E-Paper

হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দি শাসন

প্রশ্নগুলো জড়িয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচিতির সঙ্গে। ভারতে স্বাধীনতার পর রাজ্য পুনর্গঠনের প্রধান নির্ধারক হবে ভাষা— ১৯১৭ সাল থেকে এই ছিল কংগ্রেসের অবস্থান।

কণাদ সিংহ

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:১৯
অস্বীকার: হিন্দি লেখার উপর কালি লেপে ডিএমকে-র প্রতিবাদ, মাদুরাই, ২৫ ফেব্রুয়ারি।

অস্বীকার: হিন্দি লেখার উপর কালি লেপে ডিএমকে-র প্রতিবাদ, মাদুরাই, ২৫ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই।

ময়দানে গীতাপাঠের অনুষ্ঠান-মঞ্চে এক ধর্মগুরু ডাক দিলেন— বাঙালি হিন্দুরা একজোট হলেই নাকি ভারতে প্রতিষ্ঠিত হবে হিন্দুরাষ্ট্র। এই অনুষ্ঠানেই দেখা গেল ময়দানে চিকেন প্যাটি বিক্রির জন্য মুসলমান বিক্রেতাদের নিগ্রহ। প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রে কি শুধু হিন্দি বলয়ের ‘উচ্চবর্ণ’ হিন্দুর খাদ্যাভ্যাসই হবে স্বীকৃত? একই মঞ্চে স্বয়ং রাজ্যপাল বললেন, হিন্দি রাষ্ট্রভাষা— মায়ের মতো, আর ইংরেজি ধাইমা। বাঙালির মাতৃসম ভাষা তবে বাংলা নয়, হিন্দি? গীতা প্রচারের সভায় হিন্দির জয়গানই বা কেন? গীতার ভাষা তো সংস্কৃত! হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষাও নয়। তবে কি হিন্দি প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা?

প্রশ্নগুলো জড়িয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচিতির সঙ্গে। ভারতে স্বাধীনতার পর রাজ্য পুনর্গঠনের প্রধান নির্ধারক হবে ভাষা— ১৯১৭ সাল থেকে এই ছিল কংগ্রেসের অবস্থান। পাশাপাশি কোনও একটি ভারতীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গড়ে তোলার চিন্তাও ছিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তখন ছাপ ফেলেছে ভাষার উপরেও। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কথ্য ভাষাও হচ্ছে ধর্মের নিরিখে বিভাজিত। সংস্কৃত শব্দবহুল ও দেবনাগরী লিপিতে লিখিত হিন্দিকে দেখা হচ্ছে হিন্দুদের ভাষা হিসাবে, আর আরবি-ফারসি লিপি ও শব্দবহুল উর্দুকে ভাবা হচ্ছে মুসলমানদের ভাষা। যদিও দু’টি ভাষা মূলগত ভাবে একই। মিশ্র শব্দভান্ডার-সমন্বিত, এবং উভয় লিপিতেই লিখিত সেই বৃহত্তর ভাষা ‘হিন্দুস্থানি’ উত্তর ভারতে ছিল বহুলব্যবহৃত। হিন্দুস্থানিকেই মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু সম্ভাব্য রাষ্ট্রভাষা ভেবেছিলেন। অখিল ভারতীয় হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সহ-সভাপতি পুরুষোত্তমদাস টন্ডন হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুললে ১৯৪৫ সালে গান্ধী এই সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরে অবশ্য হিন্দুস্থানি নয়, জোরালো হয় হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। এই ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’-এর প্রবল বিরোধিতা করেন টি টি কৃষ্ণমাচারির মতো দক্ষিণ ভারতের নেতারা। সংবিধান সভায় সিদ্ধান্ত হয় ১৫ বছরের জন্য হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিকেও সরকারি কাজকর্মে ব্যবহারের। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে সংযোজিত ১৪টি ভাষাই (এখন ২২) ‘জাতীয় ভাষা’ হিসাবে স্বীকৃত হয়।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী হবে মনে করে নেহরু এই উদ্যোগ স্থগিত রাখলে সমস্যা বাড়ে। ১৯৫২ সালে তামিলভাষী মাদ্রাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক তেলুগুভাষী প্রদেশের দাবিতে গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী পট্টি শ্রীরামুলুর ৫৮ দিনের অনশনে মৃত্যু যে ব্যাপক জনরোষের জন্ম দেয়, তারই ফলস্বরূপ দু’দিনের মধ্যেই পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন নেহরু। দেশ জুড়ে বাড়তে থাকে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর পৃথক রাজ্যের দাবি। আইনবিদ এস ফজল আলি, ইতিহাসবিদ কে এম পানিক্কর, এবং সমাজকর্মী এইচ এন কুঞ্জরুকে নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশে ১৯৫৬ সালে সারা দেশে রাজ্য পুনর্গঠন হয় ভাষার ভিত্তিতে। ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবি তত দিনে এতই সুপ্রতিষ্ঠিত যে, বম্বে শহরের বহুভাষিক চরিত্রের কথা খেয়াল রেখে মরাঠি ও গুজরাতিদের জন্য দ্বিভাষিক বম্বে প্রদেশ গঠিত হলেও ক্রমাগত আন্দোলন ও সংঘাত ১৯৬০ সালের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথক মহারাষ্ট্র ও গুজরাত।

ভারতে বহুভাষিক সমাধানের অনিবার্যতা সম্পর্কে সচেতন নেহরু ১৯৬৩ সালে ‘সরকারি ভাষা আইন’-এ ১৯৬৫ সালের পরেও সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার জারি রাখার উদ্যোগ করেন। কিন্তু নেহরুর মৃত্যুর পরে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করতে আগ্রহী হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজ়ারিলাল নন্দ। ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে তামিলনাড়ু। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে হিন্দিকেই সরকারি ভাষায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ব্যাপক গণ-আন্দোলনের ডাক দেয় সি এন আন্নাদুরাই-এর নেতৃত্বাধীন ডিএমকে। আন্নাদুরাই-এর চোখে হিন্দি ছিল বাকি ভারতীয় ভাষাগুলির মতোই একটি আঞ্চলিক ভাষামাত্র। বন্‌ধ, হরতাল, ধর্নার পাশাপাশি ঘটতে থাকে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে যুবকদের আত্মহত্যা এবং হিংসাত্মক সংঘাত। কংগ্রেসের মধ্যেও এস নিজলিঙ্গাপ্পা, কে কামরাজ, অতুল্য ঘোষ, সঞ্জীব রেড্ডিরা হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেন; অন্য দিকে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার সওয়াল করেন মোরারজি দেশাই।

শাস্ত্রী নিজে হিন্দিপন্থী হয়েও, বিপুল জনমত মেনে নেহরুর পথেই ফিরে আসেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করেন যে, প্রত্যেক রাজ্য নিজের পছন্দমতো সরকারি ভাষা বেছে নিতে পারবে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হিসাবে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজির ব্যবহার বহাল থাকবে। পরে যোগ হয় ইংরেজিতে সর্বভারতীয় সরকারি পরীক্ষাগ্রহণের নিশ্চয়তাও। ১৯৬৭ সালে সিলমোহর পড়ে সিদ্ধান্তগুলিতে। নিশ্চিত হয় যে, ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই; সরকারি কাজে হিন্দি ও ইংরেজি দু’টিই গ্রহণযোগ্য, এবং অষ্টম তফসিলভুক্ত প্রতিটি ভাষাই ভারতের জাতীয় ভাষা। মোরারজি পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেও, তাঁর সহযোগী হিন্দুত্ববাদী জনসঙ্ঘের চাপ সত্ত্বেও পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাননি। বরং তিনি জানান যে, তিনি হিন্দির প্রসারে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে।

নেহরু, শাস্ত্রী, দেশাইরা জাতীয় স্বার্থে আত্মসংশোধন করেছেন। কিন্তু হিন্দি আধিপত্যবাদের ইতিহাসে মিশে আছে ভাষার সাম্প্রদায়িকীকরণ, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের রাজনৈতিক ভাষ্য। এই ভাষ্য এক ভাষা এক ধর্মের রাজনীতিতে মুছে দিতে চায় ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বহুত্ব। হিন্দি হয়ে ওঠে তার আগ্রাসী মাধ্যম। ২০১১ সালের জনগণনায় হিন্দি ভারতের ৪৩.৬৩% মানুষের মাতৃভাষা। কিন্তু, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ৫৬টি পৃথক মাতৃভাষা (ভোজপুরি, রাজস্থানি, ছত্তীসগঢ়ি, মগধি, হরিয়ানভি, পাহাড়ি ইত্যাদি) যাদের বাদ দিলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৬.৬%। জি এ গ্রিয়ার্সনের ভাষাতাত্ত্বিক সমীক্ষার মতে, এই ভাষাগুলি হিন্দির থেকে আলাদা। বহুভাষাভাষী পঞ্জাবেও হিন্দুরা এক সময় অনেকেই হিন্দিকে তাঁদের মাতৃভাষা হিসাবে উল্লেখ করতে থাকেন। পঞ্জাবিভাষী পৃথক প্রদেশের দাবি মূলত শিখদের থেকে আসায় একে ভাবা হয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা। অবশেষে ১৯৬৬ সালে পঞ্জাবিভাষী পঞ্জাব আর হিন্দিভাষী (হরিয়ানভি-সহ) হরিয়ানা আলাদা হয়। পাহাড়িভাষী অঞ্চলগুলি হিমাচল প্রদেশে গেলেও হিমাচলের সরকারি ভাষা কিন্তু হিন্দিই থাকে। বিহারেও তাই। বিহারি ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র মৈথিলী দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০০৩ সালে স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

হিন্দির এই আগ্রাসন হিন্দুত্ববাদকে ঢেলে নিতে চায় হিন্দি বলয়ের ধর্ম ও সংস্কৃতির একরৈখিক ছাঁচে— যদিও হিন্দি যে সব হিন্দুর ভাষা নয়, এই বার্তা বার বার দিয়েছে দক্ষিণ ভারত। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাতৃভাষা বাংলা। তাই হিন্দি আগ্রাসনের অন্যতম লক্ষ্য বাংলা। যে বাংলায় দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল বা দোল-রথ-চড়কের মেলায় আমিষ খাবারের দোকান ছিল একান্ত স্বাভাবিক, সেখানেও তাই গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের দিন ময়দানে চিকেন প্যাটি বিক্রি হয় আক্রমণের কারণ। কালজয়ী বঙ্গীয় মহাভারত-রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ, কিশোরীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজশেখর বসুদের রাজ্যে গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে দাপটের সঙ্গে ধ্বনিত যায় হিন্দির মাহাত্ম্য। আবার দিল্লি পুলিশের বয়ানে বাংলা হয়ে যায় ‘বাংলাদেশি ভাষা’। বাংলা বলার ‘অপরাধ’-এ সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয় সোনালি খাতুন বা আমির শেখকে। হিন্দুরাষ্ট্রের ডাকে মিশে যায় হিন্দি-রাষ্ট্রের ডাক।

সোভিয়েট একনায়ক জোসেফ স্তালিন মনে করতেন ভাষাগত ঐক্য ছাড়া জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। আমেরিকান সাংবাদিক বার্নার্ড নোসিটার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ফলে ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বাড়বে। কিন্তু রামচন্দ্র গুহ দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশ এই ধারণাগুলিকে ভুল প্রমাণ করেছে। শ্রীলঙ্কার সংসদ একমাত্র সিংহল ভাষাকে স্বীকৃতি দিলে তামিলভাষী উত্তর শ্রীলঙ্কায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তানেও জিন্না ঘোষণা করেন যে, একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়, আর সেই ভাষা হবে উর্দু। এই রাজনীতির অন্তিম ফল বহু রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের সৃষ্টি। বরং ভারতে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠন ও বহুভাষিক নীতি প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠীকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, করেছে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জীবনের অংশীদার। আত্মবিস্মৃত বাংলাদেশে আজ ধর্মীয় মৌলবাদের হাতে আক্রান্ত বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক বহুভাষিক ভারতও যেন আত্মবিস্মৃত না হয়, সেই দায় বাংলারও— শুধু দক্ষিণের রাজ্যগুলির নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hinduism Hindi Language

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy