Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিভূতিভূষণের ভিটেতে সাপের আস্তানা

বাড়িটির সামনে-পিছনে ইটের পাঁচিল। দু’পাশ কাঁটাতারে ঘেরা। তার সামনে আগাছার জঙ্গল। তার মধ্যেই মাথা তুলেছে আম, কদম, টগর, জবার গাছ। বা়ড়ির পিছনে পানীয় জলের কল অকেজো। বাড়ি ঘিরে সর্বত্র বিষাক্ত সাপের আনাগোনা। চোখে পড়ে ভাঙা মদের বোতলও!

অযত্নে পড়ে রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যপাধ্যায়ের বাড়ি। (ডান দিকে) সাহিত্যিকের জুতো। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

অযত্নে পড়ে রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যপাধ্যায়ের বাড়ি। (ডান দিকে) সাহিত্যিকের জুতো। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
গোপালনগর শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০১:২৪
Share: Save:

বাড়িটির সামনে-পিছনে ইটের পাঁচিল।

দু’পাশ কাঁটাতারে ঘেরা। তার সামনে আগাছার জঙ্গল। তার মধ্যেই মাথা তুলেছে আম, কদম, টগর, জবার গাছ।

বা়ড়ির পিছনে পানীয় জলের কল অকেজো। বাড়ি ঘিরে সর্বত্র বিষাক্ত সাপের আনাগোনা। চোখে পড়ে ভাঙা মদের বোতলও!

গোপালনগরের শ্রীপল্লি বারাকপুর গ্রামের এই বাড়িটিকে ঘিরে এলাকার বাসিন্দাদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু তার সঙ্গে মিশে থাকে আক্ষেপও। কেননা, এখানেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ, এই বাড়ির সর্বত্রই এখন অযত্নের ছাপ।

সাহিত্যিকের বাড়ির কাছেই ইছামতী নদীর ধারে বাম আমলে তৈরি হয়েছিল ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতিঘাট’। এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, ওই স্মৃতিঘাটের কাছেই ইছামতীতে সাহিত্যিক স্নান করতে আসতেন। ২০০০ সালে স্মৃতিঘাটে সাহিত্যিকের একটি বড় মূর্তি বসানো হয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হতে চলেছে। স্মৃতিঘাটের আলোগুলি খারাপ হয়ে গিয়েছে। স্মৃতিঘাটের সঙ্গেই আছে পূর্ত দফতরের দোতলা অতিথি-নিবাস। অতীতে সেখানে পর্যটকেরা এসে থাকলেও এখন কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না। রোজ নানা এলাকা থেকে মানুষ স্মৃতিঘাটে সময় কাটাতে আসেন।

এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, সরকার ওই বাড়িটি ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করুক। সেখানে সংগ্রহশালা তৈরি করা হোক। যাতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে সাহিত্যিক সম্পর্কে তথ্য জানতে পারেন। ওই বাড়ি এবং ওই স্মৃতিঘাটকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। যা হলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিও হবে। কিন্তু আজও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু দিন আগে অবশ্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তার চিহ্ন তেমন চোখে পড়ে না।

স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস অবশ্য জানিয়েছেন, হেরিটেজ ঘোষণা এবং এখানে সংগ্রহশালা তৈরি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, ‘‘পর্যটনমন্ত্রীকেও বিষয়টি জানিয়েছি। অতিথি-নিবাস কিছু দিনের মধ্যে খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’

বারাকপুর গ্রামের ওই বাড়িতেই বিভূতিভূষণের ছোটবেলা থেকে সাহিত্য-জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে। এখানে থাকাকালীনই তিনি লিখেছিলেন পথের পাঁচালি, ইছামতীর মতো কালজয়ী সব উপন্যাস। বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্মৃতিরেখা’। তবে, ওই নামকরণ হয় বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পরে। গ্রামবাসীরা জানালেন, বিভূতিভূষণের আত্মীয় পুষ্প চক্রবর্তী এখানে থাকতেন। তিনিই কার্যত বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। এখন কেউ ওই বাড়িতে থাকেন না। সাহিত্যিক-পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকাকালীন মাঝেমধ্যেই ওই বাড়িতে আসতেন।

এখন বাড়ির গেটে তালা ঝোলে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ভিতরে দু’দিকে বসানো হয়েছে সাহিত্যিক এবং তাঁর স্ত্রী রমা (কল্যাণী) বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির পাশে লেখা— ‘গৃহটিকে কলুষিত করবেন না’। কিন্তু দেওয়ালে আঁকিবুঁকি দেখে বোঝা যায়, বাড়িকে কলুষিত করতে কেউ কসুর করেননি। গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলেন সাহিত্যিক। তাঁর কথা এখনও উজ্জ্বল ছাত্র গৌরচন্দ্র রায়ের স্মৃতিতে। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে আমি স্যারকে পেয়েছিলাম ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে। স্যার বাংলা পড়াতেন। হ্যান্ডলুমের খয়েরি রঙের পাঞ্চাবি পড়ে আসতেন। ক্লাসে একটি সরু বেত নিয়ে আসতেন। তবে, কাউকে মারতেন না। তখন আমরা কেন, শিক্ষকেরাও জানতেন না তিনি লেখালেখি করেন। পথের পাঁচালি সিনেমার পর আমরা জানতে পারলাম স্যারের সাহিত্য-কীর্তির কথা।’’ কিন্তু ‘স্যার’-এর বাড়ির বেহাল অবস্থার জন্য তিনিও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এলাকায় প্রতি বছর সাহিত্যিকের নামে দু’টি মেলা হয়। রয়েছে বিভূতিভূষণ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি। একটি মেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আশিস বসু ও দীপক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিভূতিভূষণ এখা‌নকার মানুষ ছিলেন বলে আমরা গর্বিত। কিন্তু তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের আরও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। লাইব্রেরিতে তাঁর জুতো, চশমার বাক্স, হুঁকো সোয়েটার, পাঞ্জাবি এবং কিছু চিঠিপত্র আছে। আমরা চাই, বিভূতিবাবুর বাড়িটি সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে উঠুক।’’ এই শহরে এলে অনেকেই বিভূতিভূষণের বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু এখানে সাহিত্যিকের স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। সজল রায় এবং অপূর্ব মুখোপাধ্যায় নামে স্থানীয় দুই যুবক বলেন, ‘‘দিন কয়েক আগে জাপান থেকে কয়েক জন এসেছিলেন। তাঁরা বাড়ির ওই পরিস্থিতি দেখে হতাশ। আমরাও খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি।’’

বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অণিমা মণ্ডল সাহিত্যিকের বাড়ির সামনের রাস্তাটি শীঘ্রই ঢালাই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাড়িটি সংরক্ষণ বা সংগ্রহশালা কবে হবে, সেই প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে শহরের বাসিন্দাদের মনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE