Advertisement
১৯ মে ২০২৪

তিব্বতে ‘ধম্ম’ ফেরালেন অতীশ দীপঙ্কর

সপ্তম শতাব্দীতে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করেছিল, তার পরের একশো বছরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারত থেকে আচার্য শান্তরক্ষিত ও পদ্মনাভ’র আগমনের পর, তিব্বতিরা বৌদ্ধ জীবনাদর্শে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে। ভারতের ওদন্তপুরী বিহারের আঙ্গিকে সাম্‌ইয়ে বৌদ্ধ বিহার গড়া, বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশোনা, তিব্বতি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলোর অনুবাদ।

আচার্য অতীশ দীপঙ্করের মূর্তি

আচার্য অতীশ দীপঙ্করের মূর্তি

পেনপা দোরজি
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ১১:৪৩
Share: Save:

সপ্তম শতাব্দীতে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করেছিল, তার পরের একশো বছরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারত থেকে আচার্য শান্তরক্ষিত ও পদ্মনাভ’র আগমনের পর, তিব্বতিরা বৌদ্ধ জীবনাদর্শে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে। ভারতের ওদন্তপুরী বিহারের আঙ্গিকে সাম্‌ইয়ে বৌদ্ধ বিহার গড়া, বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশোনা, তিব্বতি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলোর অনুবাদ, আর এই প্রথম তিব্বতিদের বৌদ্ধ ভিক্ষুজীবনে প্রবেশ— অসামান্য এই সব ঘটনা তিব্বতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

নবম শতকের শেষের দিকে সম্রাট থিরালপাচান-কে হত্যা করে লাংদারমা সম্রাট হলেন। তাঁর শাসনের সময়, এই তুষাররাজ্য থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় অদৃশ্যই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। গোটা সাম্রাজ্য একশোরও বেশি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল।

লাংদারমা-র রাজত্বের পর, এবং পরবর্তী কালে তিব্বত ভেঙে যাওয়ার পর, পুরো দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন এমন কেউ তিব্বতে ছিলেন না। মধ্য তিব্বত থেকে ‘বিনয়’ অনুশীলন প্রায় উবে গিয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম তিব্বতের অনেক জায়গায় এর চর্চা ছিল। অবশ্য এই সময় তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের নামে অনেক ভণ্ড আচার-অনুষ্ঠানও শুরু হয়।

বৌদ্ধধর্মের এই অবক্ষয়ে চিন্তিত হয়ে, পশ্চিম তিব্বতের ‘গুজ’ অঞ্চলের শাসক, লালামা ইয়েশে ওদ, তিব্বতের বৌদ্ধধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এও বলা হয়, তিনি নাকি সোনার সন্ধানে বেরিয়েছিলেন; সেই সোনা ব্যবহার করে ভারত থেকে বৌদ্ধ পণ্ডিতদের তিব্বতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসবেন বলে। কিন্তু পাশের রাজ্যের রাজা তাঁকে বন্দি করেন ও মুক্তিপণ হিসেবে লালামা ইয়েশে ওদ-এর শরীরের ওজনের সমান সোনা দাবি করেন। তখন ওদ-এর ভাই, লালামা জাংচুব ওদ, চেষ্টা করেও অত সোনা জোগাড় করতে পারলেন না।

ইয়েশে ওদ তখন তাঁর ভাইকে বললেন, তিনি তো বুড়ো হয়েই গেছেন, শরীরও ভেঙে পড়ছে আস্তে আস্তে, তাই তাঁকে উদ্ধার করার জন্য যেটুকু সোনা জমা করা হয়েছে, তা দিয়ে যেন আচার্য অতীশকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানানো হয়; অতীশ দীপঙ্কর যেন তিব্বতে বুদ্ধ-কথিত ‘ধম্ম’-কে রক্ষা করেন। ভাই তখন নাগশো লোৎসাওয়া-কে ভারতে পাঠালেন, অতীশকে আমন্ত্রণ জানাতে।

নাগশো ভারতে এসে বিক্রমশীলা মহাবিহারের গিয়া সোনডু সেঙ্গে-র (অনুবাদক) সঙ্গে দেখা করলেন। গিয়া সোনডু সেঙ্গে, নাগশো-কে নিয়ে গেলেন অতীশের কাছে, গুজ-এর রাজার বার্তা জানালেন তাঁকে। সব শুনে অতীশের প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল: লালামা ইয়েশে ওদ প্রকৃতপক্ষে এক জন বোধিসত্ত্ব। ইয়েশে ওদ-এর পরিণাম ও ত্যাগের কথা শুনে তিনি তিব্বত যেতে রাজি হলেন।

অতীশ যখন তিব্বত গেলেন, তখন বৌদ্ধধর্ম স্তিমিত, ক্ষীয়মাণ। চারদিকে শুধু ভুল তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের রমরমা। লালামা জাংচুব ওদ অতীশকে অনুরোধ জানালেন, কর্ম ও তার ফল বিষয়ে শিক্ষা দিতে। রাজার অনুরোধে অতীশ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘বোধিপথপ্রদীপ’, যেখানে প্রজ্ঞানপারমিতা ও তন্ত্র, দুটি দর্শনেরই ব্যাখ্যা আছে।

‘বোধিপথপ্রদীপ’-এর এক ভাষ্যে (রচয়িতা অজ্ঞাত) লেখা আছে, অতীশ কেন এই গ্রন্থ রচনা করলেন। সেখানে লেখক লিখছেন, তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের শুরুর দিকে, সাধারণ মানুষের তন্ত্রচর্চা বুদ্ধের বাণীকে প্রভাবিত করেনি। কিন্তু পরের দিকে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও জনসাধারণের মতো তন্ত্র-অনুশীলনে জড়িয়ে পড়েন, এমনকী বিবাহিত জীবনযাপনও শুরু করেন। এই ধরনের অসংযত আচার-অনুষ্ঠান বুদ্ধের বাণীকে কলুষিত করেছিল, ‘ধম্ম’ প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল।

বলা হয়ে থাকে, ‘বোধিপথপ্রদীপ’ গ্রন্থটি আসলে পবিত্র ও প্রামাণ্য বৌদ্ধ আচারগুলি কী ভাবে পালন করতে হবে, তারই নির্দেশিকা।

বুদ্ধের বাণীর আলোয়, এবং মানুষ দুঃখকে কোন দৃষ্টিতে দেখে আর তার নিবারণের জন্য কী কী করে, তার ভিত্তিতে আচার্য অতীশ মানুষকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করলেন। জীবনের প্রতি, ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেও অতীশের এই শ্রেণিবিভাগ। চাই সর্বকল্যাণকামী এক হৃদয়, ‘বোধিচিত্ত’— অতীশ জোর দিয়ে বলেছিলেন। পরে তিনি এই বোধিচিত্তকেও দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন: ঊর্ধ্বমুখী (aspiring) বোধিচিত্ত ও নিবিষ্ট (engaging) বোধিচিত্ত। বুদ্ধের পথের পথিককে ‘বোধিপথপ্রদীপ’ প্রথমে পথ দেখায় দুটি স্তরের মধ্য দিয়ে। কেউ হয়তো এ জন্মের তুলনায় আরও ভাল এক পুনর্জন্মের প্রত্যাশী।

আবার কেউ চান আত্মমুক্তি। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী যা সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, সেই ‘মহাযান’-এর পথেই এর দিক্‌নির্দেশ— সমস্ত জীবিত প্রাণের কল্যাণকল্পে বোধি অর্জন করা।

অতীশ দ্রুত আর খুব সহজেই তিব্বতের সর্ব স্তরের মানুষকে আকর্ষণ করলেন। সেই সঙ্গে ‘বোধিপথপ্রদীপ’ও পরিবাহিত হতে থাকল তাঁর শিষ্যদের মারফত। চতুর্দশ শতাব্দীতে সোংখাপা থেকে শুরু করে আজকের পরমপূজ্য দলাই লামা পর্যন্ত, ‘বোধিপথপ্রদীপ’-এর প্রচারের উত্তরাধিকার সুসংরক্ষিত; এখনও এই গ্রন্থপাঠ হয়ে চলেছে। অতীশের ‘বোধিপথপ্রদীপ’কে ভিত্তি করে, আচার্য সোংখাপা পরে ‘বিয়াং চুব লাম রিম চেনমো’ নামে একটি বহুখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে বোধিলাভের পথের পবিত্র ধাপগুলি ব্যাখ্যা করা আছে। তিব্বতি পণ্ডিতদের লেখা ‘বোধিপথপ্রদীপ’-এর কুড়িটি ভাষ্য এখনও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের ভাষ্যরচনার ধারাটি একবিংশ শতাব্দী ছুঁয়ে বয়ে চলেছে।

এক বার কয়েক জন তিব্বতি শিষ্য অতীশের কাছে এসে দর্শন-শিক্ষার প্রার্থনা জানালেন। অতীশ বললেন, ‘দার্শনিক ধারণা, সে তো অসীম, অনন্ত। তোমরা বরং সেই সারসত্যের (essence) ধ্যান করো।’ শিষ্যরা বলল, কী ভাবে করব? অতীশ উত্তর দিলেন, ‘ষড়রাজ্যের সমস্ত অনুভবী জীবের প্রতি করুণা রাখো। তাদের অসহনীয় দুঃখ দেখে যেন তোমাদের বোধিচিত্ত জাগ্রত হয়। সমগ্র অন্তঃ ও বহির্ঘটনাকে মায়া বোধে ধ্যান করো। জগতের সমস্ত প্রাণের সঙ্গে একচিত্ত হয়ে সমস্ত কর্ম উৎসর্গ করো। এ ভাবেই সারসত্যে মন কেন্দ্রীভূত হবে।’

‘বোধিপথপ্রদীপ’-এ অতীশ বুদ্ধের সমগ্র বাণীকে সংক্ষেপে ধরেছিলেন। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের শুদ্ধিকরণ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। পরমপূজ্য দলাই লামা ও বিশ্ব জুড়ে বহু বৌদ্ধ পণ্ডিতের অসংখ্য রচনার মধ্য দিয়ে অতীশেরই উত্তরাধিকার চলেছে।

সারনাথ-এ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব টিবেটান স্টাডিজ-এ শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Penpa Dorjee Atish Dipankar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE