল অনেক ক্ষণ বাদেও।

‘‘জানেনই তো, কাছে-দূরের কোনও উসকানির চেষ্টা আমাদের এখানে ধোপে টিকবে না।’’ এটা ঠিকই, ছক কষা কোনও প্ররোচনা ছাড়া, সচরাচর কেউই পশের লোকটিকে শত্রু ভাবতে চায় না। মানুষের জীবনযাপনে ফারাক থাকে। সংস্কারের অদৃশ্য দেওয়াল থাকে। কিন্তু সেটাই সব নয়। ছুতমার্গের সংস্কার যত পুরনো, সংস্কার ছাপিয়ে পাশের লোকটির হাত ধরার পরম্পরাও কম পুরনো নয়। বাঙালির ইতিহাস একটা দেশভাগ দেখেছে। কিন্তু তার পরেও মানুষে মানুষে টানের সৌহার্দ্যের ছবিটা এখনও দেখে চলেছে।

সব থেকে বড় কথা, এই দেশটার গড়ে ওঠাই তো বহুত্বের সাধনার লক্ষ্যে। যারা দলে ভারী, শুধু তাঁদের রীতি-রেওয়াজ মেনে সব কিছু চলবে তা তো নয়! আজকাল এ দেশের বড় বড় শহরের কিছু খবরে হতবাক হয়ে যাই। অমুক আবাসনে শুধু বামুন-কায়েতরা থাকবেন, তমুক বহুতলে আমিষাশীদের ঠাঁই নেই। এই কলকাতাতেও বহু অভিজাত পাড়ায় ব্যক্তির ধর্ম পছন্দ না-হলে বাড়ি ভাড়া না-দেওয়ার, বা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনি। অথচ কিছু আশ্চর্য পাড়া এখনও রয়েছে কলকাতাতেও। বউবাজারের বো স্ট্রিটে টুকটুকে লাল ইটের মহল্লা বো ব্যারাককে গড়পড়তা বাঙালি ‘কালোসাহেব’ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঘরবাড়ি বলে ধরে নেয়। বড়দিনের আলো দেখতে সেখানে যায়। অথচ এখনও ওখানে বহাল তবিয়তে রয়েছেন গুজরাতি নলিন শাহের মেয়ে-জামাই, বিধানসভার আধিকারিক শ্যামল দত্ত, হাইকোর্টের উকিল হাসানসাহেব, রেলের অফিসার সুশীল বাঁড়ুজ্জে কিংবা পঞ্জাবি বেরী-খুরানিরা। বড়বাজারের হিন্দি মাধ্যম স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই বেনারসীলালের পরিবার কট্টর শাকাহারী। অথচ পাশেই গ্লেন্ডা রিজকুকের বিফ চপ, চিনা ভারতীয় রিচার্ড হোয়ের পর্ক রোস্টের টানে ভিড় করছেন সমঝদার খাইয়েরা।

কই, দেশের কোথাও কোনও অশান্তির ঠোকাঠুকিতে তো এ সব পাড়া ঠান্ডা রাখতে পুলিশ বসাতে হয়নি! মনে রাখতে হবে, বাঙালির বাঙালিয়ানার আসল শক্তি এই দেওয়াল ভেঙে দুনিয়ার হাত ধরার মধ্যে। শুধু রবীন্দ্র-নজরুলের লেখায় নয়, আমাদের যাপনের বহতা স্রোতে তা এখনও বেঁচে আছে।

Communal harmony Poila Baisakh Special
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy