Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

অনুপ্রবেশের তত্ত্ব আসলে ধাপ্পাবাজি

পরিসংখ্যান বলছে, অনুপ্রবেশের ফলে এই রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। বরং, অশিক্ষা বা দারিদ্রের মতো উন্নয়নের (অভাবের) সূচকের সঙ্গেই মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক।ধর্মভিত্তিক জনগণনার পরিসংখ্যান সামনে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা নিয়ে স্বভাবতই আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রশ্নটা তো রাজনৈতিক ছিলই। এ বার তাতে পরিসংখ্যানের ধুনোর গন্ধ লাগলে হিন্দুত্ববাদীরা মনে বিশেষ জোর পাবেন, তা আর বিচিত্র কী? কিন্তু, রাজনীতি সরিয়ে রাখলে, পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা কেমন?

শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ধর্মভিত্তিক জনগণনার পরিসংখ্যান সামনে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা নিয়ে স্বভাবতই আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রশ্নটা তো রাজনৈতিক ছিলই। এ বার তাতে পরিসংখ্যানের ধুনোর গন্ধ লাগলে হিন্দুত্ববাদীরা মনে বিশেষ জোর পাবেন, তা আর বিচিত্র কী? কিন্তু, রাজনীতি সরিয়ে রাখলে, পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা কেমন?

এই রাজ্যের জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ২০০১ সালের ৭২.৫% থেকে ২০১১ সালে কমে হয়েছে ৭০.৫%, যেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত একই সময়ে ২৫.২% থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭%। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.২% যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালে কমে হয় ১০.৮%। একই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২৫.৯% থেকে কমে হয় ২১.৮%। অর্থাৎ, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে— হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৩.৪ শতাংশ-বিন্দু, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৪.১ শতাংশ-বিন্দু।

নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা দুর্গাপূজা করেন তাঁরা শরণার্থী, আর যাঁরা করেন না তাঁরা অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ, অনুপ্রবেশকারী মানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যায় কোনও মৌলিক তারতম্য দেখা যায়নি, বিপুল পরিমাণে অনুপ্রবেশকারী রাজ্যে প্রবেশ করলে যা ঘটত।

কেউ বলতেই পারেন, রাজ্যের জেলাওয়াড়ি হিসেবের মধ্যেই, বিশেষত সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রে, লুকিয়ে আছে অনুপ্রবেশের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য। পরিসংখ্যান যখন আছে, তখন দেখে নেওয়াই তো ভাল। সঙ্গের সারণিতে জেলাওয়াড়ি জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ দেওয়া হল, কিন্তু একটু অন্য ভাবে। ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কত, তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সারণিতে এই ধর্মভিত্তিক গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে সেই সম্প্রদায়ের জেলা ভিত্তিক বৃদ্ধির হার কতটা উপরে বা নীচে রয়েছে, তা দেওয়া হল।

প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলির দিকে তাকানো যাক। দেখা যাচ্ছে যে সেই জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনও নির্দিষ্ট একটি প্রবণতা নেই। এক দিকে যেমন উত্তর দিনাজপুরে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের গড়ের তুলনায় ৮ শতাংশ-বিন্দু বেশি, সেখানে আবার নদিয়ায় তা প্রায় ৪ শতাংশ-বিন্দু কম, দক্ষিণ দিনাজপুরে ৭.৫ শতাংশ-বিন্দু কম। দ্বিতীয়ত, যে জেলায় মুসলমানদের বৃদ্ধির হার রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি, সেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেমন, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইত্যাদি। আবার, যেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার এই সম্প্রদায়ের রাজ্য গড়ের তুলনায় কম, সেই জেলাগুলিতে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, পুরুলিয়ার মতো জেলাও রয়েছে যা সীমান্তবর্তী জেলা না হওয়া সত্ত্বেও এই জেলাতে মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি।

এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্তে খুব সহজেই পৌঁছনো সম্ভব। প্রথমত, সীমান্তবর্তী জেলাগুলি অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে, এই বক্তব্যের কোনও সারবত্তা নেই, কারণ এই জেলাগুলিতে কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিকে কোনও নির্দিষ্ট ছকে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ধার্মিক পরিচয়ের তুলনায় অন্য কয়েকটি সূচক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, যে জেলাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বৃদ্ধির হার রাজ্যে গড়ের তুলনায় অনেকটা বেশি, সেই জেলাগুলির স্বাক্ষরতার হার অন্য জেলাগুলির তুলনায় অনেক কম। স্বাক্ষরতার নিরিখে উত্তর দিনাজপুরের স্থান সবার নীচে, তার ঠিক উপরেই রয়েছে মালদা, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ। আবার তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে থাকা জেলা যেমন কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, হুগলি বা উত্তর ২৪ পরগনা উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রােজ্য গড়ের থেকে কম। স্বাক্ষরতার নিরিখেও এই জেলাগুলির স্থান অনেক উপরে।

বিশেষত উল্লখযোগ্য যে কলকাতায় মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার শূন্য (২০০১-২০১১র মধ্যে)। এবং কলকাতার জন্মহার ভারতের ৬৪০টি জেলার মধ্যে বর্তমানে সর্বনিম্ন (১.২ সন্তান প্রতি দম্পতি)। জনসংখ্যাবিদদের মতে, সাধারণত অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন, সামাজিক পশ্চাদপদতা এবং জন্মহারের মধ্যে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হলে অনুপ্রবেশের মত বিভেদপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরে বাজার গরম না করে বরং মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা বেশি জরুরি।

তা যদি হয়, তবে আমাদের রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্ক আরও কিছু কথা বলা আবশ্যিক। ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা (SNAP ও Guidance Guild কর্তৃক) অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে ১৭.৩% পরিবার নিরক্ষর, এবং আরও ১১.৮% পরিবারের সদস্যরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি। ৮০% মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় কায়িক শ্রম ও দিনমজুরির মধ্য দিয়ে। এই সম্প্রদায়ের মাত্র ১৭% মানুষ শহরে বসবাস করেন, এবং ডাক্তারি, ওকালতি বা অধ্যাপকের মত পেশা আছে মাত্র ০.৪% মানুষের। অর্থাৎ, রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থ সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই পরিস্থিতিতে এই সম্প্রদায়ের জন্মহার অন্য সম্প্রদায়ের থেকে বেশি হওয়াতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তা সত্ত্বেও, রাজ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। এর অনেক কারণ রয়েছে। আমরা শুধু দুটি কারণের উল্লেখ করব। এক, গর্ভ নিরোধক পদ্ধতির ব্যবহারের হার গোটা দেশের মুসলমানদের মধ্যে এ রাজ্যে সর্বোচ্চ।

দ্বিতীয় কারণটি কলকাতা শহরের নিরিখে বর্তমান নিবন্ধের এক লেখকের গবেষণায় উঠে এসেছে। সেই গবেষণার ফল বলছে, পরিবারের সন্তানদের আরও ভাল করে বড় করে তোলা এবং উন্নত জীবন দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা মুসলমান পরিবারেও দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। মুসলমান সমাজের এই আকাঙ্ক্ষাকে স্বচ্ছ ও ন্যায্য ভাবে বাস্তবায়িত করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অতি জরুরি।

কিন্তু এক দিকে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের লাগাতার প্রচার চলছে, অন্য দিকে এই সম্প্রদায়ের উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলি কোনও নতুন দিশা দেখাতে পারছে না। যে রাজনীতি চলছে, তাতে মুসলমানদের উন্নতি অসম্ভব। বরং, রঙ্গরাজন কমিটি’র সুপারিশ মেনে মুসলমান সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অংশকে অনগ্রসর শ্রেণির আওতায় এতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সরকারি চাকুরিতে বা সমাজের অন্যান্য অংশে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করা উচিত।

কিন্তু সমস্ত সমস্যার সমাধান এতেই হয়ে যাবে না। উপরোক্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে যেই ব্লকগুলিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগুরু সেখানে স্কুল সংখ্যা অন্যান্য ব্লকের তুলনায় উল্লখযোগ্য ভাবে কম। হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই বিষয় দেখা যাচ্ছে। তাই মুসলমান প্রধান এলাকায় যথার্থ পরিকাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালন না করে এক দিকে সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে আর অন্য দিকে মৌলবিদের ভাতা দিয়ে মুসলমানদের উন্নতি হবে না।

দু’জনেই ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE