আজ বসে পুরনো সব নাটকের প্রথম অভিনয়ের দিনগুলো দেখছিলাম। এই প্রথম আমি পুজোর সময় নতুন নাটক করছি, তুঘলক। ‘পুজো’ আর ‘নাটক’ এই শব্দ দুটো লেখার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তে পিছিয়ে গেলাম প্রায় চল্লিশ বছর। তখন থাকতাম মছলন্দপুরে। আমাদের নিজেদের বাড়ি। মা পাশের একটা স্কুলের শিক্ষিকা, বাবার পোস্টিং তখন হাবরায়। অনেকটা জায়গা নিয়ে আমাদের বাড়ি। পুরো জমিটা সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে বড় উঠোন আর বিশাল বাগান। বাগানে গন্ধরাজ, টগর, জুঁই, লিচু, জাম, জামরুল, আমড়া, আম, কাঁঠাল, বেল, শিউলি, ডুমুর, জলপাই, নারকেল, আতা, তেঁতুল, পেঁপে, আনারস, লেবু, খেজুর, পেয়ারা, অর্জুন— আরও কত গাছ। আসলে প্রত্যেকটা গাছের সঙ্গে এক একটা গল্প ছিল আমার। পিছনে ছোট একটা পুকুর আর পুকুরের পাশে গরু আর মুরগির থাকার জায়গা। এই গাছ আর জলের সঙ্গে আমার কথোপকথনে তৈরি হত আশ্চর্য সব নাটক। একটা আমগাছের নিচু ডাল তখন আমার রাজ সিংহাসন। পাশের এক একটা গাছ তখন বিভিন্ন চরিত্র হয়ে কথা বলত আমার সঙ্গে।
হাওয়ায় বেজে ওঠা গাছের শব্দ, পাতা ঝরে পড়ার শব্দ, পাখির ডাকে সে এক অসাধারণ আবহসঙ্গীত। সকালের শিশিরে খালি পায়ে ঘাসের উপর হেঁটে শিউলি ফুল কুড়ানো আর পেট-রোগা ছিলাম বলে থানকুনি পাতা। রোদ একটু বাড়লে এক ছুটে পাশের ক্লাব রামকৃষ্ণ পাঠাগারে। সেখানে মূর্তি গড়া হচ্ছে। শিল্পী আসতেন কৃষ্ণনগর থেকে। তিল তিল করে গড়ে ওঠা সেই তিলোত্তমা শিল্প দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। পুজোর সময় বাড়ি ভর্তি আমার জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা। বাবারা ছয় ভাই এক বোন। বাবা ‘মেজ’, তারপর ‘সেজ’, ‘ন’, ‘ফুল’, ‘ছোট’। বাবা স্বাধীনতার আগে খুলনা থেকে এখানে চলে এসেছিলেন, তার পর অন্য ভাইদের নিয়ে এসেছিলেন। কাকুরা পুজোর সময় সবাই মিলে মছলন্দপুরের বাড়িতে চলে আসতেন। আর আমি পেয়ে যেতাম আমার পুজোর নাটকের কুশীলবদের, আমার ভাইবোনদের। বাড়িতে ফুলকাকুর একটা ‘ব্ল্যাক কার্টেন’ ছিল। শুনেছিলাম, ছোটবেলায় ফুলকাকু নাকি একটা যাত্রাদল তৈরি করেছিলেন, এটা তার স্মৃতি। আমরা দুপুরবেলা থেকে মহড়া শুরু করতাম। রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়ের নাটক বা রূপকথার গল্প নিয়ে তৈরি হত সেই সব নাটক। তখনও বিদ্যুৎ আসেনি মছলন্দপুরে। সন্ধ্যাবেলায় হ্যারিকেন বা হ্যাজাকের আলোয় খোলা বারান্দায় ফুলকাকুর সেই ‘ব্ল্যাক কার্টেন’ টাঙিয়ে শুরু হত সেই সব নাটক।
কলকাতায় স্থায়ী ডেরা পেতেছি বছর বাইশ। কিন্তু শহরের পুজো কোনও দিন আমার প্রিয় স্মৃতির মধ্যে নেই। তাই প্রতি বার পুজোর সময় আমি ডুব দিই সেই সব মায়াবী নাট্যে। যেখানে মঞ্চ, আলো, আবহ তৈরি হয় এক লহমায়। আর আমি দর্শক হিসেবে আমাকেই দেখতে থাকি সেই নাট্যে, যা চিরকালীন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy