Advertisement
E-Paper

উঁচু নাক ভাঙে না

আসলে সাম্য বলে কিছু থাকা উচিত নয়। তা হলে আইনস্টাইন আর গুপি গাইন এক হয়ে যাবে। সাম্য হল অবিচারের দোসর।আসলে সাম্য বলে কিছু থাকা উচিত নয়। তা হলে আইনস্টাইন আর গুপি গাইন এক হয়ে যাবে। সাম্য হল অবিচারের দোসর।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:৩১

এই এক দেশ হয়েছে! পেছনে লাগতে পেলে আর কিছু চায় না। কী আস্পদ্দা, আমায় জিজ্ঞেস করছে, গাড়ি কেন জোরে যাচ্ছিল! আরে আমার গাড়ি জোরে যাবে না তো কি তোর মেসোমশাইয়ের গাড়ি জোরে যাবে! হ্যাঁ, একটা বাচ্চা মেয়ে মারা গেছে, একটা বাচ্চা ছেলের হাত-পা ভেঙে গেছে, আরও কী কী সব হয়েছে। তা আমি কী করব? শোক হয়েছে, তার সঙ্গে ডিল করতে শেখ! পৃথিবীতে জরা ব্যাধি মৃত্যু তো কবে থেকেই আছে। আমি তো চালু করিনি। এ বার সন্তানের শোক ভুলতে তুই সন্নিসি হবি, না সিনেমা দেখে কাল কাটাবি, তুই ঠিক কর। আজেবাজে বকে অন্যকে ঝামেলায় ফেলছিস কেন? দুর্ঘটনার দু’মিনিটের মধ্যে আমাকে সাঁইসাঁই করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ওদের গাড়ির আহতগুলো ওখানেই পড়ে থেকেছে। তাতে এত উতলা হওয়ার কী আছে? একটা ভারতবিখ্যাত মানুষের অ্যাকসিডেন্ট হলে তাকে অনেক তাড়াতাড়ি আর যত্নের সঙ্গে উদ্ধার করা হবে না? সাধারণ মানুষের জীবন আর আমার জীবন এক? কাম অন! আজ বচ্চনের দাঁতে ব্যথা হলে, তিনি ডেন্টিস্টের চেম্বারে ঢোকামাত্র যে লাল-পড়া অভ্যর্থনা পাবেন, একটা পাতি রোগীও তা-ই পাবে? তেন্ডুলকর ব্যাংকে গেলে কাউন্টারের পেঁচো বলবে, স্যর, লাইনটা ওখানে, আপনি তেরো জনের পর দাঁড়ান?

খুব সোজা একটা কথা ভাব। এত তো গাড়ি-দুর্ঘটনা রোজ রোজ হচ্ছে। এত বড় খবর হচ্ছে কি? এ বার হল কেন? কারণ আমার নাক ভেঙেছে। তা হলে এখানে কর্ত্রী কে? আমি। কর্ম কী? আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারিয়ে তোলা। অকর্ম কী? এই ‘জাতীয় ক্রাইসিস’টার সময়, চুনোপুঁটির প্রতি নজর দেওয়া। নাহয় ওরা আমার পাশেই পড়েছিল। কাতরাচ্ছিল। নাহয় একই অ্যাকসিডেন্টের ওরাও ভিকটিম। কিন্তু ঘোর সংকটকালেও তেলে-জলে মিশ খেতে দেওয়া যায়? উঁহু। যন্ত্রণা-চিৎকার আর ছেঁদো মানবিকতার দাবিতে সাড়া না দিয়ে, মাথা ঠান্ডা রেখে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যক্তিটাকে আগে বের করে আনতে হয়। সেটাই মাত্রাজ্ঞান।

হ্যাঁ, ওদের পরিবারের খুব শোক চলছে। কিন্তু পরিবারে ক’টা লোক আছে? তিনটে? তিরিশটা? আমার কিছু হয়ে গেলে ক’টা লোকের ওপর বাজ ভেঙে পড়ত! মানুষের পর মানুষ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, কোটি কোটি লোক আমাকে দেখে, ভেবে, ফ্যান্টাসাইজ করে, তাদের পাতি জীবনটাকে ভুলে থেকেছে। শোন ভাই, ভিআইপি-কে নিয়ে আদিখ্যেতা কেন করা হয়? কারণ তাঁর জীবনটা তাঁর একার নয়। গোটা জাতের। গাঁধী যখন মারা গেলেন, কত বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি। প্রিন্সেস ডায়ানা যখন মারা গেলেন, কান্নার চোটে সায়েব-মেমদের চোখে ওয়াইপার লাগাতে হয়েছিল। তার মানে, এঁরা চলে গেলে একটা জাতির কিছুটা কাটা পড়ে যায়। ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। সাম্যের ধারণা নিয়ে সারা জীবন লোপালুপি চলতে পারে, কিন্তু আসলে সাম্য বলে কিছু থাকা উচিত নয়। তা হলে আইনস্টাইন আর গুপি গাইন এক হয়ে যাবে। সাম্য হল অবিচারের দোসর। জীবনের প্রতি ঠিকঠাক দৃষ্টিভঙ্গি বলে, সাধারণ মানুষরা সবাই নিশ্চয় সমান, কিন্তু সেই সাধারণ মানুষকে চালনা করে যে অ-সাধারণ মানুষদের অবদান, তাঁরা সমানের বাবা। সেই জন্যেই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে সাইরেন লাগানো থাকে, তার প্যাঁ-পোঁ শুনে তক্ষুনি পথ ছেড়ে দেওয়া হয়। সাম্য তার গামবাট মাথা তুলে বলবে, ‘কেন? উনিও কেন অন্যদের মতোই জ্যামে আটকাবেন না?’ চাঁটা মেরে উত্তর হল, উনি আটকে থাকলে দেশটাই আটকে যাবে। তেমনই, আমার কোমর ভাঙলে, একটা যুগের নৃত্যলীলা থমকে যাবে। মহাকালের গতর থেকে কয়েকশো হোর্ডিং খসে পড়বে নক্ষত্রের চাঙড়ের মতো।

তবে ঝামেলা বাগিয়ে কিস্যু করতে পারবিনি। অভ্যেস আছে। যখন বললাম, বাইরে থেকে বিধবারা এসে বৃন্দাবনে ভিড় বাড়াচ্ছে, বাংলা আর বিহারে গুচ্ছের মন্দির আছে, সেখানকার বিধবারা সেখানেই থাকুক না— কী গ্যাঞ্জাম! নিন্দুকেরা বলল, আমি যে তামিলনাড়ুতে জন্মে, মুম্বইতে সিনেমা করে, এখন মথুরা থেকে ভোটে দাঁড়াচ্ছি, এইটাই বা করি কী করে? আমার সঙ্গে বিধবাগুলোর তুলনা! কতকগুলো স্বেচ্ছা-ভিখিরি! টাকা আছে, ঘর আছে, তাও ভিক্ষে করে বেড়ায়, কারণ ভিক্ষেয় হেভি সুখ! ভোট জেতার পর, এক দিন শুনি মথুরায় লোকেরা আমার পোস্টার সেঁটেছে চার দিকে, তলায় লেখা ‘মিসিং’! আমার কুশপুতুলও জ্বালাচ্ছে, এমনকী শ্রাদ্ধও করছে। ছিঃ! ওরা কী আশা করেছিল? এক দিন তো গেছিলাম, দুঃখদশা সার্ভে করতে। আবার যাব? ওদের সঙ্গে রোদে পুড়ে টিউকল থেকে জল তুলব? তা হলে পরের বার ওরাই আর আমাকে ভোট দেবে? আমার এই ছেষট্টি বছর বয়সেও অলৌকিক রূপ, জেল্লাদার স্কিন, মিটিমিটি ভুবনমোহন স্মাইল, এগুলো আর থাকবে? এ সব রাখতে গেলে খাটতে হয় রে, তোদের মতো দাদ চুলকে, চুকলি করে কাল কাটালে হয় না। বিশুদ্ধ জল গিলতে হয়, এয়ারকন্ডিশনে থাকতে হয়, লো-ফ্যাট দুধে চান করতে হয়। রূপের দৌলতে ভোট জিতেছি, আজ কাজ করতে গিয়ে সেই রূপ খোয়াব!

যারা ন্যাকামি করে সাধারণ-মানুষ-সাধারণ মানুষ খেলে, তাদের সঙ্গে আমায় গুলিয়ে ফেলিসনি। যে নিজের মূল্য জানে, ছদ্ম-বিনয় করে মার্কেট চাইবে কেন? ভোটের ক্যাম্পেনের সময় বিরাট গাড়ি না পেলে টেরিফিক অশান্তি করেছি, বলেছি পথে একদম গাড়ি থামাবি না। সাধারণ মানুষ দাঁত বার করে হামলে পড়বে, আর ঘিনঘিনে ঘেমো হাতগুলোয় হাত ধরতে দেব, ভাবলেও গুলিয়ে ওঠে। যারা বলে, পলিটিক্‌স করতে এসে আমি নেচে বেড়াই, ঠিকই বলে। আমি নাচব, নাচাব, কোনও ব্যাটাকে জবাবদিহি করব না। সারা দেশের ড্রিমে আমি তা দিই, একটা-আধটা দুর্ঘটনা আর স্বপ্নভঙ্গের পুচকে জার্ক দিয়ে আমার মার্সিডিজের স্পিড রোখা যায় না!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

hema malini accident bollywood car BJP MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy