Advertisement
E-Paper

কলঙ্কের রজতজয়ন্তী

পরবর্তী সিকি শতাব্দীতে ভারত অনেক বদলাইয়াছে। তাহার কতটা যথার্থ উন্নয়ন আর কতখানি উন্নয়নের আড়ম্বর, সেই বিষয়ে বিস্তর তর্ক আছে।

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৩৪

সেই মসজিদও নাই, সে অযোধ্যাও নাই। নাই সেই ভারতও। সরযূতীরের পুরাণনগরী এখন নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র। ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রে এবং বহু রাজ্যে এখন সংঘ পরিবারের শাসন। এই পরিবর্তন এক দিনে আসে নাই, তাহার পূর্বাপর ইতিহাস সুদীর্ঘ, বস্তুত— রাম জন্মাইবার আগে যেমন রামায়ণ— স্বাধীন ভারতের জন্মের আগেই তাহার এই পরিণতির শঙ্কাবীজগুলি উপ্ত হইয়াছিল, তাহাদের পরিচর্যা করিবার লোকেরও অভাব ছিল না। উদার ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য হইতে এই দেশের সমাজ ও রাজনীতিকে পথভ্রষ্ট করিয়া সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তৎপরতা নূতন নহে, তাহার অকল্পনীয় রকমের ভয়াবহ পরিণামও দেশবাসী বিস্ফারিতনয়নে দেখিয়াছিলেন স্বাধীনতার প্রত্যুষেই— ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮-এর জন্য জওহরলাল নেহরু ও তাঁহার দেশ প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু সেই বিপর্যয়কে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত বলিলে তাহা সত্যের প্রতি আগ্রহের পরিচায়ক হইবে না।

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর জন্যও দেশবাসী প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু তাহার প্রস্তুতি ছিল জোরদার। সাড়ে চারশো বছরের পুরানো বাবরি মসজিদের ধ্বংসকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত ছিল কি না, রামলালার মন্দির বানাইবার সংকল্প ঘোষণা করিয়া রথযাত্রা আয়োজনের এমন পরিণাম দেখিয়া লালকৃষ্ণ আডবাণীর সত্যই হৃদয়বেদনা হইয়াছিল কি না, সেই জল্পনা এক কালে বিস্তর চলিয়াছে, আজ, হয়তো বা আডবাণীজির মতোই, তাহার আর বাজার নাই, প্রয়োজনও নাই। সেই তমসা-মুহূর্তের পঁচিশ বছর পরে এই সত্যটি স্মরণ করা জরুরি যে, সে দিন কেবল একটি ঐতিহাসিক সৌধ ধ্বংস হয় নাই, বিধ্বস্ত হইয়াছিল ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক আদর্শটিও। ধর্মের নামে হানাহানি ভারতে নূতন নহে, ধর্মাশ্রিত রাজনীতির চর্চাও পরিচিত, কিন্তু সেই রাজনীতির বিষফল পাড়িবার তাড়নায় একটি মসজিদ ভাঙিয়া ফেলা হইতে পারে— এমন সম্ভাবনা সেই দিনের আগে অধিকাংশ ভারতবাসীই করিতে পারেন নাই। সম্ভব এবং অসম্ভবের সীমারেখা সেই দিন নূতন করিয়া চিহ্নিত হইয়াছিল। সেই রেখা গভীর কলঙ্কের রঙে রঞ্জিত।

পরবর্তী সিকি শতাব্দীতে ভারত অনেক বদলাইয়াছে। তাহার কতটা যথার্থ উন্নয়ন আর কতখানি উন্নয়নের আড়ম্বর, সেই বিষয়ে বিস্তর তর্ক আছে। কিন্তু এই সময়পর্বে যে বিষয়টিতে ভারত সরাসরি পশ্চাপসরণ করিয়াছে, তাহার নাম ধর্মনিরপেক্ষতা— বহুধর্ম, বহুভাষা, বহুসংস্কৃতির এই ভারততীর্থে যে ধর্মনিরপেক্ষতা যথার্থ গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর সহৃদয় এবং সসম্মান মনোভঙ্গি এই শর্ত পূরণের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। এখানেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মৌলিক অ-গণতান্ত্রিকতা। তাহাদের নিকট গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগুরুর শাসন। তাহাদের বিচারে বাবরি মসজিদ মূল্যহীন, রামমন্দির ‘ওইখানেই বানাইতে হইবে’। উদার গণতন্ত্রের দিশাটিকে যদি পুনরুদ্ধার করিতে হয়, তবে এই বিচারধারাটিকেই সম্মুখসমরে আহ্বান জানানো কর্তব্য। কর্তব্য এই মৌলিক প্রশ্নটি তোলা— রামচন্দ্রের কল্পিত জন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণের আগে যে বাবরি মসজিদ বাস্তবে ছিল এবং যাহাকে পৈশাচিক আক্রোশে ভাঙা হইয়াছে, তাহার সেই ধ্বংসকাণ্ডের কী প্রতিকার হইবে। সংঘ পরিবারের নিকট সেই প্রশ্নের সদুত্তর চাহিয়া কোনও লাভ নাই, কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, এমনকী মহামান্য বিচারবিভাগও এই প্রশ্নটিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেন নাই। যদি এই দুর্ভাগ্যের কাহিনি না বদলায়, তবে বুঝিতে হইবে, পঁচিশ বছর আগে তথাকথিত করসেবকরা কেবল একটি মসজিদ বিনাশ করে নাই, ভারতাত্মাকেও বিনাশ করিয়াছে।

Babri Masjid Ayodhya ram Mandir
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy