নরেন্দ্র মোদীর জয়। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফলের ইহাই প্রধানতম ব্যাখ্যা। এক অর্থে, তিনি এক বিপুল রাজনৈতিক ঝুঁকি লইয়াছিলেন। উত্তরপ্রদেশ দেশের বৃহত্তম রাজ্য তো বটেই, নির্বাচনী তাৎপর্যে লোকসভা ভোট ব্যতীত তাহার দ্বিতীয় তুলনা নাই। সেই রাজ্যে তিনি কোনও স্থানীয় মুখ বাছেন নাই। তিনিই ছিলেন দলের মুখ। রাজ্য তাঁহাকে আশাতীত সাফল্য দিয়াছে। তাঁহার দল নিঃসন্দেহে উজ্জীবিত, কিন্তু এই সাফল্য ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক সুগভীর বিপদসংকেতও বটে। কারণ, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিবিধ রণনীতির মধ্যে প্রধানতমটি ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন, যাহা দলের প্রাচীনতম নীতিও বটে। সেই রাজনীতির জন্য কোনও দাঙ্গার প্রয়োজন হয় নাই, মুজফ্ফরনগরের পুনরাবৃত্তি করিতে হয় নাই। ৪০৩টি আসনের একটিতেও কোনও মুসলমান প্রার্থী না দেওয়ার মধ্যে যে বার্তাটি ছিল, ‘কবরস্থান বনাম শ্মশান’, ‘রমজান বনাম দীপাবলি’-র দ্বন্দ্ব খাড়া করিয়া প্রধানমন্ত্রী তাহাকে প্রকটতর করিয়াছেন। দলীয় প্রার্থীরাও নির্দ্বিধায় হিন্দুত্ববাদের প্রচার চালাইয়াছেন। ফলে, এই জয়কে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির জয় হিসাবে না দেখিবার কোনও কারণ নাই।
কিন্তু, শুধু বিভাজনের নহে, ইহা একাত্মকরণের জয়ও বটে। মণ্ডলের বিরুদ্ধে কমণ্ডলুর পাল্টা আধিপত্যের যে স্বপ্ন বিজেপি গত আড়াই দশক ধরিয়া দেখিয়াছে, শনিবারের উত্তরপ্রদেশে সম্ভবত তাহার বৃহত্তম বাস্তবায়ন হইল। কেবল উচ্চবর্ণের সনাতন ভোটব্যাঙ্ক নহে, বিজেপি এই নির্বাচনে বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে ধরিতে পারিয়াছে। তাহার মধ্যে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ আছেন, দলিতরাও আছেন। অনস্বীকার্য, এই সাফল্যের জমি মুলায়ম সিংহ, মায়াবতী আদি নেতারা বহুলাংশে তৈরি করিয়াই রাখিয়াছিলেন। অনগ্রসর বলিতে যে শুধু যাদব বুঝায় না, জাতভরাই যে শুধু দলিত নহেন, এই কথাটি তাঁহাদের রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয় নাই। ফলে, অ-যাদব অনগ্রসর বা জাতভ-ভিন্ন দলিতদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিহীনতার যে ক্ষোভ জমা হইয়াছিল, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তাহার পূর্ণ ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহারা কেশবপ্রসাদ মৌর্যকে দলের রাজ্য সভাপতি করিয়াছেন, যে অঞ্চলে যে জাতের রাজনৈতিক প্রভাব, সেখানে সেই জাতকেই গুরুত্ব দিয়াছেন। বিজেপিতে কার্যত বহিরাগতদের বহু আসনে প্রার্থী করিয়াছেন। যাদব-জাতভ-মুসলমান ভোট বাদ রাখিলেও রাজ্যে যে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি ভোটার পড়িয়া থাকেন, অমিত শাহরা তাঁহাদেরই লক্ষ্য করিয়াছিলেন। এবং, কোনও বৃহৎ রণকৌশল নহে, স্থানীয় সমীকরণকে মাথায় রাখিয়াই তাঁহারা নির্বাচনের ঘুঁটি সাজাইয়াছিলেন। ফল মিলিয়াছে। এই জয় যতখানি নরেন্দ্র মোদীর, অমিত শাহেরও তাহার কম নহে।
মায়াবতীর অকস্মাৎ মুসলমান-প্রীতিও বিজেপিকে সুবিধা করিয়া দিয়াছে। তাহাতে এক দিকে বহেনজির ‘কোর ভোটার’রা যেমন ক্ষুণ্ণ হইয়াছেন, তেমনই মুসলমান ভোটও ভাগ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু, হিন্দু ভোটের একত্রীকরণ ও মুসলমান ভোট বিভাজনের হিসাব মিলাইবার পরও প্রশ্ন থাকিয়া যায়, বিভিন্ন মুসলমান-অধ্যুষিত কেন্দ্রেও বিজেপি প্রার্থীর জয়লাভের পিছনে কি মুসলমান ভোটও আছে? অনুমান, তিন তালাক প্রশ্নে বহু মুসলমান মহিলা বিজেপিকে ভোট দিয়াছেন। অনুমানটি সত্য হইলে তাহা ভারতীয় রাজনীতিতে একটি মাইলফলক হইয়া থাকিবে। ‘তিন তালাক’ প্রথাটি নিন্দনীয়, এবং অবিলম্বে বর্জনীয়, কিন্তু বিজেপি যে কারণে এই প্রথাটিকে তাহাদের আক্রমণের কেন্দ্র রাখে, তাহাতে মুসলমান মহিলাদের প্রতি সমবেদনা কতটুকু আর মুসলিম-বিদ্বেষের রাজনীতি কতখানি, বলা কঠিন। কিন্তু মুসলমানদের এক অংশ যদি এই বিজেপির ‘রেটরিক’-এ বিশ্বাস করেন, তাহা একটি নূতন এবং বিশেষ প্রবণতা হিসাবে গণ্য হইবার যোগ্য। অবশ্য, ভোটাররা যে কাজের তুলনায় কথাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়াই থাকেন, নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য তাহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। উত্তরপ্রদেশ মোদীকে ‘গরিবের মসিহা’ হিসাবে চিনিয়াছে। গত পৌনে তিন বৎসরে তিনি এমন কোনও নীতি প্রণয়ন করিতে পারেন নাই, যাহা প্রত্যক্ষ ভাবে গরিবের পক্ষে ইতিবাচক। কিন্তু মুখে গরিবদরদি এবং, আরও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ধনী-বিদ্বেষী অবস্থানটি তিনি বজায় রাখিয়াছেন। এই জয় তাঁহার সেই ভাবমূর্তির। বিরোধী রাজনীতির ব্যর্থতা, তাহারা নিজেদের জমি ধরিয়া রাখিতে পারে নাই, মোদীর কথায়-কাজে ফারাকও স্পষ্ট করিয়া দেখাইতে পারে নাই। এই সমূহ পরাজয়ই তাহাদের নিয়তি ছিল।
যৎকিঞ্চিৎ
সব্বাই জানে, দায়িত্বশীল সংগঠনের কর্তব্য হল ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে কোনও যুগল পার্কে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকলে তাদের ওঠবোস করানো, বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তার তালিকা অপছন্দ হলে ক্যাম্পাসে বেধড়ক মারপিট বাগানো। সোজা কথায়, চাবকে সমাজকে সুপথে আনা। আজ দোল। রং দেওয়ার এই বিচ্ছিরি উৎসব প্রায়ই শালীনতা পেরিয়ে যায়। আশা: ভারতীয় ঐতিহ্যের এই স্বনিযুক্ত মোড়লরা আজ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবেন পিচকিরি নয়, লাঠি হাতে, এবং পিরান বা পরান নয়, চোখ রাঙিয়ে!